সভ্যতার যে ক্রমর্বধমান ইতিহাস সেই ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে পৃথিবীর বহু জনগোষ্ঠী বা জনগোষ্ঠীর নিজস্বতা বিলুপ্ত হয়েছে । পৃথিবীর যে ধারায় এই এক বিংশ শতাব্দীতে চলমান রয়েছে যেখানে পুজির বিকাশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ভাষাগত আগ্রাসনের দৌড়াত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এতে করে জনসংখ্যায় তুলনামূলক কম জনগোষ্ঠীগুলোর টিকে থাকা মুসকিলে হয়ে পড়েছে ।
ভৌগলিক অবস্থার বিচারে এবং বাংলাদেশের জাতিগত ইতিহাস দেখলে বোঝা যাবে বাংলাদেশে বহুজাতি সত্বার বিকাশ একটা দীর্ঘ সময় ধরে হয়েছে । কিন্তু জাতি রাষ্ট্রের তথাকথিত যে বিকাশ সেই বিকাশে এই জনগোষ্ঠী গুলোর বিকাশ তো দূর বরং সাংস্কূতিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক শোষণ এবং নিপিড়নে নিজের অস্তিত্ব ভুলতে শুরু করেছে বহু জনগোষ্ঠী । বাংলাদেশে বসবাসরত যে সকল জনগোষ্ঠীগুলো নিজেদের সঠিক অস্তিত্ব ভুলতে বসেছে তাদের মধ্যে একটি জনগোষ্ঠী হলো গারো জনগোষ্ঠী । যারা নিজেদের ভাষায় নিজেদের মান্দি বলে পরিচয় দিতে এক সময় পছন্দ করতে । আমরা যদি আলোচনার মূল বিষয়ের দিকে নজর দেয় তাহলে সব থেকে জরুরি যে সমস্যার দিকে নজর দিতে হবে সেইটি হলো এই জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের অবস্থানগত জায়গায় ।
জাতিগত পরিচয়কে অক্ষত রাখার প্রথম ধাপ হিসেবে দাঁড়ায় অনেকাংশে নিজের সংস্কৃতির চলমান ধারাকে মুক্ত ভাবে বইতে দেওয়া। কিন্তু একটি রাষ্ট্র যখন জাতি রাষ্ট্রের ধারনাকে লালন করার মধ্যদিয়ে অন্য জাতির অস্তিত্বকে অস্বীকার করবে তখন সেই জাতি গুলোর জাতি গত এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ কতটা বহমান থাকবে এবং নিজেদের আত্মপরিচয় কতটা সম্মুন্ত রাখতে পারবে সেইটা আলোচনার বিষয় । বাংলাদেশে রাষ্ট্রে সব থেকে বড় যে সমস্যা পরিলক্ষীত হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো জাতি গত সমস্যা ।বাংলাদেশে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠীর বাইরে যেসকল ভিন্ন ভিন্ন জাতি গুলো রয়েছে তাদের জাতি গত পরিচয় রাষ্ট্র কিভাবে নির্ধারণ করবে এবং এই নির্ধারনের দায়িত্ব শুধু রাষ্টে্রর কিনা । বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোতে এই জনগোষ্ঠীগুলোকে জাতি গত পরিচয় দিতে নারাজ ।রাষ্ট্র নানা সমসয়ে নানান নামে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে যেখানে দেখতে পাবেন ট্রাইবাল ,উপজাতি ,ক্ষুদ্র জাতি সত্বা, ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী, জুম্ম,শরনার্থীর মত প্রায় ১৬ টি নামে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে । জাতি সত্বা জাতিগত পরিচয় নিয়ে রাষ্ট্রের যে রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করেছে যার ফলে এই সকল জনগোষ্ঠীগুলোর জাতিগত পরিচয় আজ নানা ভাবে সংকটে ।
রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট জাতিগত্ব পরিচয় নিয়ে যে টানাপোড়ন তৈরি হয়েছে এর মাঝে নতুন করে গারো জনগোষ্ঠীর জাতিগত্ব পরিচয় কি হবে সেই বিষয় নিয়ে র্দীঘদিন ধরে একটা রেশ টানার প্রক্রিয়া তৈরি হয় বিভিন্ন মিশনারি প্রতিষ্ঠান গুলোর আগমনে ।যদিও এই আলোচনার খাতিরে এই জাতি গত পরিচয় সংক্রান্ত সমস্যায় মিশনারিদের অবস্থান নতুন বলা হলেও এর যে প্রক্রিয়া তা শুরু হয়েছে গারো জনগোষ্ঠীগুলোর মাঝে ধর্মীয় বিস্তারের মধ্য দিয়ে । একটি জনগোষ্ঠীর বিকাশের ধারায় সংস্কূতিগত পরিচয় অত্যন্ত জরুরি এবং অর্থ বহন করে । সংস্কূতিকে বৃহৎ অর্থে ব্যাখা বা বিশ্লেষন করলে যা দেখা যাবে তা অনেকাংশে এমন শুধু মাত্র ধর্মকে কেন্দ্র করে সংস্কূতির বিকাশ হয় না ।বরং সংস্কূতির অন্যান্য কাঠামোকে কেন্দ্র করে সেক্টরকে কেন্দ্র করে ধর্মের বিকাশের একটি জায়গা থাকে । বা বলা যায় অনান্য সেক্টর বা কাঠেমোর মত সমান্তরাল ভাবে সংস্কৃতিতে ধর্মের বিকাশ পরিলক্ষীত হবে। কিন্তু আমরা যদি বাংলাদেশে বসবাসরত গারো জনগোষ্ঠীর মধ্যে মিশনারিদের বিকাশ বা উথ্থানের ইতিহাস দেখতে যায় তাহলে একটু চোখ রাখতে হবে সাধু যোসেফ ধর্মপল্লী রানিখং এর দিকে । ইতিহাস বলছে বাংলাদেশে গারো অঞ্চল গুলোতে মিশনারদের বিকাশের যে ধারা তার শুরু হয় অনেকটা এই ধর্মপল্লীর হাত ধরে ১৯০৯ থেকে ১৯০১২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ।রোমান ক্যাথলিকদের এই বিকাশের আগেও ১৮৯০ শতকের দিকে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাপ্টিস মিশনারির বিকাশ যা এখন গারো ব্যাপ্টিস কনভেনশন নামে পরিচিত । সুসং র্দূগাপুর অঞ্চলে গারোদের মাঝে ধর্ম বিস্তারের করতে গিয়ে এই দুই মিশনারির মধ্যে ও মত পার্থ্যকের বিরোদ্ধ দেখা যায় । যার ফলে আলাদা আলাদার স্কুল কলেজ বিভিন্ন হোস্টেল এবং মিশন কেন্দ্রীক ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি হয় । যার ফলে গারো জনগোষ্ঠীর মাঝে ধর্মীয় পরিচয়ের যে সমস্যা তার সুত্রপাতের সময় কাল আমরা ওই সময়কেই ধরতে পারি । মোটাদাগে মিশনারিদের আগমনে গারোদের জাতিগত যে ধর্মের পরিচয় নিয়ে দন্দের সুত্রপাত বললেও পুরোলেখায় বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করব ।
শুধু গারো জনগোষ্ঠীর মাঝে মিশনারিদের বিকাশ না দেখে পুরো বিশ্ব জুড়ে যে প্রক্রিয়ায় মিশনারির বিকাশ হয়ছে সে দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে মিশনারিদের বিকাশ হয়েছে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে । যে অঞ্চল এবং যে জনগোষ্ঠীর মাঝে মিশনারিরা প্রথম এসেছে তাদের কাছে সরাসরি ধর্মের কথা নিয়ে আসেনি বরং প্রথমে স্থাপন করা হয়েছে চিকিৎসালয় এবং সেই জনগোষ্ঠীর মাঝে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে প্রকূতি কেন্দ্রিক রোগমুক্তির যে ধ্যান ধারনা তা মিথ্যা এবং ভুল । ঠিক একই ভাবে মিশনারির আওতায় বিভিন্ন স্কুল স্থাপন করা হয়েছে জনগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব সামাজিক শিক্ষা কাঠামোর বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে ধর্মীয় শিক্ষা এবং প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা । এত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিকাশ হলেও নিজস্ব সামাজিক শিক্ষা কাঠামোর বিকাশ দেখা যায় নি ।
আলোচনার বিষয় হলো এই প্রক্রিয়া এই জনগোষ্ঠীগুলোর আইডেন্টিটিতে কি প্রভাব তৈরি করেছে । পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দারবানে কাপ্রু ম্রো পাড়ায় ম্রোদের আদির্ধম ক্রামায় বিশ্বাস করে এমন পরিবারের সংখ্যা দেখা মিলবে ৪টি থেকে ৫টি যেখানে সদ্য বিস্তার লাভ করা খ্রিস্টিয়ার র্চাচ ভুক্ত ম্রো পরিবারের সংখ্যা ৪০ টির মত । দুটো ধর্মের বিশ্বাসীরা রবিবারে নিজস্ব উপাসনালয়ে যাচ্ছে এবং যাওয়ার পথে উপসানালয়কে নির্দিষ্ট করে বলতে গিয়ে বলতে হচ্ছে ক্রামা কিঙং খ্রিস্টার কিঙং । একই সংস্কুতি ভুক্ত একই পাড়া ভুক্ত একই জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় পরিচয় হয়ে যাচ্ছে ভিন্ন । ঠিক একই বিষয় দেখা মিলবে বান্দারবানের ত্রিপুরা এবং খাগড়াছড়ির ত্রিপুরার মধ্যে । যেখানে সনাতান ধর্মের বিকাশের সাথে সাথে মিশনারিদের বিকাশ হয়েছে এবং নির্দিষ্ট পরিচয়ের জায়গা থেকে সরে এসেছে । কিন্তু গারো জনগোষ্ঠীর প্রায় অনেকাংশে দেখা যায় মিশনারি র্চাচ ভুক্ত । মধুপুর বন অঞ্চল ছাড়া কোথাও আদি ধর্ম সাংসারেক বিশ্বাসীদের দেখা যায় না । যার ফলে গারো দের যে বন কেন্দ্রীক বিভিন্ন মিথ রয়েছে তার চর্চা দেখা যায় না । অথচ গারোদের সংস্কূতির একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে বন কেন্দ্রিক মিথ ।
মেঘালয়ের গারো পাহাড়ে অবস্থিত বালপাকরাম নিয়ে মিথ
বালপাকরাম মানে আত্মার ভূমি । যেখানে গারোদের পূর্বপুরুষদের যে আত্মা সেই আত্মা মূত্যুর পর এই পাহাড়ের গিরিপথে অবস্থান করে । বালপাকরামে আত্মার অবস্থান খুব বেশি সময়ের জন্য না ,বালপাকরাম পাহাড়ের চূড়ায় যে শস্য ফলে সেই শস্য খেয়ে অন্তিম যাত্রা পথে একটু জিরিয়ে নেয় মূত আত্মা । র্পূবপুরুষদের আত্মার আর্শীরবাদে ’মি মিসি’ মানে জুমের ধান আরো ভালো ফলন হবে তাই বালপাকরামের চুড়ায় ফসল রেখে দেওয়া হয় এইসব আত্মার জন্য । এতে বালপাকরাম পাহাড় ফসলে স্বয়ং সর্ম্পূণ থাকতো ।