Thokbirim | logo

৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

লোকান্তরিত কবি শাওন রিছিল ও তাঁর কবিতা ।। উন্নয়ন ডি. শিরা

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৩, ২০২১, ১১:৪৯

লোকান্তরিত কবি শাওন রিছিল ও তাঁর কবিতা ।। উন্নয়ন ডি. শিরা

নগর কীর্তন গারো সংস্কৃতির অনুষঙ্গ নয় কিন্তু তবুও যদি কখনো এমন পরিসংখ্যান দাঁড় করানো হয় যে, গারো গ্রামগুলোর মধ্যে গুণেমানে ভালো কারা কীর্তন গায় তবে সেই তালিকার সর্বাগ্রে নিশ্চিতভাবেই আসবে মধুকুড়ার নাম। নেত্রকোণা কলমাকান্দার এই গ্রামের গারোরা দারুণ কীর্তন করে। খোল, করতাল আর মানুষের আনন্দপূর্ণ অংশগ্রহণ জানিয়ে দেয় স্বতঃস্ফূর্ততা, প্রাণোচ্ছলতা। টিকটক ফেইসবুকের এই সময়ে যেখানে যুবক-যুবতীদের কীর্তন কিংবা অন্যান্য সামাজিক কার্যক্রমে পাওয়া-ই যায় না সেখানে এই গ্রামের চিত্র একটু ভিন্ন। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে,কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী থেকে শুরু করে বয়স্করা পর্যন্ত কীর্তনে অংশ নেয়। বললে অত্যুক্তি হবে না, মধুকুড়ার উঠান কীর্তন গাইয়েদের জায়গা-ই দিতে পারে না! এমন প্রাণময় কীর্তন তাদের। তাঁরা আশেপাশের গ্রামের বিয়ে, শ্রাদ্ধ অনুুষ্ঠানে কীর্তন গেয়ে আসে, ফান্থে বনাম বুড়ার কীর্তন প্রতিযোগিতা করে, কেউ কারো কম যায় না। কীর্তন আর মাঝ বিরতির চা পানে কখন মধুকুড়ার পুব দিগন্তে সূর্য উঠে টেরই পাওয়া যায় না।
একবার ডিসেম্বরের শীতের এমনই এক আনন্দমুখর পরিবেশে কবি শাওন রিছিলের সাথে মধুকুড়ার কীর্তনে অংশ নেওয়ার পরম সৌভাগ্য হয়েছিল। সেদিনই আমি প্রথম আবিস্কার করি তাঁর কবি সত্তার বাইরের এক সংস্কৃতিমনা হৃদয়কে, যাঁর সাহিত্য ছাড়াও সংস্কৃতির জন্য রয়েছে প্রচ- দরদ, আবেগ, ভালোবাসা। সে দারুণ করতাল বাজায়। মাথায় কিষাণি স্টাইলে গামছা বেঁধে চোখ বন্ধবস্থায় ঘুরে ঘুরে করতালে তাল উঠায়; করতালের এমনই অদ্ভূত মাতম তাল মনে হবে এই বুঝি স্বর্গ ছেড়ে ঈশ্বর মর্ত্যে নেমে এলো! কিন্তু হায়! কে জানতো তিন বছর বাদে স্বয়ং ঈশ্বর তাকে উপরেই নিয়ে যাবে! এখন চাইলেও আর কোনোদিন তাঁর করতালের তালে কীর্তন গাওয়া হবে নাÑ ভাবলেই হৃদয় মন ভারি হয়ে উঠে হারানোর বেদনায়।
