Thokbirim | logo

১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

যারা লিখতে আসে তারা যা লিখবে তা যেন জেনে বুঝে লিখে-মণীন্দ্রনাথ মারাক

প্রকাশিত : জুন ০৯, ২০২৩, ১৫:৪০

যারা লিখতে আসে তারা যা লিখবে তা যেন জেনে বুঝে লিখে-মণীন্দ্রনাথ মারাক

মণীন্দ্রনাথ মারাক গারো জনগোষ্ঠীর বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক। গারোদের ইতিহাস, কৃষ্টি, সংস্কৃতি সম্পর্কে গভীর পাণ্ডিত্যের জন্যে যে কজনের নাম উল্লেখ করা যায় তাদের মধ্যে মণীন্দ্রনাথ মারাক অন্যতম। তিনি জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে নেত্রকোণা জেলার সুসং দূর্গাপুর থানাধীন হরিয়ন গ্রামে। তিনি আনন্দমোহন কলেজ থেকে ১৯৬০ সালে আই.এ এবং ১৯৬২ সালে বি.এ পাশ করেন। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বি.এড এবং ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে এ.এড পাশ করেন। মণীন্দ্রনাথ মারাক ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে বিরিশিরি প্রাইমারি ট্রেনিং ইন্সটিটিউটের সুপারিন্টেনডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন এবং পূর্ণকার্যকাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি অবসর সময় কাটাচ্ছেন। মাঝে মাঝে নিজের লেখালেখি সম্পাদনা করার চেষ্টা করেন এবং বিভিন্ন শিক্ষা সেমিনারে আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। থকবিরিম পাঠকদের জন্য মণীন্দ্রনাথ মারাকের সাক্ষাৎকারটি আপ করা হলো।

মিঠুন রাকসাম: স্যার, আপনি কেমন আছেন?
মণীন্দ্রনাথ মারাক : এই যাচ্ছে দিন। বয়স হয়ে যাচ্ছে…ঠিকমত কাজ করতে পারছি না।
মি.রা : স্যার আপনার সাথে কিছুক্ষণ আলাপ করতে চাই, আপনি সময় দিতে পারবেন?
ম.ম : পারব না কেন? পারবো, আসো বসো।
মি.রা: ধন্যবাদ স্যার। তাহলে আমরা শুরু করি…
ম.ম: কী…?
মি.রা: না…. এই আলাপ….
ম.ম: ওও…আচ্ছা, শুরু করো… সমস্যা নাই!
মি.রা: স্যার বর্তমান সময়ে পিতা-মাতারা তাদের সন্তানদের নাম রাখে বাংলায়, কেউ কেউ ইংরেজিতেও রাখে, এই সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?
ম.ম : আমি কিন্তু আমার সব ছেলে-মেয়ে এমনকি নাতির নামও গারো ভাষায় রেখেছি। তবে এটার কারণও আছে, এটার কারণ হচ্ছে কালচারের গুরুত্বকে না বোঝা, ঠিকমত মূল্যায়ন করতে না পারা। এর ফলে কালচারাল বিভ্রাট বা ফ্রাসট্রেসন মানে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে তারা এই নামগুলো রাখে।