যার ফলে বালপাকরাম পাহাড়ের অন্যান্য প্রাণিদের কখনো খাদ্যের অভাব হয়নি । বালপাকরামকে কেন্দ্র করে যে গারো গ্রাম গুলো রয়েছে সেখানে বাস করা গারোরা মনে করে এই বালপাকরাম ছেড়ে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই কারণ এই বালপাকরামে রয়েছে পূর্বপুরুষদের আত্মার অবস্থান স্থল এবং নিজেদের মাহারি বা আত্মীয় স্বজনদের সাথে মূত্যুর পর শেষবার মিলিত হওয়ার সুযোগ ।বন কেন্দ্রিক এই মিথ গুলোর মধ্য দিয়ে হাজার বছর বনকে আকরে বাচাঁর প্রক্রিয়া তৈরি হয় । এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গারোরা বছরে পর বছর ধরে নিজেদের সংস্কূতির বিকাশ করেছে ।
চিৎমাং পাহাড়ের চূড়া নিয়ে গারোদের মিথ
চিৎমাং পাহাড়ের চুড়া হলো গারোদের অন্তিম আত্মার শেষ স্থল । যেখানে বালপাকরামের পর এই পাহাড়ের চুড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে আত্মারা । চিৎমাং এর দায়িত্বে থাকেন একজন রাজা নাম ওয়াইমং । তিনি হলেন গারোদের সকল দেবতার গুরু । মূত্যুর পর তিনি সকল আত্মার বিচার করবেন এবং পাপের উপর র্নিভর করে পূথিবীতে আবার পাঠাবেন । গারোদের পাপ পূণ্য নিধারণ হবে প্রকূতিকে কতটা লালন করতে পেরেছে তার উপর ।
বনের ভিতর ঘর তৈরি নিয়ে গারোদের মিথ
গারোদের মিথ জুড়ে স্বপ্নের একটা বিশাল ভুমিকা বা জায়গা রয়েছে । গারোরা মনে করে বন বা জমি মাটি তার শক্তি মানুষের সাথে ভাগ করে । যার জন্য নতুন বাড়ি তৈরির আগে গারোরা যখন নতুন কোনো জায়গা ঠিক করে তখন সেই জায়গার বন বা মাটিকে তাদের শক্তিকে আগে গারোদের হাতে হস্তান্তর করবে । এবং জায়গা নির্দিষ্ট করার পর আগে এই শক্তির কাছে পূজার মধ্য দিয়ে জানতে চাওয়া হয় এই জায়গা বাড়ির জন্য উপযুক্ত কিনা । পুরো ব্যাপার টায় হয়ে থাকে স্বপ্নের মাধ্যমে ।
বন্য পশু নিয়ে গারোদের মিথ
জাংগ্গিনি নকগিপ্পা জামানি বিয়াম্বি মানে জীবন ও নিঃশ্বাসের উৎস যিনি তিনি পূথিবীর কোনো প্রাণীকে ভক্ষণ করার জন্য সূষ্টি করেননি । প্রাণি জগতের সকল প্রাণ কে সম্মান করার জন্য তিনি নির্দেশ দিয়ে বলেন যদি কেউ বন্য প্রাণি কে ক্ষতি না করে তাহলে দেবতা খালখামে-খালাগ্রা সকল প্রকার বন্য প্রাণির হাত থেকে গারোদের রক্ষা করবে ।গারোদের আদিধর্ম সাংসারেকদের হাবাহুয়া বা জুম চাষের শুরুতে মিসি সালজং কে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে । যেখানে মিসি সালজং হলো গারোদের সকল প্রকার ফল-ফসলের ও সম্পদের দানকারী দেবতা সাংসারেকরা নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় যে ওয়ানগালা উৎসব পালন করে তা এই দেবতাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে । প্রকৃতি কেন্দ্রিক ,বন ,পাহাড় কেন্দ্রিক ধ্যান ধারণ বাঁচার সংগ্রাম গারোদের আজকের না বহু বছর ধরে পালন পালন করে আসছে । যারফলে বালপাকরাম গিরি রক্ষা ,বন রক্ষা ,গাছ রক্ষার মত বিষয় গারোদের সাংস্কূতিক ধ্যান ধারনে চলে আসছে র্দীঘ বছরের মধ্য দিয়ে ।
