Thokbirim | logo

৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

মনের কৈফিয়ৎ তোমার জন্য কবি শাওন রিছিল গারো ।। নিগূঢ় ম্রং 

প্রকাশিত : নভেম্বর ০৫, ২০২১, ১০:৫৩

মনের কৈফিয়ৎ তোমার জন্য কবি শাওন রিছিল গারো ।। নিগূঢ় ম্রং 

কীভাবে লেখা শুরু করবো, কীভাবেই বা শেষ করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। এই স্মৃতিচারণ/আত্মার কৈফিয়ত লেখাটা যখন শুরু করছি তখন প্রচ- মনের ক্ষুধা নিয়ে আমি শাওন রিছিল গারো দাদার লেখা কবিতা সংগ্রহে নেমেছি। বহু কবিতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তার সমস্ত লেখা যতটুকু সম্ভব একটা মলাট বদ্ধ করাতে স্বপ্ন দেখি। মোবাইলের নোটবুকে এবং খাতায় লিপিবদ্ধ করে প্রায় দুইশোর মতো কবিতা এবং কয়েকটা ছোট অনুগল্প সংগ্রহে রেখেছি। আরো বহু লেখা সংগ্রহের বাইরে আছে। আজ একসপ্তাহ হলো গত ১০-০৯-১৯ তারিখে আমরা কবি শাওন দাদাকে মাটির বুকে শুইয়ে রেখে এসেছি। লিখতে মন বসছিলো না, মনের অবস্থা এই সময়ে ভালো নেই, অসংখ্য স্মৃতি হুড়মুড় করে ভাসছে চোখে, কখনো ভাবিনি খুব তাড়া করে অল্প সময়ে অকালে হারাবো তাকে আমরা। কখনো ভাবতে ভাবতে চোখের কোণ বেয়ে কফোঁটা জল এসে যায়। খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের সম্পর্ক গভীর হয়েছিল। আমি তাকে দাদা ডাকতাম, তাকে শ্রদ্ধা করতাম, সে স্নেহ করতো, সে শ্রদ্ধা করতো, যদিও দাদা ডাকতাম তবুও আমরা বন্ধুর মতো চলাফেরা করতাম, সে কখনো বুঝতে দেয়নি আমি তার ছোট, কিংবা সে আমার বড়। এ জীবনে যতগুলো মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আমার তার মধ্যে শাওন দার সাথে চলাফেরা, কথাবলা, আড্ডা কিংবা লেখালেখির যে চর্চা যে বন্ধন দৃঢ়ভাবে গড়ে উঠেছিল তা ছিল আমার সর্বোচ্চ পাওয়া এবং সর্বশ্রেষ্ঠ।
শাওন খুব সাধারণ জীবন যাপন করতো,সরল জীবন ছিল, কিন্তু মানুষটা অসাধারণ ছিল, ছিল নম্র,ভদ্র, বিনয়ী আর খুবই সরল প্রাণের! অনেকগুলো স্মৃতি তার সাথে, অনেকগুলো স্মৃতি কুড়িয়েছি একসাথে, ঢাকার এক টুকরো এলাকা যাকে গারোরা বলে, গারোদের রাজধানী ‘কালাচাঁদপুর’, আর এই কালাচাঁদপুরের একটুকরো টিএসসি কিংবা শাহবাগ ভাবতাম মালঞ্চ স্কুলের প্রাঙ্গণকে, টিএসসি কিংবা শাহবাগ ভেবেই মেতে থাকতাম আমরা। রোজ রুটিন মাফিক হয়ে গিয়েছিল আমাদের আড্ডার বিনিময়, সাথে অনেকজনই যোগ দিতো এই আড্ডায়। রং চায়ের চুমুকে কত কথা হতো, কত গালগপ্প হতো। কখনো কখনো এই গলির পথ ধরে সোজা চলে যেতাম দুতলায়, গারো পানীয় জলের চুমুকে আড্ডা আরো বেশ জমতো বেশ পরিপূর্ণ হতো। সুখ দুঃখের কথা হতো। আড্ডা যখন প্রখর থেকে প্রখরত্বে পৌঁছে যেতো-তার সেই চিরচেনা সখ,অভ্যেস গামছা পেচানো মাথায় আরো রাঙিয়ে তুলতো। এভাবেই প্রণাণোচ্ছল প্রণান উচ্ছ্বাসে ভরে উঠতাম আমরা। কথায় আছে কবিতা আসে হুটহাট করেই মননে, যারা লেখে তার বুঝবে হাজার চিন্তা ধ্যান মগ্ন করেও অনেক সময় লেখার ভাষা আসে না। এই মানুষটা ঠিক এমনি এক অদ্ভুত ছিল- গ্লাসে চুমুক দিতে দিতেই কখন যে একটা কবিতা লিখে ফেলতো পাশে বসা কেউ থাকলেও সহজে বুঝতে পারতো না। অনেকবারই এমন হয়েছে, দোকানে বসে চা খেলাম কিংবা মালঞ্চের প্রণাঙ্গণে চায়ের চুমুকে চুমুকে লিখে ফেলতো। একবার মধুপুর যাচ্ছি দুজন, জানালার পাশে সে, জানালা