মণীন্দ্রনাথ মারাক

মণীন্দ্রনাথ মারাক

মি.রা: তারপর আমাদের ভাষায়ও তো আমরা প্রায় কথা বলিই না? খুব কম কথা বলি মানে কম ব্যবহার হচ্ছে, এটাকে আপনি কী মনে করেন?
ম.ম: নিজেদের নিজস্ব ভাষাটা আমাদের ব্যবহার করতে হবে, চর্চা করতে হবে। আর এটা শুরু করতে হবে বাড়ি থেকেই। বাড়িই হচ্ছে আদিস্কুল। তোমার বাড়ি, বাড়ির আশপাশ এইসবই হচ্ছে তোমার আদিস্কুল। বাড়িতে আচিক ভাষায় কথা না বললে, তারা যদি বাড়িতে এইভাষা না শুনতে পায় তাহলে তারা কোথা থেকে শুনবে আর কোথা থেকে শিখবে? ভাষা শিক্ষার মূলমন্ত্র হলো চারটি। লিসেনিং এন্ড আন্ডারস্ট্যান্টডিং, তুমি শুনবে তবেই শিখবে, স্পিকিং, তোমাকেও বলতে হবে তারপর রিডিং। এইগুলো রপ্ত করতে হবে। আরো আছে, আমরা সবাই মিলে একসাথে থাকি না। এইখানে এক বাড়ি, ঐখানে আরেক বাড়ি এইভাবে আমরা বসবাস করি। আর আমাদের বাড়ির আশপাশে মুসলমানরা এসে বাস করছে। সকাল হলেই ছেলে-মেয়েরা তাদের সাথে মিশছে, তাদের সাথে খেলছে, তাদের ভাষা শুনছে, শিখছে এই অবস্থায় কীভাবে তোমার ভাষার উন্নতি হবে? তারজন্যে গারোরা যেখানে থাকবে একসাথে থাকতে হবে এটা শুধু ভাষার জন্য না নিরাপত্তার জন্যও দরকার একসাথে থাকা।

মণীন্দ্রনাথ মারাক

মণীন্দ্রনাথ মারাক

মি.রা : অনেকে মনে করে গারোদের মাতৃতান্ত্রিক প্রথার জন্যে আমাদের ক্ষতি হচ্ছে, এই সম্পর্কে আপনি কী মনে করেন?
ম.ম : আংশিক ক্ষতি বা দায়ী পুরাপুরি দায়ী না। কেন? এটার ব্যাখা হইলো এই হাজং, কোচ, বানাই, ডালু এরা তো পিতৃতান্ত্রিক, এরা তো রক্ষা করতে পারছে না। কেন পারতেছে না বলো?
মি.রা : ওদেরও অনেক টাকা-পয়সা ছিল, ধন-সম্পদ ছিল।
ম.ম : ছিল।
মি.রা: কিন্তু বর্তমানে তো দেখা যাচ্ছে যে, গারোদের চেয়েও তাদের অবস্থা শোচনীয়
ম.ম : আমাদের চেয়েও খারাপ। এরজন্য মাতৃতান্ত্রিই একমাত্র কারণ নয়। তবে একটা কারণ কিন্তু একমাত্র কারণ নয়। এটা আমি কেন বলতাসি? কারণ রাজনৈতি পরিবেশও আমাদের অনুকূলে নাই। এই যে দ্বি-জাতি তত্বে দেশ ভাগ হয়সে, এই দ্বি-জাতি তত্বের জন্যেই আমাদের এই পরিণতি! এইখানে মুসলমান ছাড়া থাকতে পারবে না, ইন্ডিয়াতে হিন্দু ছাড়া থাকতে পারবে না। এই যে মনোবৃত্তি, সেই দেশ স্বাধীন হইবার আগে থেকেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গা চলে আসতাছে, এখনও চলতাসে।
মি.রা : ১৯৬৪ সালে অনেক গারোদের ব্রাশ ফায়ার করে মারা হয়েছিল?
ম.ম : হ, করেছিল। এই যে রাজনৈতিক পরিবেশ, রাজনৈতিক পরিবর্তন এরজন্য দায়ী।
মি.রা : আমাদের বর্ণমালা মানে থকবিরিম নিয়ে যদি একটু বলেন। আপনারা তো এই বিষয় নিয়ে অনেক কথা বলেছেন, অনেক কাজ করেছেন? সমস্যাটা কোথায় ছিলো?
ম.ম : আচ্ছা, বলবো।