প্রকূতিবাদী এই সাংসারেক ধর্মের অন্যান্য দেবদেবীর নাম এবং উপাসার প্রক্রিয়া লক্ষ্য করলে দেখা মিলবে প্রকূতির সাথে এই জনগোষ্ঠীর কতটা মিলন ।
সাংসারেকদের বিভিন্ন দেব-দেবীর নাম
তাতারা রাবুগা – পৃথিবীর সকল প্রকার প্রাণির ও প্রাণের সৃষ্টিকর্তা। নস্তু-নপান্তু – যাকে বলা হয় সকল প্রকার প্রাণির সৃষ্টি কাজে সাহায্যকারী দেবতা। বিশাল প্রাণের সূষ্টিতে তাতারা রাবুগাকে সাহায্য কারী দেবতা । মা’চ্চি -নস্তু-নপান্তুর স্ত্রী বা সৃষ্টি কাজে সাহায্যকারী দেবী।
মিসি সালজং বা সালগ্রা – সাংসারেকদেক সব থেকে গুরুত্ব পূর্ন দেবতাদের একজন যিনি সকল প্রকার ফল-ফসলের ও সম্পদের দানকারী দেবতা।
সুসিমেমা দেবী -গৃহের খাদ্য শষ্য মজুদের রক্ষাকারী দেবী।
রুক্ষীমেমা -আহারের জন্য প্রস্তুত খাদ্যের রক্ষাকারী দেবী। কেহকেহ শূচি বায়ূ দেবীও বলে।
চুরা বুদি : ক্ষেতের ফসল রক্ষাকারী দয়ালু দেবতা।
গয়রা বা গোয়েরা – বজ্র বিৎদ্যুতের দেবতা। মানুষের অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষাকারী দেবতাখালখামে-খালাগ্রা -দেবতা গয়রার ছোট ভাই। আচিক মান্দিদের বন্যপশুর আক্রমণ থেকে রক্ষাকারী দেবতা। আকস্মিক দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষাকারী দেবতা ।
নকনি মিদ্দে-রংদিক মিদ্দে -চাউল যে পাত্রে সংরক্ষণ করে।
মিসি সালজং বা সালগ্রা, সুসিমেমা ও রুক্ষীমেমা দেবতাদের অনুগ্রহ ও আশীর্বাদ ছাড়া মানুষের জীবন ধারণ অসম্ভব। তাই একে তিন দেবতার হাত বলে।
সুসুমি দেবী- বিদ্যা, বুদ্ধি ও কুটনীতি ধারক ও বাহক। আচ্চু আম্বীদের মুখে শোনা এই সুসুমি দেবী, অন্ধত্ব, পঙ্গুত্ব, বোবা, কালা প্রভৃতি জরা ব্যধির কারণ। পৌরাণিক কাহিনিতে পৃথিবী সৃষ্টির জন্য তাতারা রাবুগা এই দেবী সুসুমির পরামর্শ গ্রহণ করেন। পৃথিবী সৃষ্টির পর নিজেদের সাদৃশ্যে মানুষ সৃষ্টির জন্যও এই দেবীর পরামর্শক্রমে সকল দেবতাদের কাছে ডাকেন সৃষ্টি কর্তা তাতারা রাবুগা। পরে মানুষ সৃষ্টির পর পৃথিবীতে মানুষের বাস উপযোগী স্থার নির্ধারণের জন্য দেবী সুসুমিকেই এই পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। আচিক মান্দিদের সব ধরণের বিদ্যা শিক্ষা দিবার জন্যও এই দেবী সুসুমিকেই আবার পৃথিবীতৈ পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
নাওয়াং : মৃত ব্যক্তিদের আত্মাদের পরপারের রাস্তার পাহাড়াদার। কথিত আছে, মৃত্যুর পর মানুষের আত্মা নাওয়াংকে পয়সা, টাকা না দিলে রাস্তা পার হওয়া যায় না। তাই আচিক মান্দিরা মৃত ব্যক্তির হাতে টাকা গুজে দেয়।
আসিমা-দিংসিমা -সুসুমি দেবীর মা। পৃথিবীর শান্তি রক্ষাকারী দেবী। কোন প্রকার প্রাণির বলি সে পছন্দ করে না। তার জন্য কোন ফল উৎসর্গ করলেই সে পরিবারে, গ্রামে শান্তি প্রদান করে।
টংরেংমা – ব্যক্তিকে সাহস দানকারী ও গৃহে শান্তি রক্ষাকারী দেবী।
আল্লেমী – সব দেবীদের রাণী।
মেগাপাফিয়া – শিশুদের সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষাকারী দেবী।
চু রাশি – শিশুদের অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষাকারী দেবতা।
আন্নিং – শিশুদের মাতৃগর্ভ থেকে বোবা, কালা, অন্ধত্বের হাত থেকে রক্ষাকারী দেবী। চাগব : শিশুদের শয়তানের কু নজর থেকে রক্ষাকারী দেবতা।
চি গিচ্ছাক -বাত রোগের আরোগ্যকারী দেবতা।
ওয়াল গাথ – যুদ্ধে আঘাটের ব্যথার আরোগ্যকারী দেবতা জগু -ফুসফুসের পীড়ার আরোগ্যকারী দেবতা।
সালবামন -মাথা ব্যথা ও চোখের পীড়ার আরোগ্যকারী দেবতা।
উদুম মিদ্দে -পেটের পীড়ার আরোগ্যকারী দেবতা।
নচীডু-মারুচাং -পাতাল পুরীর রাজা দেবতা। ভূমিকম্প, ভূমিধ্বস থেকে মানুষকে রক্ষাকারী।
চিরিং চিমিট -পাতাল রাজার স্ত্রী দেবী। পাহাড়ের ঝর্ণার জল দানকারী দেবী।
মনজার -জীবন্ত ছোট পাথর। মানুষ সৃষ্টির জন্য অন্য গ্রহের মাটি পিঠে বহণ করে আনাতে সেও পাথর হয়ে যায়।
ডিনজার -জীবন্ত ছোট পাথর। মানুষ সৃষ্টির জন্য অন্য গ্রহের মাটি পিঠে বহণ করে আনাতে সেও পাথর হয়ে যায়।
নরে চিরে, কিমরে বকরে : বৃষ্টির দেবী। বোন জাসকো -অরণ্য দেবতা। বনের সমুদয় প্রাণির রক্ষাকারী দেবতা।
গান্দো -অরণ্য দেবী। বোন জাসকের স্ত্রী।
দারিচিক মিদ্দে – মানুষের অঙ্গ-প্রতঙ্গ তৈরিকারী ও স্ত্রী লোকের যৌন রোগের আরোগ্যকারী দেবী।
রুরুবে খিন্নাসে -মানুষের নারী ভুরী, ফুসফুস, যকৃৎ, কিদনী তৈরিকারী ও এই সব রোগের আরোগ্যকারী দেবী।
জারুমে আজাবাল : বায়ু দেবতা।মিকখা টেম্মা স্টিল রংমা – ঘূর্ণি ঝড়ের দেবতা।
মিসি আপিলফা -মাটির উর্বরতার দেবতা।
সালজং গালাফা -ধান ক্ষেতের পাহারাদারের রক্ষক।
দিম্মেং কককেং – নব দম্পতিদের আশীর্বাদ দানকারী।
দিম্মেং- আদম ও কককেং- হবা। তোয়ারা নাংগাপা -মুর্ছা যাওয়া থেকে রক্ষাকারী।
বিদাউই মিদ্দে -সূতিকা রোগের আরোগ্যকারী দেবী।
বাংলাদেশে মিশনারিদের আগমনের পরবর্তী সময়ে গারোদের হাজার বছর ধরে লালিত প্রকূতি কেন্দ্রিক যে বিশ্বাস সেই বিশ্বাস থেকে সড়ে এসে চার্চ কে কেন্দ্র করে শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহ তৈরি হয়েছে । এই আগ্রহ তৈরির সাথে সাথে নিজস্ব চিন্তার জায়গা থেকে শুরু করে নিজস্ব খাদ্যবাস থেকেও অনেক দূরে অবস্থান করছে গারো জনগোষ্ঠী । বন কে কেন্দ্র করে খাদ্য সংগ্রহের যে ধারনা, বনকে আকড়ে ধরে বাঁচার যে তাগিদ ,সেই তাদিগ সাংসারেক বিলুপ্ত হওয়ার সাথে সাথে বিলীনের পথে । আব্রাহামিক ধর্মের চর্চায় সকল সূষ্টির মালিক স্রষ্টা এবং স্রষ্টায় শেষ কথা । যার ফলে সূষ্টির অন্যান্য প্রাণের সম্ভারকে বাইপাস করে মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়ার যে প্রক্রিয়া তা চলমান রয়েছে । একেইশ্বরবাদী ধ্যান ধারণায় গারোদের বন পাহাড় কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া দেব দেবীর ধারণা খারিচ হয় এবং ইতিহাসের পাতায় স্থান হয় বিভিন্ন প্রেত্মার নামে ।
