এমন একটি পৃথিবী কল্পনা করুন, যেখানে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নেই? কেমন নিরানন্দ, নিরস, রুক্ষ মনে হয়, তাই না? একটি ঘরে শুদ্ধ বাতাস প্রবাহে যেমন একটি জানালার প্রয়োজন হয়, তেমনি ব্যক্তি মানুষের মনের ঘরে খোলা জানালা হতে পারে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি। যা আমাদের নতুন কিছু শিখতে, চিন্তন শক্তি ও কল্পনাশক্তি বাড়াতে, উচ্ছল এবং প্রাণবন্ত থাকতে সহযোগিতা করে।
চালর্স বুকভস্কির মতে, ‘সাহিত্য ছাড়া জীবন যেন নরক’। তিনি বলতে চেয়েছেন, সাহিত্য আমাদের জীবনকে সহজ করে তোলে, কারণ এটিকে আমরা আমাদের অনুভূতি এবং মতামত প্রকাশ করার উপায় হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ছাড়া পৃথিবী যেন রঙহীন ও ধূসর। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি আমাদের জীবনে রঙ দেয়। সাহিত্য পূর্বপুরুষদের গল্প পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সহভাগিতা করার একটি উপায় হিসেবে কাজ করে।
শব্দের বিশেষ একটি শক্তি আছে। শব্দকে যখন সঠিকভাবে বিন্যাস ঘটানো হয়, সেই শব্দগুলো সাহিত্যে পরিণত হয়। সেই শব্দ মানুষের মনে আগুন জ¦ালাতে পারে। শব্দগুলো কঠিতম হৃদয় থেকে অশ্রু ঝরাতে পারে। শব্দগুলো সামনে এগিয়ে যেতে প্রেরণা যোগাতে পারে। হাসাতে পারে, কাঁদাতে পারে। কী অসীম শক্তি! তাই না!
সাহিত্য কি!
সাহিত্যকে শিল্পের একটি অংশ বলা হয়। সাহিত্য হচ্ছে এমন একটি লেখনী, যেখানে শিল্প, বুদ্ধিমত্তা বা কল্পনাশক্তির আঁচ পাওয়া যায়। সাহিত্য সাধারণ লেখনী থেকে আলাদা। অর্থাৎ আমরা বলতে পারি, আমাদের চিন্তা-চেতনা, অনুভূতি, সৌন্দর্য, জীবনযাপনকে শৈল্পিকভাবে লিখিত বা মৌখিকভাবে তুলে ধরাই হচ্ছে সাহিত্য। সাহিত্য হলো জ্ঞান ও বিনোদনের রের্কডিং/লিপিবদ্ধকরণ, সংরক্ষণ এবং প্রেরণের একটি পদ্ধতি। সাহিত্যে সামাজিক, মনস্তাত্বিক, রাজনৈতিক এবং আধাত্মিক বিষয়বস্তু স্থান পেতে পারে।
সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা কি?
সাহিত্যকে জাতির দপর্ণ বা আয়না বলা হয়। সাহিত্যের মাধ্যমে একটি জাতির ধ্যান-ধারণা, চিন্তা- চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। একটি জাতির সামগ্রিক পরিচয় ফুটে উঠে সেই জাতির সাহিত্যে। আয়নায় যেমন আমাদের পূর্ণাঙ্গ মুখচ্ছবি প্রতিফলিত হয়, তেমনি সাহিত্যেও একটি জাতির পরিপূর্ণ চিত্র ফুটে উঠে।
সাহিত্যের সাথে মানব জাতির ও সমাজের যোগাযোগ খুবই ঘনিষ্ঠ। জীবন ও সমাজকে নিয়েই সাহিত্য। সমাজ জীবনের লব্দ অভিজ্ঞতা নিয়ে সাহিত্য রচিত হয়। ইংরেজিতে বলা হয়, ‘খরঃবৎধঃঁৎব রং ঃযব পৎরঃরপরংস ড়ভ ষরভব’ অর্থাৎ সাহিত্য হচ্ছে জীবন সমালোচনা। আমাদের জীবনের ভাল-মন্দ, প্রেম-বিরহ, বিদ্রোহ-উদযাপন সাহিত্যে স্থান পায়। একটি জাতির প্রতিনিধিত্ব করে সেই জাতির সাহিত্য। পৃথিবীতে যে জাতির সাহিত্য যত বেশি উন্নত, জাতি হিসেবে সেই জাতি তত বেশি উন্নত। কেননা প্রত্যেক কবি সাহিত্যিকগণই তাঁদের লেখনীর নিপুণ আঁচড়ে সে জাতির নিজস্ব জীবনধারা ও বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেন। যেন তারা বলেন, ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব/তবু আমারে দেবনা ভুলিতে।’
শিল্পকলা নিঃসন্দেহে বিশ^কে অনুপ্রাণিত করে। তবে শুধু তাই নয়, সাহিত্য একটি জাতির সংস্কৃতির আর্দশ সংরক্ষণ করে। সাহিত্য প্রেম, বন্ধুত্ব, স্বাধীনতা বা বিশ^াস কিংবা বিদ্রোহ বা প্রতিবাদ যেমনই হোক তা মানুষের অস্তিত্বকে ধারণ করে। সাহিত্য নিজেদের প্রকাশে এবং ইতিহাসে মানুষের যে কোন দুর্ভোগ বা আনন্দ উদযাপনের নথি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বা হতে পারে। গ্রীক, হিব্রু এবং রোমানরা সাহিত্যের মাধ্যমে ইতিহাস সংরক্ষণে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
