প্রাচীনকালে মনুষ্য জাতি বন-আলু, কচু, গাছের ফল-মূল, লতাপাতা খেয়ে জীবন ধারণ করতো। ধান, জোয়ার, ভূট্টা ইত্যাদি খাদ্যশস্য মানুষের নিকট অপ্সাত ছিলো। এরূপ বন-আলু, কচু, ফল-মূল ভোজী জগতে একটি লোকের নাম ছিলো ‘আ’নি আপিলপা চিনি গালাপা’।
তৎকালে পৃথিবীতে ধন-সম্পদ, মণি-মানিকা, খাদ্যশস্য প্রভৃতি একটি বিরাটকায় বৃক্ষ ছিলো। এর নাম ছিলো ‘গিসিল বল গিতল বল রিকগে সামল আপাং মনল’। এই বিরাটকায় বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা চারদিকে বহুদূর পর্যন্ত ছিলো। এর অবস্থান ছিলো ‘সিলচি রিংরেরাম গিতল টিংটিংরাম দকাৎচি নাংরোরাম রিকগিত্তক নাংসৎরাম মাৎমা অংকুরুরাম কিৎমা বালগিতরাম মৎমা দাংতরাম মাৎচু কিনমা অনরাম উদারে জাকব্রি মেগংমা কলাৎচি’ দেশে ‘গিতিং দিংএ রানে দিংজের আজারেক চিজাংপা নামক এক সুন্দর বাগানে। ঐ বৃক্ষের একটি শাখায় ধান ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের প্রচুর ফল ছিলো। মানুষ তো দূরের কথা, দেবতারাও তা আহরণ করতে পারতেন না। একদিন বায়ু দেবতা ‘জারু মে আ জাবাল পান্থে অক্কুয়াংসি জাপাৎ চং সি’ ঐ সব খাদ্যশস্যের বীজ পাবার জন্যে ঝড় ও শিলা বৃষ্টির দেবতা ‘মিক্কা টেম্মা স্টিল রংমা’র সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। আর তার সহায়তায় ঐ বৃক্ষে ভীষণ জোরে নাড়া দেন। তাতে ধান ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের বীজ মাটিতে পড়ে যায়। কিন্তু বায়ু দেবতা ‘জারু মে অ জাবাল পান্থে অক্কুয়াংসি জাপাৎ চং সি’ ধানের বীজ কুড়িয়ে সংগ্রহ না করেই অন্যমনস্ক হয়ে চলে যান ‘দ অলওয়াক দ দিক্কি’র বাড়িতে। সেখানে গিয়ে তিনি মনের সুখে বাঁশি বাজিয়ে বিভোর হয়ে থাকেন। এর মধ্যে সুযোগ বুঝে ‘অনিং নসিকসক চিনিং নমিনদিল আ নিং দিপেপি চিনিং দিপেরা’ ধানের বীজগুলো নিয়ে যান এবং নিজের খেতে বপন করেন। পরবর্তীকালে সূর্য দেবতা ‘মিসি আপিলপা সালজং গালাপা’ তার কাছ থেকে ধানের বীজ নিয়ে গিয়ে নিজের খেতে বপন করেন এবং কালে খাদ্যশস্য সম্পদশালী হন।
সেকালে সর্বপ্রথম খাদ্যশস্যের একচেটিয়া অধিকারী ও সম্পদশালী উর্ধ্বলোকের মিসি আপিলপাা সালজং গালাপা একদিন ‘বেনাগং ওয়াকমেতং সাংকাটির আন্তি রাচা আক্কা গিতেল’ বাজারে যাচ্ছিলেন। তার সঙ্গে ছিলো আতামাজং, দালমাজং, গগসিজং, গদসিয়া, কালজিনা প্রমুখ দাসগণ। এ জগতের মানুষ আ’নি আপিলপা চিনি গালাপাও থলেতে করে খাবার আলু নিয়ে, নোংরা পোশাক ও ময়লাযুক্ত শরীরে ঐ বাজারেই তাদের আগে আগে যাচ্ছিলেন। এক সময় সে পেছনে কয়েকজন সুপুরুষকে পরিচ্ছন্ন পোশাকে তার পিছু পিছু আসতে দেখে লজ্জায় পথের পাশের মস্ত বড় এক পাথরের আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে রইলেন। কিন্তু সে মিসি আপিলপা সালজং গালাপার নজর এড়াতে