Thokbirim | logo

২রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সেকালের জলছত্র ও গারোদের উত্থান।। মোহন লাল দাস

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৯, ২০২৪, ১১:৩৩

সেকালের জলছত্র ও গারোদের উত্থান।। মোহন লাল দাস

সুপ্রিয় পাঠক সবাইকে প্রীতি ও শুভেচ্ছা। আজ থেকে ষাট উর্ধ্ব বৎসর আগের স্মৃতির পাতায় যেগুলি আমি প্রত্যক্ষদর্শি তৎসহ কিছু কিছু তথ্য যাহা আমার শৈশবে বয়স্কদের আলাপচারিতা থেকেও ধরে রাখতে পেরেছি সেগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করবো ।

এখন আমরা ময়মনসিংহগামী পাকা বাস্তা ধরে জলছত্র পর্যন্ত অগ্রসর হবো | চলতে চলতে চাড়ালজানি পার হয়ে কাকরাইদ, বর্তমান ইস্টক নির্মিত কৃষি ফার্মের সোজা উত্তরে পাকা রাস্তার পূর্ব পার্শ্বে তৎকালীন কৃষিফার্ম ছিল।

পাকা রাস্তা অনতিদুরে পূর্ব দিকে বহুদুর বিস্তার করে কৃষি ফার্মের কর্মীদের থাকার জায়গা ও অফিস ছিল। ঘরগুলো ছিল ছনের ছাউনী ও তারাই বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি। খুবই সুসজ্জিত। পাশাপাশি আনারস পেঁপে কলা এ সবের বাগান ছিল। কৃষি ক্ষেতগুলো ছিল আলাদা। ফার্মের উত্তর পার্শ্ব থেকে পূর্ব পশ্চিমে বিস্তার করে গজারী বন | তবে পশ্চিমের তুলনায় পূর্বপার্শ্ব ছিল বৃক্ষবহুল | ঐ সময়ের ফার্ম ঘেঁষে রাস্তার পশ্চিমে ছিল একটি সাধুর আশ্রম | আশ্রমের সম্মুখভাগ মাধবীলতা ও কাগজ ফুলের লতায় সজ্জিত ছিল ।পাশেই একটি মুচি বাড়ি | এ বাড়িটি ৪০/৪৫ বছর আগেও ছিল৷

চলুন আরও উত্তর দিকে যেতে রাস্তার দুপাশে গজারী বন, সামনে ডানপাশে লক্ষ্য করলেই ফরেস্ট অফিস আর উত্তর পাশ ঘেঁষে সোজা পূর্বে মাংগন টেংগনের লাল মাটির পথ। ফরেস্ট অফিস ছিল কাঠের প্ল্যাংক কিং করা যার সামনেই ইন্দারা। পথিক জল খেতো কিন্তু পানি তোলার ব্যবস্থা ছিল খুবই কঠিন কারণ জল তোলার বালতির পরিবর্তে সেখানে দুধের টিন রাখতো। সম্মুখে উত্তর দিকে এগুলো ক্রমশ নজরে পড়বে দুপাশের লাল মাটির ধারগুলি উচ্চতর হচ্ছে। ঐ জায়গাটাকে ধর ধইরা বলতো। ক্রমশ সামনে সমতল পূর্বপার্শ্বে বিক্ষিপ্ত কয়েকটি গারো বাড়ি৷ দুপা এগুতেই জলছত্র ।

জলছত্রে প্রথমে পাওয়া যাবে পাকা রাস্তা ঘেঁষা পশ্চিম পাশে একটি চায়ের দোকান যেটা ‘ভূ্বন গারো’ দোকান বলে পরিচিত ছিলো। দক্ষিণে ও রাস্তার পশ্চিম পার্শ্ব ঘেঁষে সতীশ গারোর বাড়ি (আবশ্য এই বাড়িটি স্থানান্তরিত হয়ে আরও পশ্চিম দক্ষিণে গিয়েছিল । রাস্তার পশ্চিমে কাঁঠাল বাগান তার উত্তর পার্শ্ব ঘেঁষে হিন্দু গারোদের মন্দির। বর্তমানে যেটা হাট । জলছত্রের নাম করণ সম্বন্ধে বয়স্কদের অভিমত ছিলো-পূর্ব্বে পুখুরিয়া পরগনা ধিপতি কোন রাজা বা জমিদার বন পথে পথ যাত্রীদের জন্য বিশ্রাম এবং জল ব্যাবস্থা করেছিলেন বিধায় জলছত্র।

সাংসারেক

সাংসারেক খামলের পূজা ; ছবি থকবিরিম

 