সাহিত্য একটি হচ্ছে নথি, একটি দলিল। জাতির অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য, জীবনযাত্রা সেই জাতির সাহিত্য পাঠেই বুঝা যায়। কোন জাতির বিষয়ে ধারণা পেতে হলে সেই জাতির সাহিত্যের সাথে পরিচিত হতে হবে।
সাহিত্যে গারো নারী
সাহিত্য একটি জাতির পরিচয়ের বহি:প্রকাশ হলেও সাহিত্যে গারো নারীদের পদচারণা খুবই সামান্য। যেখানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারীরা তাদের সুখ-দু:খ, আবেগ-অনুভূতি, দর্শন, প্রতিবাদ, বিদ্রোহ, মতপ্রকাশের কিংবা এগিয়ে যাওয়ার জন্য লেখনী বা সাহিত্যকে ব্যবহার করছে বা করছে। সেখানে মাতৃসূত্রীয় সমাজ ব্যবস্থার গারো নারীরা অন্যান্য নারীদের তুলনায় অনেকটাই স্বপ্রতিভ, স্বাধীনচেতা এবং বহুবিদ প্রতিভার অধিকারী হলেও সাহিত্যের ক্ষেত্রে কেন জানি নারীরা সেভাবে এগিয়ে আসেনি।
তবে ৮০-৯০ দশকে গারো নারীদের মধ্যে যারা লেখালেখি করতেন তাদের মধ্যে শ্রদ্ধেয়া বিভা সাংমা, মারীয়া চিরান, ঝর্ণা চিরান, সুমনা চিসিম ও কোহিমা দারিং অগ্রগণ্য। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এখনো লিখে চলেছেন।
পরবর্তীতে ফৈবি চিরিং মারাক, সুবর্ণা পলি দ্রং, লিনা জাম্বিল, লিপা চিসিম লেখালেখিতে এগিয়ে আসেন।
তাদের মধ্যে ফৈবি চিরিং মারাক এবং লিপা চিসিম কবিতা লিখেন। সুবর্ণা পলি দ্রং ছোটগল্প, শিশুতোষ লিখা এবং কবিতা লেখেন। লিনা জাম্বিল কবিতা, উপন্যাস এবং প্রবন্ধে মনোনিবেশ করেছেন।
সম্ভাবনাময় বা উদীয়মান লেখক হিসেবে পূণ্যা প্যাট্রিশিয়া রিছিলের লেখা বেশ ভালো। সে নিয়মত হলে গারো সাহিত্যে আরো ভুমিকা রাখতে পারত বলে আমি মনে করি। এছাড়া নতুনদের মধ্যে বেবি ব্রিজেট চিসিম, দৃষ্টি দিব্রা, সুমনা ম্রং, ফাল্গুনী স্কু ও আরো অনেকে লেখালেখিতে ভালো করছেন।
গারো নারীদের সাহিত্যে পদচারণা এবং উত্তরোত্তর এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে কিছু বাধা বা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাহিত্যের প্রতি উদাসীনতা, সাহিত্যে নিজেকে সম্পৃক্ত করার বিষয়ে অনীহা, উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণার অভাব। গারো সমাজ ব্যবস্থা যেহেতু মাতৃসূত্রীয় সেহেতু ঘর-গৃহস্থালী এবং সংসারে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে লেখালেখিতে সময় দেয়া নারীদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ বটে। ইন্টারনেট সহজলভ্যতার যুগে তরুণরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি আসক্ত হওয়ায়, লেখালেখিতে সময় কম পাচ্ছে এবং আগ্রহ কমে যাচ্ছে। পাছে লোকে কিছু বলে কিংবা সমালোচনা এবং লেখালেখিতে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণার অভাবে অনেকে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
করণীয়/প্রস্তাবনা
সাহিত্যে গারো নারী লেখকদের বিকাশ নিয়ে আমি যথেষ্ট আশাবাদী। আশা করি, গারো নারীরা লেখালেখিতে এগিয়ে আসবেন, সাহিত্যের জগতে বিশেষ ভুমিকা রাখতে সক্ষম হবেন। সাহিত্যে গারো নারীদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। তারই নমুনা হিসেবে নিম্নে কয়েকটি প্রস্তাবনা দেয়া হলো:
ক্স যারা বিভিন্ন লিটল ম্যাগ/স্মরনিকা কিংবা প্রিন্ট কিংবা অনলাইন পত্রিকা পরিচালনা করে থাকেন, তারা নারীদের লিখা প্রকাশ করে লেখালেখিতে এগিয়ে আসার জন্য উৎসাহিত করতে পারেন। নারীদের জন্য বিশেষ সংখ্যা করা যেতে পারে।