পারলেন না। তিনি আপিলপা সালজং গালাপা ঐ স্থানে এসে পৌঁছালে তাকে গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে আসতে বললেন। সে লজ্জায় ও ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বেরিয়ে আসলে তিনি তার নাম জানতে চাইলেন । তিনি বললেন তার নাম আ’নি আপিলপা চিনি গালাপা, নামে মিল দেখে মিসি আপিলপা সালজং গালাপা তার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের প্রস্তাব করলেন। সভয়ে ও সলজ্জে আনি আপিলপা চিনি গালাপা তাতে রাজি হলেন।পরে তারা নিজেদের নিয়ে আসা খাবার খেতে পথের পাশের এক বৃহৎ দংক্রেং গাছের তলে বসলেন। তখন তিনি আপিলপা সালজং গালাপা দেখলেন যে, তার বন্ধু আলু খাচ্ছেন। তা দেখে তার খুব করুণা হলো। তিনি আ’নি আপিলপা চিনি গালাপাকে নিজের ভাত ও সুস্বাদু মাছ-মাংসের তরকারি খেতে দিলেন। আর জানতে চাইলেন, তিনি জুম চাষ করেন কিনা; জুম খেতে ধান ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের বীজ বপন করেন কিনা, উত্তরে আনি আপিলপা চিনি গালাপা জানালেন যে, তিনি জুম চাষ করেন, তাতে তিনি আলু, মূল এসবের চাষ করেন। কিন্তু ধান কী তা তিনি দেখেন নাই। তাই তিনি ধানের চাষ করেন না। তিনি আপিলপা সালজং গালাপা করুণাবিষ্ট হয়ে বললেন, ‘আমি বাজার থেকে ফিরে গিয়ে তোমাকে ধানের বীজ পাঠাব। তুমি জুম চাষ করে জুম খেতে ধান বুনবে। আর যখন ধান পাকবে এবং ঘরে তুলবে, তখন আমাকে স্মরণ করবে, ভুলে যাবে না, আমি তোমাকে ধানের বীজ দিয়েছি। তোমার ফসলে অর্থাৎ খাদ্যশস্যে আমাকে সম্মান করবে, আমাকে তৃপ্ত করবে। তোমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব, মধুর সর্ম্পক অঁটুট রাখবে। প্রত্যেক বছর তুমি ও তোমার পরিবার পরিজন প্রাপ্ত আশীর্বাদের ফল দিয়ে আমাকে আগে স্মরণ করে সমাদর করবে। আমার আশীর্বাদে আমার দানে আনন্দ করবে, আমার কাছে প্রার্থনা জানাবে। আমি প্রতিবছর তোমাকে ও তোমার পরিবার পরিজনকে আশীর্বাদ করবো, তোমাদের মঙ্গল করবো। আমার এ প্রতিশ্রুতি অন্যথা হবে না।’
মিসি আপিলপা সালজং গালাপা থেকে বাড়িতে ফিরে গিয়ে নিজ প্রতিশ্রুতি অনুসারে তার দাস নক্কল জনিকসক ররি জবংবংকে দিয়ে আনি আপিলপা সালজং গালাপাকে ভালো ধানের বীজ পাঠালেন। কিন্তু তার ঐ দাস মানুষের প্রতি ঈর্ষাবশত ঐ ভালো ধানের বীজ ভেজে নষ্ট করে আনি আপিলপা চিনি গালাপাকে এনে দিল। তিনি এসবের কিছুই জানতেন না। তাই সে সরল বিশ্বাসে ভালো মনে করে জুমক্ষেতে বুনলেন, দখিনা বাতাস এলো, বৃষ্টি হলো, কিন্তু বীজের অঙ্কুরোদগম হলো না। তিনি বিষন্ন হতাশ হলেন। মিসি আপিলপা সালজং গালাপা তাকে ঠকিয়েছে ধরে নিলেন। তাই ক্রোধে একদিন মিসি আগিলপা সালজং গালাপার দাসদের দিমরে, চওন, বাংসে এবং বাং দিংকে বেঁধে রাখলেন। আকাশ দেবতা মিসি আপিল পা সালজং গালাপা তা দেখে আকাশ থেকে