Thokbirim | logo

১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সাংসারেক ওয়ান্না, গোড়ামী আর উপসাংসারেক-এর গল্প

প্রকাশিত : এপ্রিল ১২, ২০২৪, ১২:৫৫

সাংসারেক ওয়ান্না, গোড়ামী আর উপসাংসারেক-এর গল্প

আমার ধারণা-মিদ্দি রাবুগা, সালজং আমার উপর অধিক খুশি হয়ে বর দিলেন বলেই- আমি ঢাকা শহরে তিনদিন ধরে নিয়ম মেনে সাংসারেক ওয়ান্না করার ঘোষণা দিতে পেরেছিলাম। বর না দিলে কীভাবে আমি ঘোষণা দিতে পারি বলেন তো উপসাংসারেকগণ? আমার কী সেই ক্ষমতা আছে? যেহেতু আমি একজন খ্রিস্টান, আর ঘরে রয়েছে একজন যাজক! আমি নিজেকে সাংসারেক দাবি করি না, সেই সাহস বা শক্তি কিংবা জ্ঞান কোনোটাই আমার নাই। আমি শুধু গারো সংস্কৃতিকে ধারণ করার চেষ্টা করি-এই যা!

সাংসারেক ওয়ান্না ঘোষণার পর মহামুসকিল হলো। যারা নিজেদের সাংসারেক দাবি করে তারা দলে দলে বলতে শুরু করলো- এ হতে পারে না! মিঠুন রাকসাম তিনদিন ওয়ান্না করতে পারে না।  সে তো ওয়ান্না নিয়ে ব্যবসা শুরু করে দিলো! এদের মধ্যে ধুরন্ধর বদমাইশ টাইপের কেউ বলল- দু.দক্কার কুফল। আরেক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী লেখক নামধারী ব্যবসায়ী সেও ঘটে যা মাল ছিলো তা ঢেলে মদদ দিলো। ফেসবুকে কেঁদেকুঁদে ভাসিয়ে দিলো-আহা… মনে হবে সাংসারেক ওয়ান্না তাদের মা-বাবার পৈত্রিক সম্পত্তি-তারা ছাড়া কেউ করতে পারবে না সাংসারেক ওয়ান্না! তাদের কপালে স্বয়ং রাবুগা সিল মেরে দিয়েছে!

আহারে…. সাংসারেক মান্দিরা কোন জন্মে এমন গোড়া ছিলো গবেষণা জরুরি। অন্তত খামাল জনিক নকরেক-এই শিক্ষা দিয়ে যাননি , আমি নিশ্চিত হলপ করে বলতে পারি।

তারপর কী হলো? সবাই লাফাতে শুরু করলো। কেউ কেউ তো স্ট্যাটাসও দিলো। আহা উহু করলো। যেন-ওয়ান্না, সাংসারেক বাপের সম্পত্তি। ঢাকা শহরে কেন করবে? তিনদিন ধরে চু খাবে? এটা সম্ভব? কেউ জায়গা দিবে? চু খেয়ে মরে গেলে এর দ্বায় কে নিবে?? একজন তো বলল-কর্তৃপক্ষ জায়গা দিলেও আমিই দিবো না…ভাবি-দৈন্যতার কী ভয়াবহ প্রকাশ!

চু গারোদের প্রধান পানীয় এবং সাংসারেক ধর্মে প্রার্থনার গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। তার অর্থ কি এই- সাংসারেক মান্দিরা তিনদিন ধরে ওয়ান্নার নামে শুধু চু-ই খেয়ে থাকে? আর ঢাকা শহরে তিনদিন ধরে ওয়ান্না করে মানুষজন শুধু চু-ই খাবে? ওয়ান্নার পূজা অর্চনা কিংবা ওয়ান্নাকে ঘিরে যে রিচুয়াল অনুষ্ঠান, আজিয়া গোরেরুয়া চাম্বিলমেসা গ্রিকা সেইগুলো কোথায় যাবে? কখন করবে? কে করবে? কারা করবে? মনে প্রশ্ন আসে না? নাকি মাথায় শুধু চু-আর চু গিজ গিজ করছে? নাকি চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে? আরেকজন বলে দেবে বা ব্যাখা দিবে তারপর বুঝবে বা মগজে ঢুকবে? চু-কে শুধু প্রার্থনার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেও তিনদিন ওয়ান্নার আয়োজন করা যায়? যায় কি? প্রশ্ন করা যায় না?

এদিকে নব্য গোড়া সাংসারেকরা- এসেছে খড়গ হাতে। তারা এতো গোড়া যে, ঢাকা শহরে কোনোভাবেই তিনদিন সাংসারেক ওয়ান্না মেনে নিতে পারছে না। আচরণ, কথায়-লেখায় বুঝাতে চায়- ওটা তাদের বাপ দাদার সম্পত্তি। দুর্বলরা কর্মে না পেলে ব্যক্তিআক্রমনে যায় (আঘাতও করে বসে কখনও সখনো) সেটা রূঢ়ভাবে প্রকাশ পেলো যখন দেখলাম-আমার দু.দক্কা নিয়ে বাজে মন্তব্য করে আমাকেসহ যিনি সেই সময়ে ওয়ানগালার নকমা ছিলেন, যারা আয়োজক ছিলেন, খামাল ছিলেন তাদেরকে অপমান করা শুরু করলো। ভুল ভুল’ বলে সবাইকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালো। এটা আবার সবাই মজা করে নিলো কিন্তু আয়োজক কমিটিকে যে ধুয়ে দিলো- অতিরিক্ত চু খাওয়ার ভাবনায় বুঝতে পারলো না। আগেই বলেছি-মগজ ভরতি চু নয়তো চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে।

আমি যে সাংসারেক ওয়ান্না করার ঘোষণা দিলাম- এটার ফল নাকি ওয়ানগালায় ভুল মন্ত্র পড়ে বিয়ে!

কতটা বোকাধুরন্দর(জাদাসেংআ) হলে এটা বলে যে- দু.দক্কার ফলে ওয়ান্না করার ঘোষণা দিয়েছি।

একবার ভাবুন তো-

আমি যদি বলি, দু.দক্কার(২০১৩) জন্যেই খুশি হয়ে মিদ্দিরা আমাকে বলেছেন-ঢাকা শহরে তিনদিন ধরে প্রকৃত সাংসারেক ওয়ান্না করতে হবে। তাহলে প্রকৃত সাংসারেকগণ কী বলবেন?

তিনদিন ধরে ওয়ান্না করতে চাওয়া- এটা দুদক্কার ফল মানে তো সাংসারেকদের জন্য পোয়া বারো, নয়কি? এটা সাংসারেক ধর্মের জন্য সুফল না কুফল? এতে প্রকৃত সাংসারেকদের খুশি হবার কথা! আনন্দে ধেই ধেই করে নাচার কথা! অবশ্য যারা প্রকৃত সাংসারেক মনে মনে ধারণ করেন তারা ঠিকই করতে বলেছেন, খুশি হয়েছেন, পরামর্শ দিতে শুরু করেছেন। গ্রাম থেকে খামাল তো ঢাকা শহরে তিনদিন ওয়ান্নার কথা শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছেন। বলেছেন- ঢাকা শহরে ওয়ানগালা করলেও-তুমিই একমাত্র তিনদিন সাংসারেক ওয়ান্না করতে চাইতাসো, খুশির খবর, তাতারা-সালজং মিদ্দিনা রাসং। আমি যাবো।

কিন্তু ভেকধারী নব্য উপসাংসারেক শিয়ালেরা হুক্কাহুয়া করে, কেঁদেকুঁতে ভাসিয়ে দিলো! জাত গেলো জাত গেলো বলে-ওয়ান্না বিক্রি করলো’ বলে চেঁচিয়ে কূল পেলো না। আহারে… কী আবেগ… হাসবো না কাঁদবো নিজেরাই বুঝতে পারছিলাম না!

সাংসারেক ধর্ম কী এতোই সহজ আর ঠুনকো ঢাকা শহরে তিনদিন ওয়ান্না করলেই নষ্ট হয়ে যাবে! শেষ হয়ে যাবে? বিকৃত হয়ে যাবে? গ্রামে যে শুধু একদিন করে তখন কিছু হয় না? বা কোথাও তো সাংসারেক ওয়ান্না করে না তখন কিছু হয় না? মনে লাগে না? নাকি করতে চাওয়াতেই দোষ? তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে না যে- নব্য উপসাংসারেকদেরই কুমতলব আছে? তারাই শুধু করবে বাকিরা করতে পারবে না কেন? কী তাদের উদ্দেশ্য? কেন তারা সাংসারেক ওয়ান্নাকে নিজেদের বলে দাবি করছে? এই প্রশ্ন কি করেছেন কোনো দিন? বা সমগ্র গারোরা কেন নিয়ম রীতি মেনে সাংসারেক ওয়ান্না করছে না? সমগ্র গারো জাতির প্রধান উৎসব ওয়ান্না। খ্রিষ্টান তো শুধু ধর্ম। জাতিতে গারো। গারো জাতি হিসেবে তাদের যে সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আছে রিচুয়াল আছে উৎসব আছে, সেইগুলো কেন তারা করে না? কিংবা গারোরা কেন সাংসারেক ওয়ান্না করতে পারবে না? বা করছে না? এই প্রশ্ন করেছেন কোনোদিন? গারোরা খ্রিস্টান হয়ে গেছে বলে প্রপগান্ডা চালিয়ে কী প্রমাণ করতে চায়? খ্রিস্টানের সাথে ওয়ান্না বা ওয়ানগালার কী সংঘর্ষ? তাহলে গারো জাতির নিজস্ব জাতিত্ববোধ গেলো কোথায়? তাদের নিজস্ব আচার রীতি রেওয়াজ গেলো কোথায়?

আচ্ছা-সাংসারেক ওয়ান্না কারো বাপ দাদার সম্পত্তি যে ঢাকা শহরে তিনদিন করা যাবে না? শুধু ঢাকা নয় যে কোনো স্থানে যে কোনো দেশে করা যাবে না?

খামাল জনিক নকরেক বেঁচে থাকলে এইসব গোড়ামীর জন্য নিশ্চয়ই লজ্জা পেতেন! দুঃখ তো বটে। খামাল জনিক নকরেক যদি এতোটাই কঠোর-কঠিন বা বিধিনিষেধের আড়ালে থাকতেন আজকে পুরো দুনিয়ার মানুষ অন্তত পুরো বাংলার মানুষ অবশ্যই সংস্কৃতিমনা তাদের কাছে সাংসারেক ধর্ম-সাংসারেক ওয়ান্না বা ওয়ানগালা এতো প্রচার প্রসার হতো না। জীবিতকালে তিনি যেভাবে জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন, মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন, মিডিয়া কাভারেজ পেয়েছেন  সাংসারেক মান্দিদের মিডিয়া কাভারেক করেছেন, সাংসারেক ধর্ম নিয়ে আচার রীতি নিয়ে অনুষ্ঠান নিয়ে কঠোরতা করলে কোনোদিনই সেই প্রচার কিংবা মানুষের কাছে পৌছাতে পারতেন না, এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি।

বর্তমানে বাংলাদেশে যারা নিজেদের সাংসারেক দাবি করে, স্বঘোষিত, তাদের বেশির ভাগ (খামালসহ দু একজন সাংসারেক তাদের শ্রদ্ধা রেখেই বলছি- বাকিরা তো জন্মসূত্রেই খ্রিস্টান) আসলে না সাংসারেক না খ্রিস্টান (প্রকৃতপক্ষে তারা কাগজে কলমে খ্রিস্টান, নয় কি? যদি খ্রিস্টান না-ই হয় তাহলে তাদের স্কুল কলেজের  কাগজ পত্রে কোন ধর্ম লেখা? প্রকাশ্যে জানান দিক সবাই দেখে প্রশান্তি লাভ করি) সাংসারেক খ্রিস্টানের মিশেলে জন্মনেয়া উপসাংসারেক মান্দি (উপজাতির মতো কিছু একটা) আসলে তারা এখনও না সাংসারেক না খ্রিস্টান ঠিক দোদুল্যমান স্থানে অবস্থান করছে। দেখতে সাংসারেক মনে হতে পারে কিন্তু সাংসারেক না। তাদেরকে বেশি জোর উপসাংসারেক বলা যেতে পারে। সাংসারেক হওয়া এতো সোজা কিংবা সহজ না। সাংসারেকদের জীবনাচারণ, যাপিত জীবন বড়ই কঠিন, বড়ই সাধনার। তা-না হলে গারো অঞ্চলে খ্রিস্টান বানাতে এতো কাঠখড় পোড়াতে হতো না খ্রিস্টান পাদ্রীদের, মিশনারিদের। মুখে বুলি আওড়ালেই সাংসারেক হওয়া যায় না।

নিজেকে সাংসারেক দাবি করা এই উপসাংসারেকগণ -আমার সাংসারেক, আমি সাংসারেক ‘ দাবি করার আগে সাংসারেক ধর্ম কী-তাদের নীতি-আদর্শ কী, শিক্ষা কী, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কী সেই জ্ঞান রপ্ত করা জরুরি। বিশেষ করে কেউ যদি নিজেকে খামাল কিংবা সাংসারেক নকমা হিসেবে দাবি করে। আর তা না হলে একদিন এই খ্রিস্টান নামধারী গারোদের কাছেই হাসির পাত্র হতে হবে। সাংসারেক জ্ঞান পৃথিবী থেকে হারিয়ে না গেলেও দূরের শোনা গল্প হয়ে যাবে।

প্রকৃত  সাংসারেক ধর্ম যারা লালন-পালন করেন, মনে ধারণ করেন তারা প্রকৃতির কথা বলেন, প্রকৃতির সাথে মিশে যাবার কথা বলেন, প্রকৃতি জ্ঞানের কথা বলেন। তাদের ভেতর ধর্মীয় গোড়ামী আছে কিনা জানা নেই যেহেতু লিখিত কোনো গ্রন্থ বা সাংসারেক বাইবেল নেই। আছে কি? সাংসারেক ধর্মে আত্মঅহম, আমিত্ব কিংবা পণ্ডিতির জায়গা কোথায় সেই গূঢ়রহস্য আগে সন্ধান করা জরুরি। খামাল জনিক নকরেক বলতেন- সাংসারেক ধর্মে যে কেউ আসতে পারে আবার যেতেও পারে কোনো বাঁধা নিষেধ নাই। বনে যেমন নানা ধরনের গাছপালা থাকে তেমনি সাংসারেক ধর্মেও নানা ধরনের মানুষ থাকতে পারে, আসতে পারে যেতে পারে।

জয় হোক সাংসারেক ধর্মের, জয়হোক সাংসারেক ওয়ান্নাসহ যাবতীয় রিচুয়াল উৎসবসমূহের।

।। মিঠুন রাকসাম




সম্পাদক : মিঠুন রাকসাম

উপদেষ্টা : মতেন্দ্র মানখিন, থিওফিল নকরেক

যোগাযোগ:  ১৯ মণিপুরিপাড়া, সংসদ এভিনিউ ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। 01787161281, 01575090829

thokbirim281@gmail.com

 

থকবিরিমে প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। Copyright 2020 © Thokbirim.com.

Design by Raytahost