Thokbirim | logo

২রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

গারো জাতি সম্পর্কে কিছু জানতে হলে এই বই অনেকটা সহায়ক ।। জেনিস আক্তার

প্রকাশিত : জুলাই ২৫, ২০২০, ১৭:৫১

গারো জাতি সম্পর্কে কিছু জানতে হলে এই বই অনেকটা সহায়ক ।। জেনিস আক্তার

মতেন্দ্র মানখিনের ‘গারোদের লোকায়ত জীবনধারা’ বইটা পড়ে যে কোনো বাঙালি একটা স্পষ্ট ধারনা পাবেন । পুরো ইতিহাস ঐতিহ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরতে না পারলেও সম্যক ধারণায় পুরো ইতিহাস বলে গেছেন ।

বইটা এমন ভাবে লিখেছেন যেন বাঙ্গালিদের জন্য । উৎসর্গ করেছেন ফোকলোর বিজ্ঞানী অধ্যাপক শাসুজ্জামান খানকে । ভূমিকায় কবি ইতিহাস তুলে ধরে বলে গেছেন গারো জাতির আদি কথা ।

গারোদের বাড়ি ঘর এর বর্ণনা এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন উঠান আথালার কথা বলেছেন । ববিল গিন্নাল ( হিংস্র পশুর ) সম্ভাব্য আক্রমন থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য ব্রা( তীর ) সাজিয়ে রাখা হয় । গ্রামে অপদেবতার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য আসংকোশির ( গ্রাম ও জীবন রক্ষক কালকামে দেবতা ) পূজার কথাও উল্লেখ করেছেন । গ্রামে মহামারী দূর করার জন্য ইঁদুর , কুচা, বানর মেরে তার মাংস বাড়ি বাড়ি দরজার কপাটে কিংবা পথে পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়া হয় । কৃষি নির্ভর জীবনযাপনের অন্যবদ্য এক দৃষ্টান্ত গারো সমাজ , জুম চাষ ,পশুপালনের , শিকারের মত আদিম পেশাটাই উঠে এসেছে কথায় কথায় ।

গারো আদিবাসী সম্পর্কিত গ্রন্থ

গারো আদিবাসী সম্পর্কিত গ্রন্থ

কোন গারো শিশু জন্ম নিলেই তার মুখে মদ দেওয়া হয় মধুর পরিবর্তে এবং এই মদ বাচ্চা জন্ম হবার ৪/৫ আগেই এই মদ বানানো হয় যার নাম চু জাংগী ( জীবন মদ ) । বাচ্চা জন্ম নিলে অপদেবতার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ঘরের মাঝখানে অগ্নিকুন্ড ও শিয়রে দুর্গন্ধযুক্ত তুলসীপাতা ও ফানেত পাতা রাখা হয় । কোন বাচ্চা জন্ম নিলে সেই দিন কোন কাজ করা যায় না এবং তাদের খামাল দ্বারা শিশুর নামরকণ করা হয় এমন অদ্ভূত সুন্দর সুন্দর তথ্য উঠে এসেছে ।

তাদের বছরে বার মাসের আলাদা আলাদা নাম ফসলের সাথে সম্পৃক্ত করে ।যেমন গালমাকজা ,( ফেব্রুয়ারী মাস এর অর্ধেক থেকে শুরু ) মেবাকজা ,্সগালজা , জাগাপজা , জামেদকজা , জামেদক জা , মেপাংজা , আনিজা , বেরকজা , কিলকজা , আউইতজা এবং ওয়াচেংজা ।

ঐহিহ্যবাহী সুস্বাদু রান্না ব্রিবেং( সুস্বাদু ভাত ) , মিমিদিম – বাষ্পে রান্না ভাত । উথেপা( কলাপাতায় ) ব্রেং আ ( বাঁশের চোঙায় ) রান্না করা হয় ।