নেমে এলেন এবং অনুনয় করে বললেন-‘আমার এ দাসদের কোনো দোষ নেই। তাদের কান্না আমার কানে পৌঁছেছে। তাদের দুরবস্থায় আমি স্থির থাকতে পারিনি। তাই তাদের উদ্ধারের জন্যে আমি নেমে এসেছি। এদের দয়া করে ছেড়ে দাও। আমার দাস নক্কল জসিকসক ররি জবংবং অন্যায় করেছে। আমি তাকে শাস্তি দিয়েছি। আমি অনুরোধ করি, দয়া করে তাদের ছেড়ে দাও। আমি পুনরায় তোমাকে উত্তম ও সতেজ ধানের বীজ পাঠিয়ে দেব।”
আ۰নি আগিলপা চিনি গালাপা আকাশ দেবতার অনুরোধে দয়া পরবশ হয়ে বন্দীদের মুক্ত করে দিলেন। চিনি আপিলপা চিনি গালাপা নিজের কথানুসারে তাঁকে নতুন করে উত্তম ও সতেজ ধানের বীজ পাঠালেন। আ۰নি আপিলপা চিনি গালাপা নব উদ্যমে পরিশ্রম করে জুমখেতে ধানের বীজ বুনলেন। দখিনা বায়ু এলো, বৃষ্টি হলো, সতেজ বীজের অঙ্করোদগম হলো ও সুন্দর হয়ে বেড়ে উঠলো। তা দেখে আ۰নি আপিলপা চিনি গালাপার মনে আনন্দ জেগে উঠলো। ধান পাকতে আরম্ভ করলো এমন সময়ে মাতেংকে মেসেওয়ালের দাস ক্রুরাংরু গ্রিকমেসাল দেওকবাচ্য দেগং গিত্তেল গোপনে কিছু ধান কেটে চুরি করে নিল। আর এ সুযোগে হিংসা বশতঃ ‘সুগরা মান্তিজা’ আপিলপা চিনি গালাপার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বললো যে, সে তোমাকে আগেই না দিয়ে পাকা ধানগুলো কেটে নিজেই খেয়েছে। সে তোমাকে উপেক্ষা করেছে, অসম্মান করেছে। সুগরা মান্তিজার এ অভিযোগগ শুনে মিসি আপিলপা সালজং গালাপা পার্থিব বন্ধু আ۰নি আপিলপা চিনি গালাপার বিরুদ্ধে উত্তেজিত ও ক্রোধান্বিত হলেন। তিনি আ۰নি আপিলপা চিনি গালাপার পুত্র ও দাসদের বন্দী করলেন। এ সংবাদ শুনে আ۰নি আপিলপা চিনি গালাপা বিচলিত হলেন। পরে সস্থির হয়ে, কাল বিলম্ব না করে সে মিসি আপিলপা চিনি গালাপার নিকট গিয়ে অনুনয় বিনয় করে বললেন-‘আমি এখনো জুমক্ষেতের ধান কাটিনি, ধান কেটে তোমাকে ভুলে গিয়ে, তোমাকে অবজ্ঞা ও অসম্মান করে নিজে আগে খাইনি। আমি সন্দেহতীতভাবে তোমার প্রতি বিশ্বস্ত আছি। আমার জুমক্ষেতের আগে পাকা ধানগুলো আমার অজ্ঞাতে মাত্তেংকে মেসেওয়ালেও দাস ক্রুরাংরু দেওক রাচা দেগং চুরি করে কেটে নিয়েছে। আর হিংসা করে সগরা মান্তিজা তোমার কাছে এসে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছে। এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণভাবে নির্দোষ। অনুগ্রহ করে আমার পুত্র ও দাসদের মুক্ত করে দাও। আমি সম্মান করি এবং সম্মান করবো।”
মিসি আপিলপা সালজং গালাপা এ সরল স্বীকারোক্তিতে বিশ্বাস করে আ۰নি আপিলপা চিনি গালাপার পুত্র ও দাসদের মুক্ত করে দিলেন। আর উভয়ে মিলে আবার নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করলেন। বংশ পরম্পরায় সম্মান করার ও আশীর্বাদ করার প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হলেন।
মিসি আপিলপা সালজং গালাপা আবার নতুন করে আ۰নি আপিলপা চিনি গালাপাকে উত্তম ও সতেজ ধানের বীজ দিলেন। তিনি বীজ নব উদ্যমে জুমখেতে বুনলেন। বীজের অঙ্করোদগম হলো, বেড়ে উঠলো ও ভালো ফলন হলো। আ۰নি চিনি গালাপা মনের আনন্দে ও কৃতজ্ঞতায় মংরে পর্বতের (মন্দর পর্বত) চেন্দেন শিখরে মিসি আপিলপা সালজং গালাপর উদ্দেশে নতুন শস্য, নতুন মদিরা ও ধূপ দিয়ে নৈবেদ্য উৎসর্গ করলেন। এভাবে মংরে পর্বতে প্রথম ওয়ানগালা অনুষ্ঠিত হলো।
আকাশ ও উর্বরতার দেবতা-মিসি আপিলপা সালজং গালাপা খুশি হয়ে আশীর্বাদ করলেন ও বললেন-“এ ব্যক্তি ও তার বংশধরগণের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতেও ভালো ফসল হোক। তারা চিরকালের জন্যে আশীর্বাদযুক্ত হোক। প্রতি বছর এই ঋতুতে আমি যখন পৃথিবীতে ফিরে এসে আশীর্বাদ করবো তখনো এভাবে ধন্যবাদের পর্ব-উৎসব পালিত হোক।
আ۰নি আপিলপা চিনি গালাপা প্রতি বছর জুমচাষ করে, আশীর্বাদ পেয়ে বিশ্বস্ততার সাথে ওয়ানগালা করে ধন্যবাদের দান উৎসর্গ করতেন। আর এভাবেই তিনি দিনে দিনে আরো ধনী ও সম্পদশালী হয়ে উঠলেন। তিনি তাঁর পুত্র-কন্যাদের জুমচাষে উৎসাহ দিলেন, সাবধান করলেন, যেন তারা আকাশ ও উর্বরতার দেবতা-মিসি আপিলপা সালজং গালাপাকে ভুলে না যায়, সমাদর করতে অবহেলা না করে, তারা যেন তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান দান করে। আর এভাবে তখন থেকে যুগ-যুগান্তরে ও বংশপরম্পরায় ওয়ানগালা উৎসব গারোদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে চলে আসছে।
‘আমরা আটকে গেছি ।। মৃগেন হাগিদক’
: প্রগতিশীল নেতাদের অভিমত, আমরা (আচিক, মান্দি বা গারো) আটকে আছি,......বিস্তারিত
-
আমরা আটকে গেছি ।। মৃগেন হাগিদক
: প্রগতিশীল নেতাদের অভিমত, আমরা (আচিক, মান্দি বা গারো) আটকে আছি,...
-
গারো জাতি সত্তার কবি মতেন্দ্র মানখিনকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা
: আজ কবি মতেন্দ্র মানখিনের জন্মদিন। জন্মদিনে থকবিরিম পরিবারের পক্ষ থেকে...
-
Noksil ।। Labison Sku
: Noksil Mosla nonga bringni do.bipani japingko cha.ai Da.au mangmang...
-
Mikkang bo’rorong ।। Liang Ritchil
: Mikkang bo’rorong Bijak tangsek, bibal rimit bite gitchakrong Nitubia anu...
-
আজ বীর শহিদ পীরেন স্নালের আত্মদান দিবস
: আজ বীর শহিদ পীরেন স্নালের আত্মদান দিবস। ২০০৪ সালের ৩...
-
থকবিরিমের ভাইরাল ভিডিও আমার কিছু প্রশ্ন।। মিঠুন রাকসাম
: ওয়ানগালার মাঠ কিংবা কোনো উৎসবের মাঠ কি কারো একান্ত ব্যক্তিগত...
‘আমরা আটকে গেছি ।। মৃগেন হাগিদক’
: প্রগতিশীল নেতাদের অভিমত, আমরা (আচিক, মান্দি বা গারো) আটকে আছি,......বিস্তারিত
‘আমরা আটকে গেছি ।। মৃগেন হাগিদক’
: প্রগতিশীল নেতাদের অভিমত, আমরা (আচিক, মান্দি বা গারো) আটকে আছি,......বিস্তারিত