ক্স নারীদের লেখালেখিতে আগ্রহ তৈরিতে লেখক কর্মশালা আয়োজন করা।
ক্স বিভিন্ন সাহিত্য বিষয়ক সেমিনার বা আলোচনা সভার আয়োজন করা এবং নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
ক্স বিভিন্ন পাঠচক্রের ব্যবস্থা করা। কারণ, লেখার জন্য প্রচুর বই পড়া চাই। পাঠচক্রের মাধ্যমে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ তৈরি করা।
ক্স গারো নারী লেখক সংঘ/সংগঠন/ ফোরাম তৈরি করা।
ক্স গারো নারী লেখকদের বই প্রকাশের ক্ষেত্রে আর্থিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা।
ক্স সম্পাদক কিংবা প্রকাশকদের সাথে যোগাযোগ রাখা এবং লেখালেখির ক্ষেত্রে অগ্রজ কবি বা লেখকদের পরামর্শ গ্রহণ করা/নেয়া।
ক্স লেখা যাই হোক, সর্বোপরি উৎসাহিত করা। কারণ, গাইতে গাইতে গায়েন।
পরিশেষে একটি কথা বলতে চাই, যে জাতির সাহিত্য যতবেশি উন্নত, সেই জাতি তত বেশি সভ্য। নিজের জাতিস্বত্তার কথা লিখে যেতে হবে। যেন পরবর্তী প্রজন্ম জাতির এই সময়কার মানুষদের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, জীবন-যাপন, দর্শন, দুঃখ-বেদনা ইত্যাদী বিষয়ে ধারণা পায়।
লেখালেখির ক্ষেত্রে আলাদা করে নারীর কথা বলার একটিই কারণ, সাহিত্যে গারো পুরুষরা বেশ অগ্রসরমান, তাঁরা লেখনীর মধ্য দিয়ে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। কিন্তু সবকিছুতেই একটা ভারসাম্য প্রয়োজন। সাহিত্যেই তাই। পুরুষরা তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে লিখছেন, নারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে নারীরা লিখবেন। পরবর্তী প্রজন্ম যেন এই শতাব্দীর জীবনযাত্রা, চিন্তা-চেতনা, দর্শন বিষয়ে ধারণা পেতে পারে সেই জন্যেই আমাদের লিখে যেতে হবে। সাহিত্যে গারো নারীদের পদচারণা উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পাক এই কামনা করি। পরিশেষে কাজী নজরুল ইসলামের “মায়া মুকুট” কবিতার দুটি লাইন দিয়ে শেষ করছি,
‘ভাঙ্গো ভাঙ্গো এই ক্ষৃদ্রগন্ডি এই অজ্ঞান ভালো
তোমাতে জাগেন হে মহামানব, তাহারে জাগায়ে তোলো। ’
‘প্রমোদ মানকিন- আমার কিছু স্মৃতি।। মিঠুন রাকসাম’
: ২০০৭ সাল ঢাকা শহরের দুই ওয়ানগালা ঢাকা ওয়ানগালা দুভাগ হয়ে......বিস্তারিত
-
Git-bibal ।। Motendro Mankhin
: Git-bibal Bijak-samjak dongja somai ongkuja Migaru-mikopba min.nin minkuja Nang nokchi...
-
প্রমোদ মানকিন- আমার কিছু স্মৃতি।। মিঠুন রাকসাম
: ২০০৭ সাল ঢাকা শহরের দুই ওয়ানগালা ঢাকা ওয়ানগালা দুভাগ হয়ে...
-
স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২৪ লাভ করায় অরন্য চিরানকে সংবর্ধনা
: দেশের সর্বোচ্চ জাতীয় বেসামরিক পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২৪ লাভ করায় অরন্য...
-
তর্পণ ঘাগ্রার একগুচ্ছ গারো লোকছড়া
: 1 Do.o wakki-chongprot. Susumimani mimang kam.o, Wak mat.chu ra.sotana. Bijak-songa...
-
শরৎ ম্রং-এর প্রথম উপন্যাস-শুধু তোমার জন্য
: প্রকাশিত হয়েছে কবি ও গল্পকার শরৎ ম্রং-এর প্রথম উপন্যাস-শুধু তোমার...
-
সেকালের জলছত্র ও গারোদের উত্থান।। মোহন লাল দাস
: সুপ্রিয় পাঠক সবাইকে প্রীতি ও শুভেচ্ছা। আজ থেকে ষাট উর্ধ্ব...
‘Git-bibal ।। Motendro Mankhin’
: Git-bibal Bijak-samjak dongja somai ongkuja Migaru-mikopba min.nin minkuja Nang nokchi......বিস্তারিত
‘প্রমোদ মানকিন- আমার কিছু স্মৃতি।। মিঠুন রাকসাম’
: ২০০৭ সাল ঢাকা শহরের দুই ওয়ানগালা ঢাকা ওয়ানগালা দুভাগ হয়ে......বিস্তারিত