মণীন্দ্রনাথ মারাক

মণীন্দ্রনাথ মারাক

মি.রা: কেন আমরা এখন পর্যন্ত বর্ণমালা করতে পারলাম না? আপনাদের মত লোকজন থাকতে…
ম.ম : আচ্ছা, এই যে কেন করতে পারলাম না….আগে আছে, যারা আসবার সময় রাস্তায় নাকি দুর্ভিক্ষ দেখা দিসিল, ঐ দুর্ভিক্ষ দেখা দেবার সময়ে খাদ্যাভাবে ঐ পশুর চামড়ায় নাকি এগুলা (বর্ণমালা) লেখাজুখা ছিল, ওটা নাকি পুড়িয়া খায়সে, সিদ্ধ করিয়া খায়সে, এইরকম করিয়া কথা কয়।
মি.রা: এটা তো বর্তমান সময়ে এক প্রকার লোককাহিনি হয়ে গেছে?
ম.ম : হুম, এটা লোককাহিনি। এবং এইটা আছে। কিন্তু যারা বুদ্ধিজীবী এটা তারা বিশ্বাস করে না। কারণ সব আদিবাসীই কয় তাদের অমুক পাতায় লেখা ছিল, গরু খায়সে, অমুক পাতায় লেখা ছিল আগুনে পুড়সে ইত্যাদি। আসলে আদিবাসীদের এইসব ছিল না। মুখের ভাষা ছিল। ভাষা তো লেখাজুখাই না, মৌখিকভাবেই চলে এসেছে।
মি.রা: বংশ থেকে বংশে ক্রমান্বয়ে। মানে পুরুষানুক্রমে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে
ম.ম :হু, এইভাবে….তো এটার জন্য রিসেন্টলি চার-পাঁচজনে তারা বর্ণমালা লিখসে। এই বর্ণমালা একাডেমিতেও আছে কিন্তু এটা নিয়ে আলোচনা এখনও কেউ করে নাই আর এটা গুরুত্ব দিয়েও চিন্তা করে নাই। কারণ এখন সবাই রোমান হরফ ব্যবহার করতাসে। এবং গারো হিলসে গারোরা অনেক এগিয়ে গেসেগা। এরা পিছিয়ে আর দুষি দিতাসে না। এখন প্রশ্ন তুলতাসে তারা এক রকম চলবে আর আমরা কী আরেক রকম চলবো? না তাদের সাতে সামঞ্জস্য বেলেন্স রেকে চলব।? এই সমস্ত চিন্তা ভাবনার জন্য মানে এখনও এইভাবেই রইসে!
মি.রা: আমরা ধর্মান্তরিত হয়ে গেছি তাই না?
ম.ম: হুম

মণীন্দ্রনাথ মারাক

মণীন্দ্রনাথ মারাকের সাথে মিঠুন রাকসাম

মি.রা : ধর্মান্তরিত হবার ফলে আমাদের কোনো সুবিধা হয়েছে? কিংবা ক্ষতি হয়েছে?
ম.ম: সব কিছুরই সুবিধা অসুবিধা আছে। ভাল দিক-মন্দ দিক আছে। আচ্ছা…মন্দ দিকটাই আমি বলি। আগে ম দংআ আবেং, আত্তং, আওয়ে, চিসাক, চিবক, রুগা, রুগা মাচ্চি, মেগাম এই যে গ্রুপগুলো ছিল, দলগুলো ছিল এদের মধ্যে পরস্পরের মধ্যে মিল ছিল মানে একগোত্রের সাথে আরেক গোত্রের মিল ছিল, দ্বন্দ্ব ছিল। এখন খ্রিষ্টান হয়েও এটাই আছে । আগে যে ডিবাইট ছিলাম এখন সেই ডিবাইট রয়েই গেছে। ব্যাপ্টিস্ট, ক্যাথলিক, চার্চ অব ইংল্যান্ড ছিল চার্চ অব বাংলাদেশ ফেলোশিপ চার্চ, ক্রাইস্ট চার্চ, এই যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমরা বিভক্ত হয়ে গেছি। এবং যারা প্রচার করছে মিশনারিরাও প্রতিযোগিতা করে করছে। এখন ন্যাশনাল লিডার যদি গড়ে না ওঠে, আমাকে জলছত্রে যুব সেমিনারে জিজ্ঞেস করেছিল, গারো হয়ে কেন গরোরা গির্জা করতে পারে না? আমার অভিমত কী?
মি.রা : ধর্ম আলাদা হয়ে যায় যেমন কেউ চর্চ অব বাংলাদেশের আবার কেউ হচ্ছে ক্যাথলিক চর্চের ।
ম.ম : আমি বলেছি তোমাদের মধ্যে জাতি সম্পর্কে চেতনাবোধ আছে। স্বাজাত্যবোধ আছে তার জন্যে তোমরা সবখানেই এই প্রশ্ন করো। এই বোধ তোমাদের না থাকলে এই প্রশ্ন তোমরা আমাকে করতে না। তার জন্যে তোমাদের আমি ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু কেন এমন হলো? হবার কারণে আমরা মান্দিরা এক চার্চের মেয়ে অন্য চার্চের ছেলেকে বিয়ে করতে পারছে না! কারণ ধর্ম যাজকরা এইভাবে শিক্ষা দিচ্ছে!
মি.রা : আপনার লিখতে আসার গল্পটা শুনতে চাই, মানে আপনি কীভাবে লিখতে আসলেন?
ম.ম : হে হে (হাসি) তাহলে তোমাকে দেখাতে হয়।( মণীন্দ্রনাথ মারাক ঘরের ভেতর গিয়ে পুরনো কাগজপত্র আনলেন আর আমাকে দেকাতে শুরু করলেন)
মি.রা : আপনার সময়ে কারা কারা লিখত?
ম.ম : মারিয়া চিরান, বিনোদ মান্দা, গাবরিয়েল রাংসা, বিভা সাংমা, ক্লেমেন্ট রিছিল। ১৯৭৬ সালে আমার লেখা শুরু হয়।
মি.রা : আপনি যাদের নাম বললেন আপনার সময়ে তারা লিখতো?
ম.ম : হুম।
মি.রা : বর্তমানে এরা কি সবাই লিখে?
ম.ম : না বিভা সাংমা মারা গেছে, ক্লেমেন্ট রিছিলও মারা গেছে। আর আমাকে ফরমায়াসে লিখতে হয়েছে। এভাবেই ১৯৭৬ সালে আমার লেখা শুরু হয়।
মি.রা: সুভাষ জেংচাম যেভাবে লিখেছেন সেভাবে আপনি লিখেননি?
ম.ম : না সেভাবে আমি লিখিনি
মি.রা: তরুণ, যারা লিখতে আসছে তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
ম.ম : আমাদের যে গারো আইন সেগুলি এনালাইসিস করে লিখতে হবে। ভাল দিক, খারাপ দিকগুলো লিখুক। যাতে বুদ্ধিজীবী মহলের নজরে আসে। এভাবে না করলে তো রিফরমেশন আসবে না। রিফরমেশনের জন্য ভালও দেখাতে হবে, খারাপ দিকও দেখাতে হবে। আর সমাজের যে নিয়মগুলো আছে সেগুলো ভালও দেখাতে হবে (লিখতে হবে) আবার খারাপটাও দেখাতে হবে (লিখতে হবে)। যেমন শরৎচন্দ্র। শরৎচন্দ্র যখন লিখতে শুরু করে তখন একদিন তার প্রাইমারি শিক্ষকের সাথে রাস্তায় দেখা। তখন শিক্ষক নাকি তাঁকে বলেছে, তুমি নাকি লিখছো? তখন শরৎচন্দ্র নাকি বলেছেন জি স্যার আপনাদের আর্শিবাদে আমি একটু একটু লিখছি। তখন স্যার নাকি শরৎচন্দ্রকে বলেছেন-শরৎ তুমি যা জানো তাই লিখো আর তুমি যা জানো না তা নিয়ে লিখো না। তার শিক্ষকের কথা সে মনে রেখেছে। এইভাবে শরৎচন্দ্র অনেক উপন্যাস লিখেছে, গল্প লিখেছে। আমি বলব যারা লিখতে আসছে তারা যা লিখবে তা যেন জেনে বুঝে লিখতে আসে!

# লেখকের ছবি : থকবিরিম অ্যালবাম হতে সংগৃহীত




সম্পাদক : মিঠুন রাকসাম

উপদেষ্টা : মতেন্দ্র মানখিন, থিওফিল নকরেক

যোগাযোগ:  ১৯ মণিপুরিপাড়া, সংসদ এভিনিউ ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। 01787161281, 01575090829

thokbirim281@gmail.com

 

থকবিরিমে প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। Copyright 2020 © Thokbirim.com.

Design by Raytahost