খোলা শর্ষে ফুলে মাতোয়ারা সারা মাঠ দুজনে আনমনে দেখছিলাম, অমন সময়ও সে কবিতা লিখে ফেললো! আরো এমন বহু স্মৃতি কুড়িয়েছি তার সাথে, অনেকগুলো কবিতা লেখার স্বাক্ষী আমি। লেখার পর অনেক সময় বলতো আমায় কবিতার নাম কী দিবো! আমি সহজেই নাম দিতে জানি না সে প্রায় বলতো। এই জন্যই লক্ষ্য করলাম তার কিছু কবিতার নাম (শিরোনাম) নেই। লেখার পর কখনো কখনো পাঠ করে শোনাতো, কখনো বা ইনবক্সে পাঠাতো,কখনোবা তৎক্ষনাৎ ফেসবুকে পোস্ট দিতো কিংবা অনেক সময় পোস্টের পর অনলি মি করে রেখে দিতো।আফসোস হয় সে লেখা গুলো হয়তো আর প্রকাশ পাবে না। মালঞ্চের প্রাঙ্গণের খুব নিকটে তার বাসা ছিল, লোহার সিঁড়ির রেলিং ধরে দুই তলায় উঠে যেতাম তার বাসায়।খুব মনে পড়ে দুজনে চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি খেতাম খুব তৃপ্তি নিয়ে, মাঝে মাঝে সে নিজেই লুচি ভেজে খাওয়াতো ডাল কিংবা শব্জি দিয়ে মন ভরে আয়েশ করে খেতাম। আমার বাসা আরেক এলাকায় তবুও রোজ আসা যাওয়া হতো কাঁলাচাদপুরে বিকেল হলেই আসতাম অনেক গুলো কারণে তার মধ্যে শাওনদা’র সাথে দেখা আড্ডা রং চা খাওয়াও একটা কারণ থাকতো। মধুপুরের শালবন দুজনের খুব প্রিয় ছিল অনেক কারণেই, কয়েকবার দুজনে একসাথে গিয়েছি, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্মৃতি হলো- সাংসারেক মান্দিরাংনি ওয়ান্না” বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের সময়, এই প্রথমবার গিয়েছিলাম দুজনে একসাথে চুনিয়াতে খামাল জনিক নকরেক এর গৃহে, বইটি উন্মোচিত করেছিলেন খামাল নিজে, খামালের সাথে বসে কিছু কথা হলো,জানা হলো, উৎসুক মন আমাদের জানার আগ্রহ ব্যাপক! শেষবার যখন গেছি সে আরো বহু স্মৃতি মোড়ানো। খামাল জনিক নকরেককে নিয়ে বায়োগ্রাফি ফিল্ম প্রদর্শনীতে ‘গিত্তাল মি আচ্ছিয়া’ খামালের উঠোনে বসে বড় পর্দায় ভিন্নরকম এক অভিজ্ঞতা। শুধু ব্যক্তি হিসেবেই একজন শাওন রিছিল দা আমার প্রিয় ছিল তা নয়,ব্যক্তি পেরিয়েও তার আদর্শগত নানান দিক এবং সাহিত্য চর্চা-লেখা আমাকে খুবই আকৃষ্ট করতো। খুব সাবলীলভাবে সাহিত্যের রস মিশিয়ে ফেসবুকে সরব ছিল, কখনো মজার আনন্দের, দুঃখ-সুখের, ক্ষোভ-প্রতিবাদের, যন্ত্রণার সর্বোপরি সকল বিষয়ে চমৎকারভাবেও লিখতো। শুধু কবিতা লিখতো তা নয় অনেক অনু গল্পও লিখতো নিখুঁত প্রাণশক্তিতে। অনেকেই হয়তো তা ভিন্ন চোখে দেখতেন। তবুও সে আপন মনে লিখে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। একজন গর্ভবতী মায়ের প্রসব বেদনার যে আর্তচিৎকার, সেখানে লজ্জা থাকে না। একজনের প্রতিবাদের চিৎকারের ভাষায়ও অশল্লীলতা খুঁজো না। সাহিত্য চর্চা বা কবিতার ভাষায় যে শুধু প্রেম ভালোবাসার কাব্যে মোড়ানো তা কিন্তু নয়-কবি শাওন রিছিল তা থেকেও বেরিয়ে এসে দেখিয়েছেন, কবিতা শাসক শোষকের বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য হাতিয়ার/অস্ত্র। তিনি তার অসংখ্য ছোট বড় কবিতা বা লেখার মাধ্যমে তা জানান দিয়েছে। মধুপুরের তেলকিতে যখন রাষ্ট্রযন্ত্র গারোদের ভিটেমাটি প্রাচীন শ্মশানে আগ্রাসন চালায়, দখলে নিতে চাই, দেয়াল তুলে রেস্ট হাউজ তৈরি করছে তখন কবি লিখেছিলেন –
‘কনডম কিনে দিয়ে বলবো
তোমা হইতে যেন
এমন কেউ জন্ম না নেয়,
যে আমার বসত ভিটা খায়
যে আমার শ্মশান খায়।’