মধুকুড়া প্রয়াত কবি শাওন রিছিলের শ্বশুর বাড়ি। এই গ্রামের মান্দি রমণী নিপা  ম্রং’র সঙ্গে প্রেম বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন,সংসার করেছেন, ছেলে সন্তানের জনক ছিলেন।বর্তমানে একমাত্র ছেলে দামার বয়স সাড়ে ৬ বছর। নিজভাষার প্রতি গভীর দরদ থেকেই ছেলের নাম রেখেছিলেন দামা। যার বাংলার্থ ঢোল। দামা’কে দেখতে অবিকল তাঁর বাবার মতোই লাগে। কিন্তু সে যে বাবাকে হারিয়েছে এই বোধ এখনও তাঁর মাঝে আসেনি। শাওন কোথায় জিজ্ঞেস করলে হেসেখেলে বলে, ‘‘বাবা সিজক (বাবা মারা গেছে)’’।
পুত্রকে নিয়ে ফেইসবুকে সে মিষ্টি কাহিনি লিখতো। পুত্র এটা ওটা আবদার করতো কিন্তু আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে সব আবদার মেটানো যায়নি, এসব সে লিখে গেছে। বড় হয়ে দামা যেদিন সেইসব লেখা পড়বে সেইদিন নিশ্চয়ই পৃথিবীর তাবৎ শক্তি দিয়ে আটকানো যাবে না দামা’র চোখের জল!
ব্যক্তিগত জীবনে কবি ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক, নম্র, অতিথি বৎসল, লাজুক স্বভাবের। সে কারো সাথে কখনোই যেচে কথা বলতে যেতো না, আবার যাঁর সাথে একবার সখ্যতা গড়ে উঠতো তাঁর সঙ্গে আঠার মতো লেগে লাগতো; গড়ে তুলতো হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। কবিতায়, চু’র আড্ডায়, ভ্রমণে, নিত্য প্রয়োজনে থাকতো কাছাকাছি। সে যেমনকবিতা লিখতো তেমনি স্বাদের লুচি বানাতো। আমি কয়েকবার তাঁর হাতের লুচি খেয়েছি। কি নিখাদ স্বাদ! সেই স্বাদ এখনো জিহ্বায় লেগে আছে, অনুভবে পাই তাঁর স্বাদ। সেই স্বাদ ভুলবার নয়।
কবির মাঝে গারো সংস্কৃতির শেকড় জানার আকাক্সক্ষা ছিল প্রবল। এই আকাক্সক্ষাই তাকে হা’ফাল থেকে আ’বিমার প্রত্যন্ত মান্দি গ্রামগুলোতে টেনে নিয়ে গেছে, আর্থিক অসঙ্গতি কখনো বাধাঁ হয়ে উঠতে পারেনি। কষ্ট ম্যানেজ করে হলেও চলে গেছেন। একবার চুনিয়ায় ‘সাংসারেক মান্দিরাংনি ওয়ান্না’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচনে সমসাময়িক অনেক কবি, লেখকদের সমাগম ঘটেছিল, সেখানে ছিল তাঁর সরব উপস্থিতি। পকেটের টান সত্ত্বেও জনিক নকরেককে নিয়ে আসমা বিথীর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘গিত্তাল মি আচ্ছিয়া’ দেখতে ছুটে গিয়েছিলেন- কেবলই মা, মাটি, আদি সংস্কৃতির দৈব আহ্বানে। সর্বশেষ টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান ছিল, ইচ্ছে ছিল কাছ থেকে সেখানকার মান্দি গ্রামগুলো ঘুরে দেখবার, এই ইচ্ছা পূরণ হয়নি। মৃত্যুর চারদিন আগে শূকর মাংসের তরকারি খাওয়ার ইচ্ছে জানিয়ে ফেইসবুকে পোস্ট করেছিলেন, সেই ইচ্ছেও পূরণ হয়নি। কেউ খোঁজ রাখেনি। ইট সুরকির যান্ত্রিক শহরে কেউ কারও মনের খবর রাখে না। তাঁর ওই বাক্যের মতোই-
‘‘তবুও জীবন
তুমি, আমি কাছাকাছি
তুমি আছো দূরে আছি আমি।’’


এখন শূকর মাংস দিয়ে ভাত খেলেই তাঁর কথা মনে পড়ে। নিজেকে অপরাধী লাগে। মাঝেমধ্যে ভাবি শূকর মাংস খাওয়া ছেড়ে দিই, কিন্তু পারি না। জিহ্বার লোভ সংবরণ করা বড় কঠিন।
মানবিক বোধ আর কবি সত্তার অপূর্ব সমন্বয়ে তাঁর ছিলএক অত্যাশ্চর্য চরিত্র। কখনো কোনোদিন কাউকে গালি দিতে শুনিনি, তাঁর ব্যবহারে সঙ্গের কেউ কষ্ট পেয়েছে বলেও মনে পড়ে না। তবে সে অভিমানী ছিল। মনের গহীনে অভিমান পুষত। কবির বড় বোন ইলা পেরীও আলাপচারিতায় এমনটিই জানিয়েছেন, ‘‘আমার ভাই প্রচ- অভিমানী ছিল।’’ অভিমানে সে লিখতো- ‘‘আম্মা, তুমি সুস্থ হউ। অভিমানে আমি কষ্ট পাই।’’
কলেজ জীবন থেকে আমি শাওন দা’র কবিতা পড়ি। তাঁর লেখার বয়স হয়েছিল প্রায় এগারো কি বারো বছর কিংবা আরো বেশি। কিন্তু এই সময়ের মাঝেও তাঁর কোন কাব্যগ্রন্থ বের হয়নি। আমরা অনেকবার বলেছিলাম কিন্তু সে বের করতে চায়নি। আরো সময়ের দরকার বলে আলাপ ঘুরিয়েছে।’১৮ সালের বইমেলায় বই প্রকাশের জন্য জোড়াজুড়ি করেছিলাম, এক পর্যায়ে সে চু দিয়ে বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করবার শর্তে রাজি হয়েছিল। অজানা কারণে সে বছরও আর প্রকাশ করা হয়নি।
আজকালকার কবিরা টুকটাক কবিতা লিখেই কাব্যগ্রন্থ বের করে ফেলে, বই না থাকলে কবির স্বীকৃতি পাওয়া যায় না- সে ছিল এই ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীতে। জীবদ্দশায় রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের বেশিরভাগ কবিতা অপ্রকাশিত ছিল, মৃত্যুর পর সেইসব লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আমরা বন্ধুমহল উদ্যোগ নিচ্ছি কবির অগ্রন্থিত লেখা গ্রন্থাকারে প্রকাশের। ইতোমধ্যে প্রায় তিনশো’র বেশি কবিতা উদ্ধার করা গেছে। এগুলো একত্রিত করলে অনায়াসে একটি বই হয়ে যাবে।
তাঁর কবিতায় প্রেম-সৌন্দর্যের সুন্দর প্রয়োগ আছে, গারো গ্রাম, গারো সংস্কৃতি, অধিকারহীনতার কথা, গারো নারীর অস্তিত্ব আছে। মধুকুড়ার বহুল আকাক্সিক্ষত অপ্সরাকে নিয়ে লিখেছেন ‘মধুকুড়ানি নামনিক গুয়া মিচিক (মধুকুড়ার ক্লান্ত মেয়ে)’ শিরোনামে কবিতা। সেই কবিতার প্রথম কয়েক লাইন-
বন্নাংজক আংআ, ওয়ালথাথ ওয়ালসেংয়ে
সিলগা কো নিয়েতোন
জাক্কো দাক্কে নাম্মা সাল কো রাবা হা
মধুকুড়ানি নামনিক গুয়া মিচিক
বাংলা:
বিপন্ন আমি নিশি জাগরণে
আকাশে হেলান দেয়ার অপরাধে
এক খাবলা সকাল ছুঁড়ে দেয়
মধুকুড়ার ক্লান্ত মেয়ে।
ভাষান্তর মূল লেখার সারবস্তুকে ঠিকঠাক ধরতে পারে না। লেখক যা প্রকাশ করতে চান বা বোঝাতে চান সেটি অনুবাদে কাজ হয় না। এক্ষেত্রে গারো ভাষার কবিতা গুলোকে যখন বাংলায় অনুবাদ করা হয় তখন একই বিষয়ের অবতারণা ঘটে। কবি শাওন রিছিলের এই কবিতার বেলায়ও এমনটি ঘটেছে। এটি লেখালেখির উঠান নামের এক বাঙালি ঘরানার সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। নামনিক গুয়া মিচিক মানে ‘পছন্দের মেয়ে’ বা ‘প্রেমিকা’ এই শব্দদ্বয় কাছাকাছি যায়, তারপরও জুতসই হয় না কিন্তু ‘ক্লান্ত মেয়ে’ একেবারে বেমানান লাগে। অ্যাপ্রোপ্রিয়েট শব্দ ব্যবহারের দিকে শাওন রিছিল ছিল বড়ই সজাগ, সদাসতর্ক।
লোকান্তরিত এই কবির মানসজুড়ে ছিল বিমূর্ত প্রতিবাদী সত্তা। সে মনপ্রাণ খুলে লিখতে চাইতো, সরকারের গণবিরোধী নীতির বিরুদ্ধেও- কিন্তু পারতো না। বড়জন আটকাতো। লিখতে না পারার কষ্ট, সমস্ত অভিমান, জ্বালা, ক্ষোভ ঝেরেছে চু, পান, সিগারেটের উপর। চু ছিল তাঁর আরেক সঙ্গী। এমন পারিপার্শ্বিক প্রতিবন্ধকতার মাঝেও সে লিখতো।মধুপুরে বাসন্তী রেমার কলাবাগান যখন বনবিভাগের লোকজন বিনা নোটিশে কেটে ফেলে তখন তিনি কবিতায় প্রতিবাদ জানান। প্রতিবাদী জনতাকে উৎসর্গ করে লিখেন-
‘‘আমার হাতেই উঠবে আবার লাঠি, শাবল, হাতুড়ি
মাটির সাথে মিশিয়ে দেব তোর মসনদের বাহাদুরি,
আমার কণ্ঠে স্লোগান হবে, স্লোগান হবে প্রতিধ্বনি
রক্ত রাঙা চোখে রবে, কষ্ট ভাঙার আহাজারি।’’
এটি বাঁচা নাম কবিতার প্রথম কয়েক লাইন, এই কবিতা তিনি দোখলা রেঞ্জ অফিস ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশ নেয়া বিক্ষুব্ধ জনতাকে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি সেইসময় একদিনের জন্য হলেও ‘চল মধুপুর ঘুরে আসি’ বলে পীড়াপীড়ি করেছিলেন। কিন্তু যাওয়া আর হয়নি। এইসব এখন কেবলি স্মৃতি।
অনেক সুখ-দুঃখের স্মৃতি রেখে, কাছের দূরের সবাইকে শোকসাগরে ভাসিয়ে হঠাৎ না ফেরার দেশে পাড়ি জমালো আমাদের প্রিয় সারল্যমাখা হাসির অধিকারী কবি শাওন রিছিল। গত ৯ সেপ্টেম্বর (২০২১) স্ট্রোক তাকে নিয়ে গেছে না ফেরার দেশে। আমরা ভেবেছিলাম সে সুস্থ্য হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবে, মালঞ্চের আড্ডায় যোগ দিবে কিংবা ‘হাই মানিনি জম্মা খো নিয়ে রাইনা (চু খাওয়ার কোড বাক্য)’ বলে নিয়ে যাবে; কিন্তু সে আর আসেনি। একরাশ অভিমান চাপা ক্ষোভ নিয়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে। না ফিরলেও আমার মতো অনেকের কল্পনা আর অনুভবে সে মিশে আছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যতোদিন মান্দিরা কবিতা পড়বে ততোদিন সে বেঁচে থাকবে।
যেখানেই আছো ভালো থেকো প্রিয় কবি শাওন রিছিল।



৯ সেপ্টেম্বর ব্রেইনস্ট্রোক করে তরুণ কবি শাওন রিছিল গুলশানের একটি ক্লিনিকে মারা যান। পরে তার নিজ বাড়ি হালুয়াঘাট থানার দক্ষিণ গোবরাকুড়া গ্রামে সমাধিস্থ করা হয়। কবি শাওন রিছিল স্মরণে থকবিরিম ‘ বিশেষ স্মরণ সংখ্যা’ প্রকাশ করেছে। সেই সংখ্যায় প্রকাশিত লেখাগুলো থকবিরিম অনলাইন পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।




সম্পাদক : মিঠুন রাকসাম

উপদেষ্টা : মতেন্দ্র মানখিন, থিওফিল নকরেক

যোগাযোগ:  ১৯ মণিপুরিপাড়া, সংসদ এভিনিউ ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। 01787161281, 01575090829

thokbirim281@gmail.com

 

থকবিরিমে প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। Copyright 2020 © Thokbirim.com.

Design by Raytahost
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x