চাল , ভুট্ট্রা , জোয়ার দিয়ে পচুই মদ তৈরী করা হয় , পচুইমদের অমিশ্রিত রসের নাম চুবিচ্চি । আর বাষ্পে তৈরী করা মদের নাম মত্তাং বা সোওয়াচু । এমন অনেক তথ্য এই বইকে সমৃদ্ধ করেছে ।

ওমেদ ও রামখে দিয়েই প্রথম শিক্ষার শুরু হয় এবং সেখান থেকেই গারো জাতি খ্রিস্টান হয়া শুরু করে ১৮৬৩ সালের দিকে ।

তারা বর্তমানে খ্রিস্টান ধর্ম পালন করলেও তারা সাংসারেক ধর্ম পালন করছে অনেকে যাকে Theisn মানে দেবদেবীবাদ এ বিশ্বাসী । তাতারা রাবুগা তাদের দেবতার নাম , আর মিসি সালজং তাদের ফসলের দেবতা ।

জুমাংসিয়া ( স্বপ্নে দেব দেবীর নির্দেশ ) আ আ হোফাতা ( বন জংগল পরিষ্কার করে বসবাস ) , আমুয়া খৃত্তা ( মারা যাবার পরের আচার ) স্থাল ফি আ ( অপদেবতার কুনজর এড়ানোর আচার ) , জরং আ ( জীবন ফিরিয়ে আনা ) মত আচার আচরন ও সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করেন ।

গারোরা সংস্কৃতির দিক থেকে অনেক এগিয়ে সেটা এই বই পরে স্পষ্ট জ্ঞান রাখা যায় । দাকবেওয়াল হচ্ছে তাদের নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে বলে ।দামা , নাগ্রা , খ্রাম , , আদুরু , কাল সহ অনেক বাদ্যযন্ত্রের নাম উল্লেখ করেছেন লেখক ।তেমনি লোক নৃত্য ধারা দখ্রু সুয়া ( ঘুঘু পাখির লড়াই ,) মা ৎ মানা জেং আননা ( মহিষকে ঘাস খাওয়ানো ) , ওপিংরাত্তা ( আগাছা কেটে ফেলা ) এরকম ৪০ ধরনের নাচের কথা উল্লেখ করেছেন সেখানে ।

তাদের পালাগান সেরেজিং – অনবদ্য এক প্রেমের কাহিনী এবং লোক সংগীত রে রে এর কথা উল্লেখ করেছেন । চার ধরনের রে রে এর কথা বলেছেন – ১। রঙের খেলা ( প্রেম বিরহ , আনন্দ , বেদনা , সুখ দুঃখ )২। পিরিতি ( প্রেম ভালোবাসা , আন্তরিকতা ) ৩। রামায়নী(৩০০-৪০০ অব্দের রামায়নের কাহিনী ) ৪। সিমাসা ( ধাধা) কথা সুন্দর ভাবে উল্লেখ করেছেন , অনেকটা গুছিয়ে । যেকেউ পড়ে সহজেই ধারনা নিতে পারবে একটা জাতি সম্পর্কে ।

গারোদের যে প্রচলিত খেলাধুলা সবকটা না চিনলেও কিছু খেলার সাথে পরিচিত। কারন ভৌগোলিক অবস্থান থেকে আমি ছোটকাল কেটেছে আদিবাসীদের খুব কাছের এলাকায় সেজন্য হয়তো চেনা সবই । আপন সবই । খেলাধুলার কথা পড়তে গিয়ে আমার ছোটবেলায় বার বার ফিরে গিয়েছি ।

চু ( মদ ) বানানোর কৌশল ও উপকারিতা অপকারিতা সবই তুলে ধরেছেন । গারোরা ধর্মীয় যেকোন অনুষ্ঠানে চু খেয়ে থাকেন , চু ছাড়া তাদের উৎসব হয় না । গারোরা ভাত মাংস খাওয়াকে প্রাধান্য দেয় না , চু টাকেই সম্মানীয় মনে করে । কেউ যদি কার বাড়ী উপহার হিসেবে চু নিয়ে যায় সেটাই তাদের কাছে সম্মানীয় তাছাড়া কোন দাওয়াতে যদি কেউ চু পরিবেশন না করে সেটাও তাদের জন্য খুবই মানহানিকর ব্যাপার ।