সাংসারেক চিজং নকমার বাড়ির সামনের খিম্মা

খিম্মা ছবি থকবিরিম

এখানকার বসতি সবাই গারো ছিলো।এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে গারো শুধু মাত্র কোন জনজাতি নয় এদের ধর্মও ছিল। সাংসারেক গারো ধর্ম । এরা ছিল প্রকৃতির উপাসক। যেমন বড় কোন গজারী গাছ, খুব উচু মাটির টিলা, বড় আকাবের পাথর ইত্যাদি। বৎসরের বিশেষ একদিনে গারো সম্প্রদায়ের সকলে সমবেত হয়ে পূজা করতো। তাদের বাদ্যযন্ত্র ছিল যেমন আমাদের গরুর চাড়ি ঠিক তদ্রুপ কাঠের তৈরি তার চামরার ছাউনী দেওয়া। এটি বাজানোর অনেক পদ্ধতি ছিল। কোন বাজনা মৃত্যুর মানুষ ডাকা কোনটা বিপদ সংকেত কোনটা জরুরি প্রয়োজনে সমবেত আবার কোনটায় আনন্দের বার্তা এই বাজনা সংকেত ওদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ওদের জমি চাষাবাদ ছিল ভিন্ন। বাঙালিদের মতো লাঙ্গল-জোয়াল এবং গরু দিয়ে হালচাষ করতো না। তবে চৈত্রের শেষে গজারী বনের ঝরা পাতা আগুনে পুড়িয়ে বনভূমি পরিষ্কার করে জোয়ার বাংগী কচু ও জংলা আনারস চাষ করতো। ঐ আনারস গুলি কাটা বহুল এবং গলায় চুলকানির মত ধরতো। তখন পর্যন্ত বর্তমান সিংগাপুরী আনারসের চাষের আবাদ শুরু হয় নাই।

ওয়ানগালায় নাচ

গারো নাচ

গারো নাচ

প্রথম পর্যায়ে সাংসারেক গারোরা মানুষ মরলে মরা লাশ আগুনে পুড়ে ছাই করে, পুড়ে যাওয়া কিছু হাড়, কিছু ছাই তুলে নিয়ে একটি ছোট ঘর তৈরি করে। এই ছোট ঘরের ভেতরে সাদা কাপড়ে বা লাল কাপড়ে দোলনা বেঁধে, সেই দোলনার ভেতরে পোড়া হাড় ও ছাই যত্ন করে রেখে দেয় এটাই দেল্লাং নকথিব বাংলায় ‘আত্মার ঘর’।

প্রথম পর্যায়ে সাংসারেক গারোরা মানুষ মরলে মরা লাশ আগুনে পুড়ে ছাই করে, পুড়ে যাওয়া কিছু হাড়, কিছু ছাই তুলে নিয়ে একটি ছোট ঘর তৈরি করে। এই ছোট ঘরের ভেতরে সাদা কাপড়ে বা লাল কাপড়ে দোলনা বেঁধে, সেই দোলনার ভেতরে পোড়া হাড় ও ছাই যত্ন করে রেখে দেয় এটাই দেল্লাং নকথিব বাংলায় ‘আত্মার ঘর’।

গারোরা ধানের আবাদও করতো কিন্তু পদ্ধতি ছিল ভিন্ন ধরনের। ওরা প্রথমে গজারীর একটি ভাল সোজা ৫ হাত পরিমিত-এর এক প্রান্ত খুব করে চোখা করে নিত এবারে এই চোখা অংশ দিয়ে মাটিতে আঘাত করে সামান্য গর্ত করতো আর এক হাত দিয়ে জোংগা থেকে ধান বের করে গর্তে ফেলতো একই সংগে পায়ের বুড়া আঙুল দিয়ে গর্ত বুজিয়ে দিত । ধানের ছোটা গুলি খুবই মোটা হতো পাকার পর শুধু মাত্র ধানের অগ্রভাগ কেটে ঘরে মজুদ রাখতো প্রয়োজনে এগুলি হাত দিয়ে কচলাইয়া ধান বের করতো।

 

মাছ রাখার খালুই এবং মাল বহনের জোংগানিজ হাতে তৈরি করতো । খালুয়ের আকৃতি ছিল অনেকটা আমাদের জলের কলসির মতো। মাল বহনের জন্য বন থেকে এক প্রকার লতা সংগ্রহ করে সুন্দর করে তৈরি করতো জোংগা। পিছন দিকে হাটুর একটু উপর থেকে মাথার নিচ পর্যন্ত লম্বা ছিলো এই সব জোংগা । এগুলো দেখতে আমাদের ধান রাখার ঢোলের মতো অনেকটা। নিজেরাই এইগুলো বাঁশ দিয়ে তৈরি করতো আবার গজারী গাছের বাকল তুলে পাতলা বেল্ট এর বানিয়ে কপালের সাথে সংযুক্ত করতো।

 

গারোদের বাড়িগুলোতে শুকর পুষতে দেখা যেত। কেউ কেউ ভাত পচিয়ে মদও বানাতো। জীবন জীবিকার জন্য তারা এই মদ বিক্রিও করতো।| শীতের শুরুতে গারো পুরুষেরা বেড়িয়ে পড়তো দূরদূরান্তের বিল ঝিল ডোবা থেকে কচ্ছপ, কাকড়া ও কুইছা ধরতে। কুইছাগুলো দীর্ঘদিন সংগ্রহ করতো। এগুলোকে প্রথমে লম্বালম্বি পেট ফেরে দড়িতে টানিয়ে শুকিয়ে নিতো এবং সময়মতো বর্ষায় খেতো ।

 

ষাটের দশকের দিকেই জলছত্র আসে আমেরিকান সাহেবরা ৷প্রতিষ্ঠা করে মিশন।অভাবী গারোদের সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিল ৷ তখন থেকেই গারোরা সাংসারেক স্বধর্ম ত্যাগ করে খৃষ্ট ধৰ্মগ্রহন করতে লাগলো|

 

এই সময়ে এই এলাকায় গেরোয়া বসনধারী মাথায় জটা এক সন্ন্যাসী উপস্থিত হলো। বর্তমান মন্দির সম্মুখে মুক্ত আকাশের নিচে কাঁঠাল বাগানের প্রান্তে তিনি হিন্দু ধর্মে দীক্ষা দিতে লাগলেন। জলছত্র ও গাছাবাড়ি অনেকেই হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত হলো। শুরু হলো কীর্তনের মহরা। ভক্তরা গড়ে দিল বড় টিনের ঘর যার চারিদিকে ছিলে কাঠের বেড়া। গারোদের নাম কীর্তনের দল মধুপুর নিতাই বাড়ী ধনবাড়ী মুক্তাগাছা নানা স্থানে কীৰ্তন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন কবে।

 

ধর্মীয় আবেগ উৎজীবিত করার মানসে দীক্ষাগুরুর আদেশে প্রতি বছর আষাঢ় মাসের অম্বু বুচিতে অর্থাৎ আমটিতে ৭ দিন ব্যা্পী কীর্ত্তন হতো । এই সময় বাইরে থেকে অনেক ভক্তবৃন্দের সমাবেশ হতো। সকল ভক্তদের সেবা ও বিশ্রামের ব্যাবস্থাতেও তারা খুবই তৎপর থাকতো। ভক্তরাও তাদের দৈন্যতা ও মধুর আচরনে তৃপ্ত থাকতো।

কালক্রমে অন্যান্য হিন্দুদের মতো বাৎসরিক দূর্গা পূজা ও কালী পূজাব ও প্রচলন শুরু হয়।

 

এরা খেলাধূলাতেও খুবই পারদর্শী ছিলো| জলছত্র বাসস্ট্যান্ডের একটু উত্তরে পাকা রাস্তা সংলগ্ন পূর্ব পার্শ্বে বিরাট ফুটবল মাঠ ছিল। ফুটবল খেলার নিয়মিত অনুশীলনের ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাদের একটা শক্তিশালী গারো ফুটবল টিম গড়ে উঠে । ঐ সময়গুলোতে জেলার বিভিন্ন স্থানে আমন্ত্রিত হয়ে এই টিম অংশ গ্রহণ করে বিশেষ প্রসংশা অৰ্জন করে। গারো টীমের নাম শুনে মাঠে দর্শকদেরও ভীর ছিল লক্ষ্য করার মতো ছিলো। পরবর্তীকালে জনৈক হক সাহেব নামে একজন এই এলাকায় বিড়ি পাতার কারখানা করে ।

 

সংগীত চর্চাতেও গারোদের কোন কমতি ছিল না ।প্রতি বছর মিশনের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে এরা যোগদান করতো | মিশন স্কুলের ম্যাডাম রাসঙ্গীতে সুশিক্ষিত বলে অনুমেয় | অপর দিকে ইদিলপুর গ্রামেও সংগীত চর্চার বিশেষ ভূমিকা ছিল | টাংগাইল থেকে সংগীত শিক্ষক এনে তারা তালিম নিত | এই সময়েই মধুপুর কর্মসুত্রে আসে একজন সংগীত শিক্ষক যাকে আমরা ওস্তাদ বাহাজ মিঞা বলতাম | ইদিলপুরের শিল্পী গোষ্ঠীর পিছনে তার অবদান ছিলো অপরিসীম। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর ইদিলপুরের শিল্পী গোষ্ঠি বাংলাদেশ বেতারে গারোদের শাল গীত্তাল নামে এক অনুষ্ঠানে নিয়মিত সঙ্গীত পরিবেশনের সুযোগ পায় | এক্ষেত্রে অনিমেষ মনোতোষ প্রেনতি তাপস ছাড়াও আরও কেউ কেউ এই সফলতার দাবিদার। হিসাবে মাত্র ৬৫ বৎসর আগে এদের সভ্যতা শুরু কিন্তু আজ তারা কত অগ্রসর যে শিক্ষা অনুসরণীয় ।

।। লেখাটি মধুপুরবাসী ফেইসবুক গ্রুপ থেকে সংগৃহীত। থকবিরিম সম্পাদিত।

 




সম্পাদক : মিঠুন রাকসাম

উপদেষ্টা : মতেন্দ্র মানখিন, থিওফিল নকরেক

যোগাযোগ:  ১৯ মণিপুরিপাড়া, সংসদ এভিনিউ ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। 01787161281, 01575090829

thokbirim281@gmail.com

 

থকবিরিমে প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। Copyright 2020 © Thokbirim.com.

Design by Raytahost