কবির যে ক্ষোভ শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তিনি এইভাবেই প্রতিবাদে বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। তার যে সাহিত্য বাসনা মনের ক্ষুধা সে তার আপন খেয়ালেই করে গেছেন, তার সাহিত্য গভীরতা আমাদের জন্য বিশাল, আমাদের গারোদের অন্যান্য কবি-লেখক যখন প্রতিবাদী কলমের সান দিতে ভুলে গেছে কিংবা শাসক শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কলম চালাতে পিছপা হয়, তখন কবি শাওন রিছিল স্রোতের বিপরীতমুখী হয়ে এগিয়েছে। কজন পারে এমন করে? প্রসারের সীমাবদ্ধতায় সে উঠে আসেনি-তার সাহিত্য চর্চাও নেহাৎ কম সময়ের নয়। তার কবিতা সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখলাম ২০০৮/২০০৯ সালেরও কিছু সংখ্যাক কবিতা পেয়েছি, এরও আগেও লিখে গেছে তবে বর্তমানের পরিস্থিতিতে আপাতত সংগ্রহ করতে সম্ভব হয়ে উঠেনি। এখনকার সময়ের হিসেবে এক যুগেরও বেশি সময় থেকে সে সাহিত্য চর্চা করতো এবং লিখতো, তারও আগে থেকেও থাকতে পারে। ২০১২ সালের মাঝামাঝিতে অনবদ্য এক কবিতা লিখেছিল সে…
মা, মাটি এবং অন্যান্য
.
মা,
আর কত বছর পর মানুষ আমায় চিনতে পারবে?
আর কতদিন, প্রেসক্লাব এবং শহিদ মিনারের পাশে
মুখে কালো কাপড় এটে,
সভ্য সমাজকে জানাতে হবে আমি আদিবাসী।
নিভু নিভু প্রদীপের প্রতিবেশী হয়ে দেহের ভিতর ভয়টাকে চালান করে পাহাড়ি মেয়ের সন্মান বাঁচাতে জেগে রইব।
আর কত রাত?
সিধু-কানু, কুমুদিনী হাজং,কল্পনা চাকমা
চলেশ রিছিলেরা আর কত হারাবে?
মা গো,
আর কতদিন তোমায় অপমানের নৈবদ্য উপহার দেব?
আর কতকাল নিজেকে রোদ চশমার আড়ালে লুকাবো??

বর্তমান সময়ে গারো জাতিস্বত্তার অন্যতম কবি মতেন্দ্র মানখিনের (আমি আচ্ছু বলে ডাকি) সাথে তার সখ্যতা ভালই গড়ে উঠেছিল, তাকে খুব পছন্দও করতেন মতেন্দ্র মানখিন আচ্ছু। কবি লেখক ও গবেষক পরাগ রিছিল দা, কবি মিঠুন রাকসাম দা, এবং আরো নবীন প্রবীন কবি ও লেখকদের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, সাহিত্যের গ-ি পেরিয়েও কিছু বই ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদও করেছে। কবি মতেন্দ্র মানখিনের গারো ভাষায় (এবং বাংলায় অনুবাদসহ) প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জাতথাংনি জুমাং’ অমর একুশে বইমেলা ২০২০ সালে থকবিরিম প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হওয়া বইয়ে প্রচ্ছদ তাঁরই করা। ঢাকা ওয়ানগালা উদযাপন কমিটির ২০১৮সালের ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদও সে-ই করেছিলন। ২০১৯ সালের ঢাকা ওয়ানগালা উদযাপন কমিটির (কালাচাঁদপুর) ম্যাগাজিন প্রকাশনার সম্পাদক ম-লীর একজন সদস্য ছিলেন। লিখতেন নিয়মিত অনিয়মিত নানান সাহিত্যের অনলাইনের ওয়েব সাইটে, তার মধ্যে অন্যতম থকবিরিম ডট কম এবং তিনি থকবিরিম পরিবারের একজন সদস্যও ছিলেন। লিখতেন জনজাতির কণ্ঠের ওয়েব পোর্র্টালের সাহিত্যের পাতায়, মাসিক পত্রিকা খুরাং এ প্রকাশিত হয়েছিল কবিতা, ২০১৯ সালের ১৬জুন ৩টি মান্দি কবিতা গারো ভাষায় এবং বাংলা অনুবাদসহ লেখালেখির উঠান’ ওয়েব পোর্টাল সাহিত্যের পাতায় মধুকুড়ানি নামনিকগুয়া মিচিক শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল যা আজও প্রশংসনীয় হয়ে আছে সেই কবিতাগুলো। লিখেছেন তার নিজস্ব ব্লগে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তার নিজস্ব ফেইস বুক আইডিতেও লিখতেন নিয়মিত। এছাড়াও ওয়ানগালার প্রকাশনা ম্যাগাজিন এবং নানান ছাত্র সংগঠনের বার্ষিক মুখপত্রে প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা। হোপ মাল্টিমিডিয়া থেকে ২০২০ সালের বই মেলায় ‘হালুয়াঘাটের নির্বাচিত ছড়া ও কবিতা’ নামে বই প্রকাশিত হয়েছিল ৮৮জন কবি লেখকের, সম্পাদনা করেছেন শরীফ মল্লিক, এই বইয়েও কিছু কবিতা ছিল প্রয়াত কবি শাওন রিছিল দাদার। এবং এপার-ওপার বাংলার ৪০জন তরুণ লেখকদের নিয়ে ২০১২ সালে কবি বাবুল ডি. নকরেক ও তৃপ্তি চিসিমের সম্পাদিত বই ‘খুঁজি ফিরি তোমাকে’ এখানেও কিছু কবিতা তার প্রকাশিত হয়েছিল।