যে চু পরিবেশন করবে তাকেও চু খেতে হয় এবং চু খাওয়ার গ্লাস কখনো খালি করা যায় না যতক্ষন উৎসব চলবে ততক্ষন চু চলতে থাকে ।এমনকি সারা রাত পর্যন্ত চু চলে । চু খাওয়ার আগে মাটিতে ঢেলে নিতে হয় , মাটির দেবতাকে উৎসর্গ করে একে রুগালা বলে।

মাটির দেবতার নাম হা মিদ্দি । অনেক রকমরের চু আছে তার মাঝে লেখক বর্ণনা করেছেন হান্ডি চু , সো আ চু , আলু ও ফলমূল জাতিয় চু ।চুগান , ওয়ানগালা , মিমাংখাম ( শ্রাদ্ধ ) রান্দি মিকচি গালা ( বিধয়ার কান্না ) রঙ চু গালা ,নাখাল চিকা ( মাছ উতসর্গ ) ইত্যাদি পালা পর্বন ছাড়াও শালিস ফসল বপন , রোপন , কর্তন , বিয়ে , গৃহপ্রবেশ ও আমোদ প্রমোদে চু এক মাত্র প্রধান সামগ্রী ।

লেখক এখানে সাংমা ও মারাক এর লোককাহিনি দিয়ে শেষ করেছেন । শক্তিতে বড় নাকি বুদ্ধিতে বড় এই সব নিয়েই লোককাহিনি ।সাংমারা বুদ্ধিতে বেশী চালু আর মারাকেরা শক্তিতে চালু এমন অদ্ভূত সুন্দর সুন্দর লোককাহিনী প্রচলিত আছে যা বইএ লিপিবদ্ধ । তাছাড়া মরিবিদু নামের এক লতানো গাছের লোক কাহিনিও লিপিবদ্ধ করেছেন । গান্দো , গান্না , রিখিং , খোপিং , জাগিসিম , মারাং , দকমান্দা এসব পোশক পরিচ্ছদ সুন্দর ভাবে বর্ননা করেছেন বই এ ।

মোট কথা গারোদের সম্পর্কে কিছু জানতে হলে এই বই অনেকটা সহায়ক তবে একটা জাতিকে জানতে হলে বুঝতে হলে কাছে গিয়ে এমশার বিকল্প শুধু বই হতে পারে না ।

বইটি প্রকাশ করেছে থকবিরিম প্রকাশনী। প্রচ্ছদ করেছেন নির্ঝর নৈঃশব্দ্য।

আরো লেখা

শিল্পসৌন্দর্যের স্নিগ্ধতম অনুভূতি ‘ঊমাচরণ কর্ম্মকার ’ ।। মাহতাব শফি

পালাগান সেরেজিং ।। গারো সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী পালাগান।। শেষ পর্ব।।মতেন্দ্র মানখিন

চু ।। গারো সম্প্রদায়ের প্রধান পানীয় ।। মতেন্দ্র মানখিন

ফং ।। গারো সম্প্রদায়ের বিশেষ পানীয় চু ‘র ব্যবহার পাত্র

চু জাঙ্গি ।। গারো সম্প্রদায়ের প্রধান পানীয়




সম্পাদক : মিঠুন রাকসাম

উপদেষ্টা : মতেন্দ্র মানখিন, থিওফিল নকরেক

যোগাযোগ:  ১৯ মণিপুরিপাড়া, সংসদ এভিনিউ ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। 01787161281, 01575090829

thokbirim281@gmail.com

 

থকবিরিমে প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। Copyright 2020 © Thokbirim.com.

Design by Raytahost