গারোদের নিজস্ব গান্দাবারা রীতি ভেঙে পুঁজির সাথে পরিচয়
পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক রীতি চালু আছে যেখানে দেখা যায় সাময়িক ভাবে কোনো ব্যক্তি বা পরিবার কৃষি কাজের জন্য অকুলান হয় তখন একজন ব্যক্তি বা এক পরিবারের শ্রম ধার দেওয়া হয়। বৃদ্ধ বা অক্ষম লোক রয়েছে এমন পরিবার কে সামর্থ্যবান বয়স্ক নর নারী তাদের একদিনের শ্রম দান করে। রোগী, গর্ভবতী স্ত্রীলোক এবং সন্তান প্রসবের পর নতুন মা’কে খাদ্য প্রদান করে। এই রীতি কে ‘মালেইয়া’ রীতি বলা যায়। যা মূলত জুম চাষের উপর নির্ভর সমাজ বা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায়৷
একই ধারার প্রচলন গারো জনগোষ্ঠীর মাঝে র্দীঘদিন ধরে প্রচলিত যাকে বলা হয় “ গান্দাবারা” । এই গান্দাবারা রীতিতে পুরো গ্রামের লোক এক এক করে সবার জমির ফসল কেটে দেওয়ার কাজ করে বিনা পারিশ্রমিকে । যে বাড়ির ফসল কাটা হয় সেই বাড়িতে কাজ শেষে সন্ধ্যা বেলায় সবাই মিলে আহার গ্রহন করা হয় । কিন্তু সাংসারেক ধর্মের বিলুপ্ত এবং আব্রাহামিক ধর্মের বিকাশ বা মিশনারিদের উথ্থানের ফলে মার্ক্সয় তত্ব মতে পুজির বিকাশ এবং পুজির বিকাশের সাথে সাথে শ্রম ও মজুরির অসম বন্টন সুত্রপাত হয় এই জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরে ।
মিশনারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরির জন্য বূহৎ পুজির সাথে এই জনগোষ্ঠীর পরিচয় এবং দানবাক্স নামক তত্বের উদ্ভব আস্তে আস্তে জনগোষ্ঠীর নিজস্ব অর্থনৈতিক বা বিনিময় কাঠামোকে ভেঙে নতু্ন কাঠামো তৈরি করে । ধর্মীয় ধ্যানকে সামনে রেখে শ্রম এবং মজুরির অসম বিকাশ পুরো কাঠামোকে ভেঙে নতুন কাঠামো তৈরি করে ।
বিশুদ্ধতার প্রশ্নে সাংসারেক
সাংসারেক কামালদের কাছে লোকগল্প আকারে শুনা যায় এক দম্পতি যারা মধুপুরের বনকে কেন্দ্র করে বাস এবং সাংসারেক ধর্মে বিশ্বাস করতো । কিন্তুর দম্পতির স্ত্রী খ্রিষ্টিয়ার হয়ে যাওয়ার পর সংসার ত্যাগ করে নিরুদেশ গমন করেন ।জাতির বিশুদ্ধতা ,সংস্কূতির বিশুদ্ধতায় আন্তর্ধমীয় বিবাহ বা আন্ত সংস্কূতি মিশ্রনের একটি ভয় চেপে ধরতে শুরু করে গারো জনগোষ্ঠীকে ।