এই বছর ফেব্রুয়ারিতে থকবিরিম প্রকাশনীর একক আয়োজনে ‘গারো বইমেলা ২০২১’ ঢাকাস্থ কালাচাঁদপুরের শিশু মালঞ্চ স্কুল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো পুরোমাসব্যাপী। এবং খুব সফলভাবেই শেষ হয়েছিল, বলতে গেলে এই বইমেলা এক আলোড়ন তৈরি করেছিল, সাড়া জাগিয়ে তোলেছে। শুধু গারোদের মধ্যেই এই বইমেলার আলোড়ন সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, গারোদের পাশাপাশি ভিন্ন অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর লেখক-পাঠক সাহিত্যবোদ্ধাদের প্রতিদিনই এক মিলন মেলা হয়েছিল, পুরোমাস জুড়েই আড্ডায় মেতে উঠেছিল। এই বই মেলার আমিসহ প্রয়াত কবি শাওন রিছিল দাদা সার্বিকভাবে সহযোগিতায় ছিলাম। এখনো মনে পড়ছে-বই মেলায় টেবিলে বিছানোর মতো তাড়াহুড়ো করে যখন কিছু আনতে ভুলে গেছি, তখন শাওন দার বিছানার চাদর এনে বিছিয়ে দিয়েছিলাম টেবিলে তার উপর বই রাখতে। এই বই মেলাকে ঘিরে প্রাণের সঞ্চার তৈরি হয়েছিল, প্রতিদিনই মঞ্চে ছোটখাটো আয়োজন হতো, লাইভ হতো, লেখক পাঠক আড্ডা হতো, বই নিয়ে আলোচনা হতো, কবিতা পাঠ হতো।
একদিন কয়েকজন মিলে একপ্রকার জোর করেই মঞ্চে হাজির করেছিলাম তাকে কিছু একটা বলুক। অনেকটা লাজুক সে, কিছু কথা বললেন চোখ বন্ধ করে, কিছু কবিতা পাঠ করলেন। অনেকগুলো স্মৃতি আজ তাকে স্মরণে রাখার খোরাক। বই মেলায় তার আর আমার কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল, আমি চেয়েছি দুজনের হোক, কিন্তু সে চায়নি এখনি তার লেখা গ্রন্থ আকারে প্রকাশ হোক কেন তা আমি জানি না। তবে সে বলতো আরো সময় হোক। আমি অনেকবার জোর করেছি, তবুও সে চায়নি, বারংবার বলতো এখনো সময় হয়নি,আমার লেখা কজন পড়বে? আরো নিজেকে, লেখাকে গড়ে তুলি। সে সাহিত্য চর্চা করেও অনেকাংশে আড়ালে আড়ালে রাখতে চাইতো নিজেকে। তাকে সামনে কবি বললে লজ্জা পেতো। সে নিজেকে কবি লেখক হিসেবে জাহির করতে ইতস্তত বোধ করতো। আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বহিঃপ্রকাশ’ যখন প্রকাশিত হলো বই মেলায় আসলো, তখন সে প্রায় আড্ডায় বলতো, নিগূঢ় তোমারে দেখলে আমার হিংসে হয়, তোমারে আমার হিংসে হয়! পরক্ষণেই আবার বলতো গারোরা বই পড়া শিখে গেছে বোধহয়। তবে ভালো লাগছে, মেলার আমেজ দেখে বলতো আমার জীবনে বই নিয়ে গারোদের মাতামাতি এমন করে এর আগে কখনো দেখি নাই। বই পড়ার আগ্রহ বাড়ছে, এমন যদি আগে জানতাম তবে সত্যিই বই প্রকাশ করতাম। সামনে বার আশা রাখি প্রকাশ করবো।
আজ কথাগুলো ভীষণ কড়া নাড়ছে, যে স্মৃতি গড়ে উঠেছিল মালঞ্চ প্রাঙ্গণকে ঘিরে, বই মেলা বলো,কবিতা পাঠ বলো, আড্ডায় রং চা খেয়ে মেতে থাকা বলো, সব ফেলে এত তাড়া করে সেই মানুষটি চলে গেলো! ভীষণ কষ্ট হয়, খুব কষ্ট হয়। আজ সেই মালঞ্চের প্রাঙ্গণেই ১৯ অক্টোবর তার শোক স্মরণে ‘স্মরণ সভা’ হবে, যে প্রাঙ্গণে ছিল তার অবাধ বিচরণ, এখানেই মঞ্চে পাঠ করে শুনিয়েছিল কবিতা, সেই মঞ্চে আজ কালো ব্যানার টাঙিয়ে শোক জানাবো, চাপা কষ্ট বুকে।
এখানে রোজ আড্ডায় যোগ দিতো, আলবার্ট দা,পলাশ আসাক্রা দা, শিল্পী টগর দ্রং মামু, তরুণ প্রগতিশীল লেখক উন্নয়ন ডি শিরা ভাই, নিভৃতচারী কবি শিলমী পাঠাং (শাশুড়ি বলে সম্বোধন করি) কখনো কখনো ছাত্রনেতা সতীর্থ চিরান, মৃন্ময় চিরান, কবি মিঠুন রাকসাম দাদা আসতো, কবি ও গল্পকার লেবিসন স্কু দা, কবি অন্তর সাংমা দা, মাঝেমধ্যে আসতো বন্ধুবর সুমন মান্দা, রিংকু বনোয়ারী, ঝিলিক রুরাম, স্বাধীন পাঠাংসহ আরো অনেকেই। কবি শাওন রিছিল দাদা আমার শুধু চায়ের আড্ডায় কিংবা অন্যান্য চলাফেরার সঙ্গীই ছিলেন না- সাহিত্য চর্চা লেখার সঙ্গীও ছিলেন, যদিও সিনিয়র আমার থেকে তবুও বলা যায় আমরা লেখার সহযোদ্ধা ছিলাম, সবে জমে উঠছিল আমাদের লেখা চর্চা, সবে অঙ্করোদম হচ্ছিল আমাদের বীজের পল্লব, বড্ড একা করে রেখে চলে গেলো,
আজ আর মেসেজ আসে না,
কারো মেসেজের অপেক্ষায় থাকতাম-
আজ চ্যাট বক্স শূন্য।
আর নাই হোক সারাদিনে, অন্তত সন্ধ্যে বেলা রোজ নিয়ম মাফিক অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম-
নাংরিমা গলিতে রং চা খেতে কিংবা দুতলায় আড্ডায় অথবা মালঞ্চ স্কুল প্রাঙ্গণে খোশ গপ্পে আসরে মাততে। মেসেজ কি আর চ্যাট বক্সে কখনোই আসবে না? এই যে রোজ একটা অভ্যাস গড়ে উঠেছিল- তা কি অত সহজেই মুছে ফেলা যায় অথবা ভুলা যায়! আজ হয়তো নাংরিমা গলিতে রং চা পাবো, দুতলায় আড্ডা পাবো,
থাকবে-মালঞ্চ প্রাঙ্গণে জমজমাট আড্ডা, বহুজনের মেসেজ পাবো চ্যাটবক্সে – তাহলে কি পাবো না? কিসের এত ক্ষুধা মনের?
বুকের এক কোনে কেউ দাগ টেনে গেছে।

শাওন রিছিল

শাওন রিছিল

শাওন দা অনেক আগে থেকেই বলতো টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে যাওয়ার কথা, আমাদের প্রাথমিক কথা হয়েছিল ৯/৯/২০২১ তারিখে টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণে যাওয়া। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস, ৯ সেপ্টেম্বর তুমি চলে গেলে সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে। আমাদের শেষ দেখা কথা আড্ডা হয়েছিল ৪ সেপ্টেম্বর, সেদিন সে বলছিলো নিগূঢ় আমাদের কবে প্রথম দেখা হয়েছিল, কবে প্রথম কথা হয়েছিল, কবে প্রথম পরিচয় ঘটেছিল, বার বার মনে করাতে চাইছিলে আমাকে। আজ অনুভব করছি কেন সেদিন তুমি বার বার স্মৃতিচারণ তুলে আনতে চেয়েছিলে, জানা ছিল ৪সেপ্টেম্বরই আমাদের শেষ দেখা, শেষ কথা, শেষ আড্ডা হবে। হাসপাতালে যে দুইদিন তোমায় দেখতে গেছি, তোমার চোখ খোলা কখনো দেখতে পায়নি, তুমি বেডে শুয়ে ছিলে, স্যালাইন দেওয়া ছিল, শরীরের এক পাশ হয়তো নাড়াচাড়া করতে পারছিলে না। এরপর তো তুমি চোখ খুলোনি, তুমি দেখতে পেলে না, আমি দেখতে পাচ্ছিলাম তোমায়। যন্ত্রণা আজ আরো বাড়িয়ে তুলছে।
মনের কৈফিয়ত তোমার জন্য শাওন রিছিল দা।

সাহিত্যাঙ্গণে তোমার বিচরণ মুখর ছিল, খুব তাড়া করে তোমার চলে যাওয়া শূন্যতা এনে দিয়েছে আমাদের মাঝে, তোমার সাহিত্য চর্চাকে তুলে ধরা আমাদেরই কর্তব্য, তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবে তোমার কবিতা। এই ক্ষুদ্র লেখা অনেক কিছু উঠে আসতে পারতো, হয়তো উঠে আসেনি, হয়তো তুলে ধরতে পারিনি, তা হয়তো আমার জানার সীমাবদ্ধতায়-তবু আপ্রাণ চেষ্টা করেছি কিছু কথা লিখতে, কিছু কথা জানাতে। ভবিষ্যতে ও তুলে ধরার চেষ্টা করবো, তোমার স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যেতে চাই, ক্ষমা করো শাওন দা। মানুষ বেঁচে থাকতে অতটা মূল্যায়ন পায় না, যতটা পায় পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার পর।
তোমার কর্মকে তোমার চর্চাকে, বেঁচে থাকতে হয়তো অনেকেই বুঝতে পারেনি উপলব্ধি করতে পারেনি। এই ব্যর্থটা তোমার নয়, এই ব্যর্থটা আমাদের, এই ক্ষুদ্র লেখায় কেউ যদি উপলব্ধি করতে পারে -তবেই এই মনের কৈফিয়ত স্বার্থক হবে মনে করি।




সম্পাদক : মিঠুন রাকসাম

উপদেষ্টা : মতেন্দ্র মানখিন, থিওফিল নকরেক

যোগাযোগ:  ১৯ মণিপুরিপাড়া, সংসদ এভিনিউ ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। 01787161281, 01575090829

thokbirim281@gmail.com

 

থকবিরিমে প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। Copyright 2020 © Thokbirim.com.

Design by Raytahost
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x