Thokbirim | logo

২রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

মায়ের স্বপ্ন ।। মানুয়েল চাম্বুগং

প্রকাশিত : মে ২৪, ২০২১, ১১:৪৩

মায়ের স্বপ্ন ।। মানুয়েল চাম্বুগং

ভোরের দেখা স্বপ্ন সত্য হয় কি-না আমার জানা নেই। অনেকেই মনে করেন ভোরের দেখা স্বপ্ন সত্যিই হয়। দেভাস এর মা-ও তাদের মধ্যে একজন। একবার স্বপ্নে খুব ভোরে গাড়ির তলায় ছেলেকে ছাপা পড়ে মরতে দেখে বুক ধড়ফড় করে ঘুম থেকে জেগে উঠে। সর্বশরীরির কাঁপতে কাঁপতে মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে সে দেভাসকে কল করে। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। যতবারই কল করলো ততবারই দুঃখিত সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে উত্তর আসলো। অস্থির মনে সে ঈশ^রের কাছে ছেলের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করে। ইতিমধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। দেভাস ও তার বন্ধুরা খুবই আনন্দিত। কারণ তারা অনেক দিনের পর বাড়িতে যেতে পারবে। দেভাস মোবাইল ফোনটা পকেট থেকে বের করে তার মাকে কল দেয়। অপর প্রান্ত থেকে তার মা মোবাইলের রিংটন বাজা মাত্রই কল রিসিভ করে বলল, “কে দেভাস?
“হ্যাঁ মা আমি। কেমন আছ মা?”
“আমি ভাল আছি। তুমি কেমন আছ, বাবা?”
“আমিও তোমার আশীর্বাদে ভালই আছি মা। মা তুমি কি অসুস্থ?”
“না বাবা।”
“তাহলে তোমার গলার স্বর এমন শোনা যাচ্ছে কেন মা ?”
“তোমাকে নিয়ে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলাম তো তাই টেনশনে ছিলাম।”
“ও আচ্ছা, মা তুমি শোনে খুশি হবে যে আমি আগামীকাল বাড়ি যাচ্ছি।”
“তাই না-কি!, এসো বাব, এসো। কবে থেকেই না তোমার অপেক্ষায় আমি বসে আছি।”
“ঠিক আছে মা আজ তাহলে রাখি।”
“রাখ লক্ষী সোনা আমার, ভালমতো এসো।” রাতের খাবারের পর তারা সবাই আনন্দ স্ফূর্তিতে কাপড়-ছোপড় ব্যাগে গুছিয়ে ঘুমিয়ে পরলো। কেননা তাদেরকে আগামী কাল খুব ভোরে ঢাকা শহর ছাড়তে হবে। তাদের অনেকেরই গ্রাম ঢাকা শহর থেকে অনেক দূরে ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের শেষ সীমান্তে। ঢাকা শহর থেকে তাদের গ্রামে পৌঁচ্ছতে প্রায় ৯ থেকে ১০ ঘন্টা সময় লাগে।

পরের দিন ভোর ৫টায় দেভাস ও তার বন্ধুরা সবাই যার যার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। এদিকে দেভাসের মা ছেলের অপেক্ষায় বসে থাকে। বিকেল সাড়ে ৫ টা বাজে দেভাস এখনো বাড়ি ফিরছে না। রাস্তাঘাটে কোন সমস্যা হয়েছে না-কি। এই ভেবে সে ঘরে প্রবেশ করছে আর বের হচ্ছে। ঠিক ঐ মূহুর্তে দেভাস বাড়ির উঠানে এসে মাকে ডাকল, “মা মা তুমি কোথায় আমি এসে গেছি।” ছেলের কন্ঠস্বর শোনে ঘর থেকে বের হয়ে দেভাসকে দেখতে পেয়ে সে তো মহাখুশি। দেভাস তার মাকে প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করল, “কেমন আছ মা?”
“আমি ভাল আছি সোনা। রাস্তাঘাটে কি তোমার কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“তেমন কিছু হয় নি মা। তবে বাস থেকে নামার পর কোনো রিক্সা পাই নি তো তাই দেরি হয়ে গেল।”
“ও আচ্ছা। সোনা, তুমি এখন বাধ্য ছেলের মতো স্নান করে এসো বাবা; আমি তোমার জন্য পিঠা বানিয়ে রেখেছি। স্নানের পর দেভাস রান্না ঘরে প্রবেশ করে টেবিলে সাজানো বিভিন্ন ধরণের পিঠা দেখে খুশি হয়ে তার মাকে জিজ্ঞেস করল, “মা তুমি খেয়েছো?”
“না বাবা, আমি কি তোমাকে রেখে খেতে পারি।”
“তাহলে এসো মা একসাথে খায়।”
“না বাবা, তুমি আগে খেয়ে নাও, আমি পরে খেয়ে নেব।” দেভাস খাওয়ার পর নিজের রুমে চলে যায়। অনেক দিন পর বাসে দীর্ঘ পথ যাত্রায় সে ক্লান্ত বিধায় বিছানাতে শুয়েই সে ঘুমিয়ে পড়ে। দেভাসের মা রান্নাবান্না শেষ করে দেভাসকে ডাকল, “দেভাস বাবা দেভাস রান্না ঘরে চলে আয়, রাতের খাবার খেয়ে নাও।” দেভাস ঘুমের মধ্যে কিছুটা আভাস পেয়ে আসছি মা বলে রান্না ঘরে যায়। অনেক দিনের পর মায়ের হাতের রান্না খেয়ে সে খুব মজা করে পেট ভরে খেলো।
প্রতিদিনের মতো দেভাসের মা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে হাড়িপাতিল থালাবাসন ধুয়েমুছে নাস্তা প্রস্তুত করে। দেভাস তখনো ঘুমাচ্ছিল। দেভাস বাবা দেভাস তুমি এখনো ঘুমাচ্ছ; উঠে এসো বাব, নাস্তা খেয়ে নাও বলে দেভাসের মা ডাকলো। দেভাস মায়ের মধুর ডাক শুনে ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাস করে রান্না ঘরে এসে নাস্তা খেতে খেতে বলল, “মা আমি আমার বন্ধু যোনাস এর বাড়িতে যেতে চাচ্ছিলাম।” “যাও, আমি কি কখনো তোমাকে যেতে মানা করেছি? তবে বেলা থাকতে ফিরে এসো।” যোনাসের বাড়ি তাদের পাশের গ্রামে। তারা দুজনে ইন্টারমিডিয়েট নটর ডেম কলেজে একসময় পড়াশুনা করত। তাদের দুজনের মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। একে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করত। কিন্তু ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর আর্থিক সমস্যার কারণে যোনাসের পড়াশুনা ছেড়ে দেওয়ায় তাদের মধ্যে তেমন যোগাযোগ হয় না। সে এখন গ্রামে একটি এনজিওতে কাজ করে। দেভাস নাস্তা খাওয়ার পরপরই যোনাসের বাড়িতে যায়। দূর থেকে দেভাসকে দেখতে পেয়ে যোনাস মনে মনে ভাবে, এই মানুষটিকে তো পরিচিত মনে হচ্ছে। ভালো করে দেখলো সে আসলে তার বন্ধু দেভাস। দুই বন্ধু অনেক দিন পর একে অপরকে দেখে খুশি হয়ে কোলাকুলি করে। দেভাস জিজ্ঞেস করল, “কিরে বন্ধু কেমন আছিস?” মিষ্টি হেসে যোনাস বলল, “আছি কোন মতে। আর তুই কেমন আছিস রে?” “আমিও মোটামুটি ভালই আছি।” এভাবে কৌশলবার্তা বিনিময় করে তারা তাদের জীবনের সুখ-দুঃখের কথা আলাপ করে। সেদিন দেভাসের বাড়ি ফিরতে ফিরে প্রায় সন্ধ্যা হয়।
দিন যায় রাত আসে এভাবে দেভাসের ছুটি শেষ হয়ে যায়। এক সন্ধ্যায় দেভাস রাতের খাবারের পর তার মাকে বলল, “মা আমার তো ছুটি শেষ হলো।”
“তাহেল তুমি কবে যাচ্ছ, বাবা?”
“আগামীকাল।”
“তুমি কালই যাচ্ছ লক্ষী সোনা আমার!”
“হ্যাঁ মা আমাকে কালকেই যেতে হবে। কারণ আগামীকালের পরের দিন আমাদের কলেজ খুলবে।”
“তবে যাও বাবা, ভালমতো পড়াশুনা কর যাতে একদিন ভাল ডাক্তার হতে পার। তুমি তো জানো তোমার বাবা আর তোমার ছোট বোন তারা দুজনেই ডাক্তারের অভাবে বিনাচিকিৎসায় মারা গেছে।”
“ঠিক আছে মা আমার জন্য প্রার্থনা কর।”
“আমি তো সবসময়ই তোমার জন্য প্রার্থনা করি যাতে তুমি ভাল চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করতে পার।”
সকাল হলে দেভাস তার মায়ের কাছ থেকে পায়ের ধূলো নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। দেভাস ও তার বন্ধুরা সবাই মেসে ফিরে আবার আগের মতো কলেজে যাচ্ছে, কলেজ ছুটির পর টিউশুনি করে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে লাগল। একদিন দেভাস কলেজে যাওযার সময় একটি রাস্তা পার হচ্ছিল। হঠাৎ এমন সময় একটি বাস এসে তাকে ধাক্কা মেরে দ্রুত চলে যায়। এতে দেভাস রাস্তার মাঝখানে ছিটকিয়ে পড়ে এবং পিছন থেকে অন্য একটি বাস এসে তাকে চাপা দেয়। তার বন্ধুরা তাকে তাড়াতাড়ি ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় ডাক্তার তাকে মৃত বলে ঘোষণা দেন। তার বন্ধুরা গভীর দুঃখে মগ্ন হয়ে কাঁদতে থাকে। এক বন্ধু দেভাসের মাকে কেঁদে কেঁদে মোবাইল করে খবরটা জানায়। দেভাসের মা ছেলে মৃত্যুর কথা শুনে কোনো মতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। কেননা তার ছেলে দেভাস কয়েকদিন আগে মাত্র বাড়িতে এসেছিল। দেভাসের বন্ধুরা তার লাশটি এম্বুলেন্সে করে মায়ের কাছ নিয়ে আসে। দেভাসের মা ছেলের মরদেহটি নিজ চোখে দেখে কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারায়। সেই যে জ্ঞান হারালো আর জ্ঞান ফিরলো না।



মানুয়েল চাম্বুগং তরুণ লেখক এবং একজন সেমিনারিয়ান।

মানুয়েল চাম্বুগং

মানুয়েল চাম্বুগং

গারো উত্তরাধিকার আইন এবং পুরুষদের স্বোপার্জিত সম্পত্তি বিষয়ক আইনের বই  ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’

প্রমোদ মানকিন স্মরণে কবি মতেন্দ্র মানখিনের কবিতা

করোনায় পাহাড়ি আদিবাসীদের সংকটময় জীবন যাপন

করোনায় কেমন যাচ্ছে আদিবাসীদের জীবন 

করোনাকালীন তিনটি কবিতা ।। মতেন্দ্র মানখিন

একজন ভালো মনের মানুষ ব্রাদার গিয়োম ।।  কিউবার্ট রেমা

ইকো-ট্যু‌রিজম প্রকল্প বানাম ১৭ কোটি টাকার হিস্যা

গারো ভাষায় জেগে ওঠার গান -হাই আনচিং খ্রেংনা

 




সম্পাদক : মিঠুন রাকসাম

উপদেষ্টা : মতেন্দ্র মানখিন, থিওফিল নকরেক

যোগাযোগ:  ১৯ মণিপুরিপাড়া, সংসদ এভিনিউ ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। 01787161281, 01575090829

thokbirim281@gmail.com

 

থকবিরিমে প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। Copyright 2020 © Thokbirim.com.

Design by Raytahost