গারো জনগোষ্ঠীর র্দীঘ দিনের নিজস্ব জাতির বিশুদ্ধতা রক্ষার রক্ষনশীল প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন দেখা যায় সাংসারেক বিলুপ্তির পর । গারো জনগোষ্ঠীর বাইরে সাংসারেক বিশ্বাস যেমন অন্য জনগোষ্ঠীরা করে না । তেমনি অন্যান্য জাতি সত্তা যাদের পুরো সংস্কূতি কাঠামো গারো জনগোষ্ঠীর সংস্কূতি কাঠামোর বিপরীতে তাদের সাথে একত্রিভুত হওয়া এবং হয়ে শক্তি বূদ্ধির চেষ্টা তৈরি হয় ধর্মীয় পরিচয়কে কেন্দ্র করে । যার ফলে পিউর ব্লাড বলে যে থিউরি এক সময় প্রচলন ছিলো তার পরিবর্তন হয় । নিজেকে গারো বলে পরিচয় দেওয়ার বাইরে নিজেকে খ্রিষ্টিয়ান বলে পরিচয় দেওয়ার প্রবল আর্কষন বূদ্ধি পায় । মিশনারিদের আগ্রাসন মুখি ধর্মের বিকাশের সাথে একই ধর্মের ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় পরিচয়কে জাতি গত পরিচয়ের উর্ধে নেওয়ার পূথিবী ব্যাপী চেষ্টায় গারো জনগোষ্ঠী সামিল হয় ।এবং পুরা প্রক্রিয়া গারো জনগোষ্ঠীকে যেভাবে চারপাশ থেকে আস্তে পিস্টে ধরেছে এতে রাষ্ট্র কর্তূক চাপিয়ে দেওয়ার বিভিন্ন নামে বেনামে পরিচয় এবং একই সাথে নিজস্ব ধ্যান ধারণা চিন্তার বাইরে ধর্মীয় পরিচয় পুরো জনগোষ্ঠীর আইডেন্টিটির মাঝে তৈরি করেছে সংকট । গারোরা আসলেও গারো নাকি উপজাতি নাকি খ্রিস্টীয়ান?
তথ্য সূত্র :-
গারো অঞ্চলে ক্যাথলিক মিশনারিদের আগমন,সুভাষ জেংচাম ,দ্বিতীয় অধ্যায়,পূষ্ঠা ৫-৬ ;
সাংসারেক আচিক মান্দিদের দেব-দেবীদের নাম ,সংগ্রহক: ইগ্নাসিউস দাওয়া
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি এবং পার্বত্যবাসীর অধিকার ও ঐতিহ্য ,রাজা দেবাশীষ রায় ,দ্বিতীয় সংস্কারণ,২০১৭
Garo Journal;Dreams and A.chik folk life ;Dr.Barbara S Sangma ;Assistant Professor;Don Bosco College; Tura.
The Folk-Tales Of The Garos,Dewan Sing Rongmuthun,First Edition 1960
।। কভার প্রচ্ছদ থকবিরিম। ছবি: সংগৃহীত
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত
-
১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ...
-
রে রে : হায়রে আমার কাঞ্জিয়া ।। নীলু রুরাম
: সমর সাংমার রেরে নিয়েই শুরু করি তবে একটু আলাদা। আমাদের...
-
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিরাপদ ব্যবহার ।। জাডিল মৃ
: এক. সময় স্রোতের সাথে আবাহমান ছুটে চলা প্রযুক্তির উন্নতি, মানব...
-
বর্তমান সময়ের তুমুল জনপ্রিয় শিল্পী দিশন অন্তু রিছিলের জন্মদিন আজ
: বর্তমান সময়ের তুমুল জনপ্রিয় শিল্পী দিশন অন্তু রিছিলের জন্মদিন আজ।...
-
বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবতোষ যেত্রা আর নেই
: হালুয়াঘাট উপজেলার ৪নং সদর ইউনিয়নের কালিয়ানীকান্দা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা পাস্টার...
-
কেনিয়ার কৃষকরা হাতি তাড়াচ্ছে মৌমাছি দিয়ে
: কেনিয়ায় হাতির তাণ্ডব থেকে ফসল রক্ষায় ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে কৃষকরা।...
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত