এক.
দুই হাজার একুশ সাল। এই বছরটা অপ্রত্যাশিতভাবে অনেক ঘটনা ঘটছে। যেটি চাওয়ার নয়, যেটি চাইনি, কল্পনা করিনি, বারবার সেটিই হয়েছে। হয়ে চলেছে। এই তো ক’দিন আগে শাওন রিছিল(দাদা)কে নিয়ে স্মৃতিরোমন্থন করেছিলাম। মৃত্যুর কথা শুনে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এখনো বিশ্বাস হয় না যে, শাওন দা যে নেই! আমাদের মধ্যে সাক্ষাৎ কম হয়েছিল। তবে আমরা বন্ধুর মতো মিশেছিলাম। ভালোবাসার কোন কমতি ছিল না।না চাইতেও শাওন’দা চলে গেলো, কত কাজ, কত কবিতা লেখা বাকি ছিল!
নিবিড় মৃ। সেও ব্যান্ড করতো, ড্রাম বাজাতো। অব্যক্ত কষ্ট নিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলো। যে কষ্ট কাউকে বলতে পারতো না,ভীষণ কষ্ট ছিল। তার সাথে আত্নীয়ের সম্পর্ক ছিল।তবে কোনদিন তেমন কথা(হয়নি) হতো না। সৌভাগ্যক্রমে একদিন মহাখালী থেকে ফার্মগেট একসাথে রিক্সায় গিয়েছিলাম। তৎক্ষনাত যা মনে প্রশ্ন জেগেছিল সবকিছুই জিজ্ঞাসা করেছিলাম। ফার্মগেট না পৌঁছানো পর্যন্ত প্রশ্নে বিদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু হায়! সেও চলে গেলো, একজন সম্ভাবনাময় তরুণ চলে গেলো!
আজ ছয় নভেম্বর দুই হাজার একুশ সাল। আজকে থেকে স্বশরীরে নিকসেং আমাদের মাঝে থাকবে না। অতি তাড়াতাড়ি যে মৃত্যু এসে যাবে, কেউ ভেবেছিলো!! ভাবেনি। এমন না চাওয়া ব্যাথা নিতে প্রস্তুত ছিলাম না।তবুও মনের ব্যাথা নিয়েই বিদায় দিলাম। শেষ বিদায়,শেষ দেখা নিকসেং! ভালোবাসা নিও।
যখন তোমাকে শেষবারের মতো দেখতে গিয়েছিলাম। সবাই কেঁদেছে, সেটা কী তুমি দেখেছো?
মাঝে মাঝে ‘সময়’ কে নিষ্ঠুর মনে হয়। আরো নিষ্ঠুর লাগে যখন প্রিয় মানুষটি চলে যায়। আফসোস থাকে শুধু, শুধুই আফসোস। মৃত্যু কী ভালো মানুষকে সহ্য করতে পারে না? তাহলে কেন চলে যায় ভালো মানুষ,তাড়াতাড়ি! অতি তাড়াতাড়ি!
প্রশ্ন জাগে, সম্ভাবনাময়ী তরুণরা কেন চলে যাচ্ছে? কেন? এই দায়ভারটা কার,কাদের!আমরা নিজেরা নিজেদের প্রশ্ন করতে পারি কিনা?
দুই.
অসামান্য প্রতিভার জন্য নিকসেং খুবই জনপ্রিয় ছিল। কে না তাকে চিনতো, তার কাজের কদর যেমন ছিল গুণগত মান তেমনি ছিলো। সময়ের তুলনায় কাজের চাপ থাকতো বেশি। এত কাজ করতো,করেছে,নিজের জন্যই সময় বের করতে পারতো না। এতটা ব্যস্তার মধ্যে দিনযাপন করতো। রাত দিন এক করে কাজ করতো,কাজ শিখতো। তাকে প্রসংশার না করে কেউ থাকতে পারতো না, এমনি কাজের দক্ষতা ছিল।কাজের ক্ষেত্রে কাউকে না করতো না, সবার কাজ করে দিতে চেষ্টা করতো। যখনি কাজের দক্ষতা বাড়লো,যখনি বড় কিছু করার মনোনিবেশ করলো তখনি না ফেরার দেশে চলে গেলো।
এত সম্ভাবনাময়ী উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন। মেনে নেওয়াই যে কঠিন। গারো জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন নক্ষত্র কম আছে, হাতে গোনা ক’জন। যাদের কাজ আমরা দেখেছি, দেখছি। নিকসেং অবশ্যই তাদের মধ্যে একজন। কিন্তু চলে গেলো,খুবই তাড়াতাড়ি চলে গেলো। মেনে নেওয়াই যে কঠিন। তার খুবই তাড়া ছিলো কি!!
তিন.
নিকসেং এর জন্ম নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা থানাধীন বড়ুয়াকোনা গ্রামে (গারামপাড়া)। সে ময়মনসিংহ পলিটেকনিকে পড়ালেখা করতো। কাঁচিঝুলি হোস্টেলে থাকতো। যতবার হোস্টেলে গিয়েছি প্রায়ই তার সাথে দেখা হয়েছে(হতো)। নিকসেং ঘাগ্রা একাধারে ফটোগ্রাফার, ভিডিও এডিটর ও মিউজিশিয়ান ছিলো। আইয়াও ব্যান্ডের ড্রামার ছিল। গিটারও সুন্দর করে বাজাতে পারতো । আরো সবচেয়ে বড়গুণ ছিল “খাঁটি” মানুষ। যাকে বলে বিশুদ্ধ । সবাই যেমন করে তাকে আপন করে নিতো, সেও তেমনি সবাইকে আপন করে নিতো(নিতে পারতো)। তার ব্যক্তিত্ব কারো সাথে তুলোনা হয় না।এমন মিশুক, অল্পভাষী, সবসময়ই চেহারায় হাসি-মাখা মুখ, কাজের প্রতি নিবেদিত প্রাণ,ভালো শ্রোতা। সর্বোপরি মানুষের কল্যাণ,গারো জাতির ভালো চাইতো, জাতির জন্য কিছু করতে চেষ্টা করতো। তার প্রতি কারো কাছে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখি নাই। কিন্তু হয়! সেও অতি দ্রুত চলে গেলো। কাজ শেষ করতে পারলো না। নিজের ইচ্ছা স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে গেলো কোনদিন বাস্তবায়ন হলো না।
উদীয়মান তরুণ প্রতিভাবান নিকসেং ঘাগ্রা যে আর নেই।মানতে না চাইলেও, বাস্তবতা মানতে বাধ্য করে। ৬ নভেম্বর শনিবার ভোর ৫টার দিকে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। সে মেনিনজাইটিস (Meningoencephalitis)-এ আক্রান্ত হয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউরোসাইন্স & হসপিটালে চিকিৎসাধীন ছিলো।
চার.
মৃত্যুর কিছুদিন আগেই খোঁজখবর নিয়েছিলাম। ডাক্তার বলেছিল ভালো হয়ে যাবে। সে খেতে চাই এখন,মানুষ চিনতে পারছে। কেউ কী বুঝতে পেরেছিল(!)এই তার শেষ বার খেতে চাওয়া,শেষ বারের মত প্রিয়জনের মুখ দেখা,আমি জানি না।
আমি জানি না, তোমার(নিকসেং) মত গারো জনগোষ্ঠীতে এমন সম্ভাবনাময়ী তরুণ প্রতিভা সম্পন্ন লোক আছে কিনা। তোমাকে ছাড়িয়ে যেতে জন্ম নিয়েছে কিনা! তোমার মত দক্ষ কারিগর গারো জনগোষ্ঠীতে কত বছর পরে জন্ম নিবে। তোমাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা। তোমার মত হবে কিনা,আমি সত্যিই জানি না।
পাঁচ.
আমাদের পরিচয় অনেক বছরের,হয়তো ছয় সাত বছর। অনেকবার,অনেক জায়গায় সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছে। স্মৃতিরোমন্থন করলে অনেক কিছুই বলতে পারি। তবে আজকে থাক। কিছু কথা না বললেই নয়, আমরা ছিলাম সমবয়সী। যখন দু্ষ্টমি করে ছোটভাই ডাকতাম, তখন রাগ করতো। ছোটভাই ডাকতে মানা করতো,ডাকতে বলতো “বুনিং”(বোনের বড় ভাই)। আমাদের বুনিং এর সম্পর্ক ছিলো। দু’জন দু’জনকে বুনিং বলে সম্বোধন করতাম। সে যার সাথে মিশতো সবাই তাকে আপন করে নিতো,সেও আপন করে নিতো। আমাদের মধ্যেও ভালো(গভীর) সম্পর্ক ছিল। ফাইজিলামি করে আমি এবং শোভন ম্রং একদিন বলেছিলাম,”আমাদের বিয়েতে তোমাকেই কাজ করতে হবে।মরে গেলেও কবর থেকে উঠিয়ে এনে কাজ করাবো”। সেই কথা মনে পড়লে,এখন নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে। বিয়ে ছবি তোলা হলো না ঠিকই,তবে তার একটি ছবি তোলা আছে। ২০১৯ সালে প্রেমিকার সাথে ছবি তুলে দিয়েছিলে, সেটাই কী সান্ত্বনা নিকু?
আরো অনেক কাজ বাকি ছিল। সেটাও করা হলো না।দেখ্যো,সামনে শ্যাম দার বিয়ে ছিলো। এখন কে করবে কাজ? তোমার কাজ করার কথা ছিল নিকু। কিন্তু তুমি আজ নেই। কখনো ফিরেও আসবে না।সবাই কতটা আবেগ আপ্লুত, মনের ব্যাথা নিয়ে আছে, তোমার কী সেটা জানা হবে কোনদিন? তোমার চলে যাওয়া যে মেনে নেওয়ার মত নয়।
ভালো মানুষ কী তাড়াতাড়ি চলে যায়? অপ্রত্যাশিত ভাবে চলে যায়!! নিকসেং তোমারো কী তাড়া ছিল? খুব তাড়া!!কি এমন তাড়া ছিল যে, তোমার যেতেই হলো?
তোমার চলে যাওয়া কেউ মেনে নিতে পারেনি। কেউ না। যদি কোনদিন গারামপাড়া গ্রামে যাওয়ার সুযোগ হয়।তোমার সাথে দেখা করতে যাবো। বুনিং বলে ডাকবো।সাড়া দিও। আ-মৃত্যু তোমাকে ম্মরণে রাখতে চাই।
ছয়.
পাঁচ তারিখ, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ১১তম ব্যাচের চড়ুইভাতি ছিলো। আমরা যতজন ভর্তি হয়েছিলাম তার মধ্যে বেশিরভাগ উপস্থিত ছিলাম। অনুষ্ঠান,খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে হতে প্রায় ১২টা বাজে।মেয়েদের কে তাদের মেসে রেখে আসতে আসতে রাত ১ টা বেজে যায়।রুমে আসতে আসতে, ঘুামাতে অনেক দেরি হয়। বন্ধুদের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে,শেষ বারের মত একসাথে মিলিত হয়েছিলাম। আমি জানি, এইটাই ব্যাচের ফরমার্লিটি ভাবে একসাথে সময় কাটানো।আর কোনদিন সম্ভব হবে কিনা, জানি না।হয়তো সম্ভব!মনের আনন্দে ঘুমাতে গিয়েছিলাম। যখনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন দরজায় কে যেন আঘাত করেছে। নাম ধরে(জাডিল) ডাকাডাকি করলো অনেক বার। আমি ভেবেই নিয়েছিলাম ৯-১০ টা বাজে(হয়তো)। কোন দরকারে এসেছে বোধয়। রাসং দা দরজা খুলে দিলো। তখন র্শীষ’র গলা শুনতে পেলাম।কাঁদতে কাঁদতে এসে বলছে,নিকসেং আর নেই। আমি সবকিছু ঘুমের ঘোরে শুনতে পারছিলাম। কানে শুনে বিশ্বাস হচ্ছিল না। উঠে জিজ্ঞাসা করলাম, কবে মারা গেছে। জানলাম ভোর পাঁচ টায়। আমি, রাসং’দা র্শীষ চুপ করে বসে থাকলাম। আমাদের তিন জনের মধ্যে কোন কথা ছিল না, নিশ্চুপ হয়ে বসে ছিলাম। আমরা কেউ কথা বলছিলাম না,কারণ মেনে নিতেই পারিনি। কেউ কল্পনাই করেনি যে, এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে। কেউ না।আমাদের ঘুম তখনি শেষ। আমরা অনেকক্ষণ বোবা হয়ে বসে ছিলাম।
আমরা খুবই অস্থির ছিলাম।কারণ নিকসেং কে ময়মনসিংহ শহরে কিছুক্ষণের জন্য রাখবে কিনা, শেষ বারের মত দেখতে পাবো কিনা। যোগাযোগের পর জানতে পারলাম,ভাটিকেশর মিশনে নামাবে। আমরাও দ্রুত ক্যাম্পাস থেকে অনেক জন রওনা দিলাম। গিয়ে দেখলাম শ্যাম দা,যাদু দা বসে আছে। পরবর্তীতে আরো অনেকে আসলো। আমরা অপেক্ষা করলাম।কিছুক্ষণ পরেই গাড়ি আসলো। নিকসেং কে নামানো হলো। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলাম। এই যে শেষ দেখা নিকসেং ( বুনিং) এর সাথে,তাকে তুমি স্বর্গ দিও।জানি স্বশরীরে আর দেখা হবে না। তবে নিকসেং থাকবে আমাদের অন্তরে।
নিকু কে হাত নেড়ে বিদায় দিলাম। শেষ দেখা। শেষ বিদায়।
ভালো থেকো বুনিং। পরপারে হয়তো আবার বুনিং ডাক শুনতে পাবো..বুনিং..
সাত.
ভালোবাসি নিকু বুনিং..
ভালোবাসা নিও।
ছবি সংগৃহীত: নিকসেং ঘাগ্রা
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত
-
১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ...
-
রে রে : হায়রে আমার কাঞ্জিয়া ।। নীলু রুরাম
: সমর সাংমার রেরে নিয়েই শুরু করি তবে একটু আলাদা। আমাদের...
-
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিরাপদ ব্যবহার ।। জাডিল মৃ
: এক. সময় স্রোতের সাথে আবাহমান ছুটে চলা প্রযুক্তির উন্নতি, মানব...
-
বর্তমান সময়ের তুমুল জনপ্রিয় শিল্পী দিশন অন্তু রিছিলের জন্মদিন আজ
: বর্তমান সময়ের তুমুল জনপ্রিয় শিল্পী দিশন অন্তু রিছিলের জন্মদিন আজ।...
-
বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবতোষ যেত্রা আর নেই
: হালুয়াঘাট উপজেলার ৪নং সদর ইউনিয়নের কালিয়ানীকান্দা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা পাস্টার...
-
কেনিয়ার কৃষকরা হাতি তাড়াচ্ছে মৌমাছি দিয়ে
: কেনিয়ায় হাতির তাণ্ডব থেকে ফসল রক্ষায় ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে কৃষকরা।...
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত