Thokbirim | logo

৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আদিবাসীদের কোভিড-১৯ মহামারির অভিজ্ঞতা ও হাজংদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ।। সোহেল হাজং

প্রকাশিত : জুলাই ২৪, ২০২১, ১০:৩৩

আদিবাসীদের কোভিড-১৯ মহামারির অভিজ্ঞতা ও হাজংদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ।। সোহেল হাজং

পটভূমি

এই প্রকাশনাটি মূলত আদিবাসী তরুণ লেখকদের প্রবন্ধের একটি সংকলন। করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারি হেতু লকডাউন সময়কালীন ২০২০ খ্রিস্টাব্দের বিশ্ব আদিবাসী দিবস উদযাপনের সময় দিবসের মূলসুরকে (কোভিড-১৯ মহামারিতে আদিবাসীদের জীবন-জীবিকার সংগ্রাম) ভিত্তি করে যে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল, সেই প্রয়াসেরই ফসল এই প্রকাশনা। কারিতাস ময়মনসিংহ অঞ্চল কর্তৃক আয়োজিত এই প্রতিযোগিতাটিতে মূলত বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের আদিবাসী ছাত্র-যুবদের অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছিল। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী মোট ১৩ জন যুবক-যুবতীদের মাঝ থেকে ৩ সদস্য (আদিবাসী) বিশিষ্ট বিচারক মণ্ডলীর দ্বারা নির্বাচিত ১০ শাণিত দর্পণ যুবক-যুবতীদের প্রবন্ধ নিয়ে করা হয়েছে এ বিশেষ প্রবন্ধ সংকলন। 

কারিতাস ময়মনসিংহ অঞ্চল ১৯৯০ সাল থেকে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণ ও জীবন-মান উন্নয়নের লক্ষ্যে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রত্যন্ত অঞ্চলসমূহে শিক্ষা, কৃষ্টি-সংস্কৃতির উন্নয়ন, সচেতনতা, সক্ষমতা ও নেতৃত্বের বিকাশ এবং জনসংগঠন সমূহ শক্তিশালীকরণে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহে আবহমানকাল থেকে বসবাসরত ৮টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিভিন্ন প্রেক্ষাপট এবং বঞ্চনার প্রভাবে তুলনামূলক নাজুক। বৈশ্বিক মহামারি এ প্রেক্ষাপটে যেন মরার উপর খরার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুগে যুগে নানারকম বঞ্চনার শিকার হয়ে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা দরিদ্র আদিবাসীদের জীবন-জীবিকাকে চরমভাবে প্রভাবিত করেছে কোভিড-১৯ মহামারি। আদিবাসীদের প্রচলিত ভূমি ভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী জীবন-জীবিকা পরিবর্তন হওয়ার ফলে অনেক আদিবাসী জীবিকা নির্বাহে অনানুষ্ঠানিক সেক্টরে বা কর্মক্ষেত্র সমূহের উপর নির্ভরশীল, যারা এই মহামারি দ্বারা বিরূপভাবে প্রভাবিত হয়েছে। কর্মহীন হয়ে পড়া আদিবাসী নারীদের অবস্থা সবচেয়ে বেশি নাজুক, যাদের উপর পুরো পরিবার নির্ভরশীল ছিল। এ আদিবাসী নারীদের অনেকেই বিউটিপার্লারে বা বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে গৃহকর্মী বা সহায়তাকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন, যাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ কর্মহীন, অনিশ্চিত অসহায়তায় নিপতিত হয়েছে। কোভিড-১৯ এর কারণে অর্থনৈতিক সমস্যা ছাড়াও বিভিন্নমূখী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে আদিবাসীরা। আদিবাসীদের জীবনজীবিকার উপর কোভিড-১৯ মহামারির বহুমাত্রিক বিরূপ প্রভাব বিবেচনায় রেখে জাতিসংঘ ২০২০ খ্্িরস্টাব্দে বিশ^ আদিবাসী দিবসের মূলসুর নির্বাচন করে ‘‘COVID-19 and Indigenous Peoples’ Resilience” বা “কোভিড-১৯ মহামারিতে আদিবাসীদের জীবনজীবিকার সংগ্রাম”। বাংলাদেশ, তথা বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের আদিবসীরা কোভিড-১৯ মহামারির দ্বারা কতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রভাবিত তা চিহ্নিতকরণ, সমস্যাসমূহ মোকাবিলার ক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্ভাবনী চিন্তা এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শের সমাবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ থাকায় কিছুটা হতাশ যুব সমাজ নিজ নিজ এলাকায় থেকে প্রতিনিয়তই আদিবাসীদের নানারকম জীবন-যুদ্ধ ও বঞ্চনার সাক্ষী হচ্ছে। এ অনাকাঙ্খিত অবসর সময়ের যথাযথ ব্যবহার দ্বারা, ছাত্র-যুবদের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি ও সৃজনশীলতা প্রসূত পর্যবেক্ষণ কোভিড-১৯ মহামারি ও আদিবাসী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে উঠতে পারে কালের প্রয়োজনে। সেই উপলব্ধি আমাদের অনুপ্রেরণা দেয় মহামারি প্রভাবিত ৯ আগস্ট ২০২০ খ্রিস্টাব্দ বিশ্ব আদিবাসী দিবসকে উপলক্ষ করে কারিতাস ময়মনসিংহ অঞ্চল এর আলোক প্রকল্পের ব্যবস্থাপনায় বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের আদিবাসী যুবক-যুবতীদের জন্য প্রবন্ধ রচনা প্রতিযোগিতা ও প্রবন্ধ সংকলনের আয়োজন করার।

এ বিশেষ প্রবন্ধ সংকলনে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর যুবক-যুবতীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ সত্যি অনুপ্রেরনাদায়ক। ঐতিহাসিক এই মহামারী আদিবাসীদের জীবনজীবিকা, সমাজ-সংস্কৃতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদিতে কী প্রভাব ফেলছে, কীভাবে তারা এর মোকাবিলা করছে, এ সকল কঠিন জীবন অভিজ্ঞতার চালচিত্র কালের সাক্ষী হিসেবে উঠে এসেছে এ দশজন যুব প্রতিনিধিদের লেখনিতে। এই বিশেষ চ্যালেঞ্জ ও তা মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে এই দশ যুব দর্পনের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন, প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি, সুদূর প্রসারী ভাবনা, সুপারিশ ইত্যাদি আদিবাসীদের উন্নয়নে নানাভাবে কাজে আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

এই প্রকাশনার কাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বিশেষ কৃতজ্ঞতা তরুণ লেখকদের প্রতি, যাদের লেখনীতে এই প্রকাশনার সফলতা। শ্রদ্ধা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি বিচারক মণ্ডলীর সদস্য মি. সৃজন রাংসা(সাংমা), মি. মতেন্দ্র মানখিন এবং মি. পরাগ রিছিল-এর প্রতি, যারা তাদের মূল্যবান সময়, শ্রম ও মেধা দিয়ে প্রবন্ধগুলো বিচার-বিশ্লেষণ ও নির্বাচন করেছেন। বিশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি থকবিরিম প্রকাশনী’কে যারা এই সংকলন প্রকাশে অংশীদার হয়ে সহযোগিতা করেছেন এবং নির্বাচিত ১০টি প্রবন্ধ তাদের অনলাইন পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করার জন্য অঙ্গীকার করেছেন। প্রতিযোগিতার আয়োজক কমিটি এবং কারিতাস ময়মনসিংহ অঞ্চলের সম্পৃক্ত সকল সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা, যাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই আয়োজন সফলতা পেয়েছে।

সংকলনটির অনঅভিপ্রেত সকল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার আহ্বান জানাচ্ছি।  প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ, নির্মল, ভালোবাসাময় সবুজ পৃথিবী উপহার দিতে আমাদের সকলের দায়িত¦শীল প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক। 

অপূর্ব ম্র্রং

আঞ্চলিক পরিচালক, কারিতাস ময়মনসিংহ অঞ্চল।



আদিবাসীদের কোভিড-১৯ মহামারির অভিজ্ঞতা ও হাজংদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ।। সোহেল হাজং

১.

কোভিড-১৯ মহামারির প্রকোপ সারা বিশ্বকে ইতোমধ্যে মারাত্মকভাবে নাড়া দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২৬ অক্টোবর ২০২০ পর্যন্ত বিশ্বে ৪ কোটির বেশি লোক এ কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং ১০ লক্ষের অধিক লোক প্রাণ হারিয়েছে।  বাংলাদেশেও এ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা গত ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত ৪ লক্ষ ছাড়িয়েছে এবং মৃত্যু হয়েছে ৫৮১৮ জনের।  কোন প্রতিষেধক বের না হওয়া পর্যন্ত এ ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিহত করার কোন আশা দেখা যাচ্ছে না। মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপন ও এগিয়ে চলার মাঝে বিরাট এক বাধা তৈরি করেছে এই মহামারি। হতাশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে বিশ্বের স্বপ্নময় জীবনযাত্রাকে। আদিবাসীসহ প্রান্তিক মানুষের জীবনকে আরো দুর্বিষহ করে তুলেছে এ মহামারি। এই করোনাকালে হাজংসহ দেশের অন্যান্য আদিবাসীদের জীবন সংগ্রাম ও এ মহামারি মোকাবেলায় তাদের অভিজ্ঞতার কথা এ প্রবন্ধে কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

মাস দু’য়েক আগে গত ৯ আগস্ট ২০২০ পালিত হল আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। এবার এ অনুষ্ঠান আয়োজনে ভিন্নতা লক্ষ্য করা গেছে সর্বত্র। অধিকাংশ অনুষ্ঠানগুলো আয়োজিত হয়েছে ভার্চুয়াল মাধ্যমে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে। বৈশ্বিক এ মহামারি অবস্থার সাথে মিল রেখে জাতিসংঘ এ দিবসটির মূল থিম নির্ধারণ করেছে “কোভিড-১৯ ও ইন্ডিজেনাস পিপলস রিজিলিয়েন্স”। জাতিসংঘের মহাসচিব এন্তোরিও গুতেরাস দিবসটি উপলক্ষে এবারেও বাণী দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্বের প্রায় ৪৭ কোটি আদিবাসীদের জীবনেও ক্ষতিকর প্রভাব বিরাজ করছে। আদিবাসীরা বিভিন্ন বৈষম্য ও আর্থ-সামাজিক দূরাবস্থার শিকার হচ্ছেন। এই সময়ে আদিবাসীরা এই মহামারি কীভাবে মোকাবেলা করছেন সেই বিষয়টা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, থাইল্যান্ড-এর “কারেন” আদিবাসীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী লকডাউন প্রথা “ক্রো-ঈ” (গ্রামবন্ধ) প্রবর্তন করে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবকে মোকাবেলা করছেন। তিনি বলেছেন, জাতিসংঘ আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বদ্ধ পরিকর। তিনি এ মহামারি থেকে আদিবাসীদের সুরক্ষা ও তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্রের সকল প্রক্রিয়ার সাথে আদিবাসীদের যুক্ত করার আহবান জানিয়েছেন।

স্বাভাবিক অবস্থায় যেমন প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নানা বৈষম্য, অবহেলা ও প্রান্তিকতার শিকার হয়। এরকম বৈশ্বিক মহামারিতেও তাদের ক্ষতির পরিমাণ যে বেশি, সেটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এসব প্রান্তিক মানুষদের কাছে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার চেয়ে অন্যান্য সংকটগুলো চরম আকার ধারণ করছে। তার মধ্যে রয়েছে- চরম খাদ্য সংকট, কর্মহীন হয়ে পড়া, বর্ণ বৈষম্যের শিকার, মিলিটারাইজেশন, নারীর প্রতি সহিসংতা, ভূমি দখল, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা গ্রহণে পিছিয়ে থাকা ইত্যাদি। আমাদের দেশের কথায় ভাবুন, করোনাকালের পূর্বে দেশের আদিবাসীদের প্রতি যতটা মানবাধিকার লঙ্ঘণের ঘটনা ঘটেছিল, করোনাকালে অর্থাৎ এবছরের মার্চ মাস থেকে এ সহিংসতার হার কি কমেছে? কোন কোন ক্ষেত্রে বলা যায় আরো বেড়েছে। আদিবাসীদের ভূমি দখল, উচ্ছেদ, নারীর প্রতি সহিংসতা, আদিবাসীদের নামে মিথ্যে মামলা ঠুকে দেওয়া, হয়রানি এসব কার্যক্রম থেমে নেই। পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী নারী ও কিশোরীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা যেন আরো বেড়েছে। কাপেং ফাউন্ডেশনের তথ্য সেটাই বলে। গত সেপ্টেম্বর মাসেই আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ১১টি। এর মধ্যে ৭ জন ধর্ষণ, ২ জন গণধর্ষণ এবং বাকিরা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আদিবাসীদের ভূমিকে কেন্দ্র করে সহিংসতা, আক্রমণ, উচ্ছেদ, জোরপূর্বক ভূমি দখলের মতো ঘটনা ঘটেছে মোট ১৭টি। এই একটি মাসেই প্রায় ২১ একরের মতো আদিবাসীদের ভূমি দুষ্কৃত দ্বারা দখলের প্রক্রিয়াতে পড়েছিল।  এছাড়াও আমরা দেখেছি, এই করোনাকালে কিভাবে একটি দরিদ্র গারো পরিবারের ৪০ শতাংশ জমিতে লাগানো ৫০০টির মতো কলাগাছ কোন ধরনের নোটিশ ছাড়াই কেটে ধ্বংস করা হয়েছে ভূমি দখলের উদ্দেশ্যে। টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরে বাসন্তী রেমার ভূমিতে এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে আমাদের বন বিভাগ। অথচ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী বিষয়ক কনভেনশন ১০৭ (১৯৫৭) বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেছে। যেখানে আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী ভূমি অধিকারের কথা বলা হয়েছে। ইচ্ছে করলেই কারো দ্বারা কোন প্রকার স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি ব্যতিরেকে আদিবাসীদের তাদের ঐতিহ্যবাহী ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। আদিবাসী অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র ২০০৭ এ-ও আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী ভূমি অধিকারের কথা বলা হয়েছে যা রাষ্ট্র ও সকল প্রতিষ্ঠানকে শ্রদ্ধা ও মেনে চলা উচিত। করোনাকালে একটি প্রান্তিক দরিদ্র পরিবারের প্রতি তাই এরকম অবিচার দেখে সামাজিক মিডিয়াতেসহ অন্যান্য মাধ্যমে সকলেই নিন্দা জ্ঞাপন করেছে। সচেতন সমাজ প্রতিবাদ করেছে এবং বাসন্তী রেমার পরিবারকে সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছে। “মধুপুর বনভূমি: কে আসল ভূমি দখলকারী” এ বিষয়ে ডেইলি স্টার নামক জাতীয় পত্রিকায় আমার একটি লেখাও প্রকাশিত হয়েছে।  কিন্তু বাসন্তী রেমার মতো আরো অনেক আদিবাসী ব্যক্তি ও পরিবার প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘণের শিকার হচ্ছেন যাদের পাশে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এরকম অবস্থা এই করোনাকালেও বন্ধ হয়নি। এই হল করোনাকালে আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি।

২.

করোনাকালে আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতির সংকটাপূর্ণ, সেটাতো আছেই। শুধু তাই নয়, আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর এক ভয়াবহ নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করেছে এই মহামারি। ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ভয়ের চেয়ে চরম খাদ্যাভাবে মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি দেখা দেয় আদিবাসীদের মনে। কারণ, দেশের গড় দারিদ্র্যর হারের চেয়েও আদিবাসীদের মাঝে দারিদ্র্যের হার অনেক বেশি। এ বছরের মার্চের ২৬ তারিখ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পরপরই কর্মখালি হতে থাকে শহুরে মানুষের। কারণ আদিবাসীদের মধ্যে যারা শহরে থেকে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান, বিউটি পার্লার ও অন্যান্য কাজের সাথে জড়িত ছিল তাদের অধিকাংশরই চাকরি চলে যায় কোনরকম নোটিশ ও অগ্রিম বেতন প্রদান ছাড়াই। শুধু শহরে নয়, গ্রাম এলাকাতেও কর্মহীন হয়ে পড়ে আদিবাসীরা। যারা দৈনিক শ্রম বিক্রি করে একাধিক সদস্যের সংসার চালাতো তারা একেবারেই হতাশায় পড়ে। এরকম শত শত দরিদ্র হাজং ব্যক্তিদেরও কর্মহীন হয়ে পড়ার খবর পাওয়া যায়।

শুধু তাই নয়, শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ছিটকে পড়তে থাকে আদিবাসী শিক্ষার্থীরা। দেশে অনলাইন শিক্ষা চালু হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ, টেলিভিশন, ইন্টারনেটের ভালো সংযোগ না থাকায় প্রায় ৭৫ শতাংশ আদিবাসী শিক্ষার্থী এ অনলাইন শিক্ষা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েছে।  চিকিৎসা সেবা পাওয়াও দুর্লভ হয়ে পড়েছে এই করোনাকালে। করোনা ছাড়া অন্য রোগে অসুস্থ ব্যক্তিদেরও স্বাভাবিক চিকিৎসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। হাজংদের মধ্যে আমি যতজন করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনেছি, পরে তার সবগুলোকেই সুস্থ হওয়ার সুসংবাদ পেয়েছি। সমাজের সুদৃষ্টি, কাউন্সিলিং ও সচেতনতা তাদের জন্য শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। সকলেই সব জায়গায় থেকে করোনা মহামারিকে জয় করুক, এটাই প্রত্যাশা।

করোনা যে মানুষের জীবনে অভিশাপ হিসেবে এসেছে, তা নয়! করোনা আমাদের অনেক শিক্ষাও দিয়ে যাচ্ছে। এ মহামারি দেখিয়ে দিয়েছে প্রকৃতির সাথে অবিচার করা কতটা অন্যায়। আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও আদিবাসী জ্ঞানের গুরুত্ব ও মূল্যায়নের কথা মনে করিয়ে দিয়েছ। এই মহামারি দেখিয়ে দিয়েছে, আদিবাসী সংস্কৃতি, প্রথা ও ব্যবস্থাপনা বিশ্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এ মহামারি আবারও আদিবাসীদের সেই আগের সামাজিক ব্যবস্থাপনাতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে। পাহাড় ও বননির্ভর মানুষকে প্রকৃতির প্রতি ভালবাসার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি পালনে আবারও উদ্বুদ্ধ করেছে। এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে যে, জুমচাষ নির্ভর এ আদিবাসীরা নিজস্ব পদ্ধতিতে নিজের গ্রামে লকডাউন সিস্টেম চালু রেখে এখনও করোনা ভাইরাস হতে নিরাপদে আছেন। থাইল্যান্ডের ‘কারেন’ আদিবাসী যার একটি অনন্য উদাহরণ। তারা এই মহামারি দেখা দেয়ার সাথে সাথে তাদের গ্রামগুলোকে বন্ধ করে দেয় এবং নিজেদের এলাকার ভেতরে কৃষিকাজের প্রতি জোর দেয়। এইভাবে মাসের পর মাস তারা খাদ্য মজুদ রেখে এবং নতুন ফসল ফলিয়ে নিজস্ব গ-ির মধ্যে থেকে ভাইরাস থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছে। সিলেটের খাসি আদিবাসীদেরও এভাবে নিজেদের পুঞ্জিতে নিজেদেরকে করোনা ভাইরাস আক্রমণ থেকে মুক্ত থাকার কথা শুনেছি। কিন্তু জীবিকা নির্বাহের জন্য যেহেতু তাদের প্রতিদিন পান বিক্রি করতে হয়। পানক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা অধিকাংশই বাঙালি ও বহিরাগত যারা পুঞ্জির আদিবাসীদের নিয়ম কানুন মানতে বাধ্য নয়। এজন্য পুঞ্জিবাসী খাসি আদিবাসীদের একটা আশঙ্কা লেগেই থাকে। করোনা আরেকটি শিক্ষা দিয়েছে, চরম মহামারিতে কীভাবে একসাথে কাজ করতে হয়। ধনী, গরিব, যুব, বৃদ্ধ, সবল, দুর্বল একে অপরের জীবন বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে যা দারুণভাবে করোনাকে জয় করতে সহায়তা করছে। অনেক আদিবাসী সমাজেই এই ঐক্যবদ্ধ নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠেছে।

৩.

এবার হাজংদের কথা বলছি কিভাবে প্রান্তিক এ মানুষগুলো করোনার প্রথম ধাপ থেকে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আশঙ্কামুক্ত এটা বলা যাবে না। বৃহত্তর ময়মনসিংহে যারা বসবাস করে হাজংদের সম্পর্কে তারা ভালো জানেন। একসময় শতকরা ৯০ ভাগ হাজং পরিবারের অধিক পরিমাণে আবাদী জমি ছিল। তাদের গোয়াল ভরা গরু ছিল। পুকুর ভরা মাছ ছিল। হাজং ছাড়াও অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ যারা হাজংদের সাথে চলেছেন সেই বয়স্ক ব্যক্তিরা আজও এসব গল্প শোনান। নিজের ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে হাজংরা ছিল একটু বেশি কট্টর প্রকৃতির। মতিলাল হাজং-এর মতে, ১৯৬৪ সালের পূর্বে এদের লোকসংখ্যা ছিল ৪৫ হাজারের উপরে। একসময় অঢেল সম্পত্তিতে ভরপুর হাজং পরিবারগুলোর কৃষিকাজই ছিল প্রধান ও একমাত্র পেশা। এছাড়া বাইরে গিয়ে অন্য কাজ করাটাকে তারা ছোট মনে করত। অন্য সম্প্রদায়ের লোকদের আস্থাশীল ও পবিত্র মনে না করে তেমন কাছেও ভিড়তে দিত না! তবুও, কোনক্রমে কেউ তাদের বাড়িতে ঢুকে পড়লে সেসময় পুরো ঘরকে তারা আবার ধুয়ে মুছে পরিস্কার করত।

কিন্তু হাজংদের সে অবস্থা আজ আর নেই। এখন ৯০ শতাংশ হাজং পরিবার ভূমিহীন। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে টংক আন্দোলন, ১৯৬৪ সালের হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ৭১’এর মুক্তিযুদ্ধ এসব জীবনযুদ্ধেও ঝড়ের কবলে পড়ে নিজভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে অসংখ্য হাজং পরিবার। বাকি কিছু পরিবার জীবনের ভয় না করে এদেশের ভিটেমাটি আঁকড়ে ধরে ছিল। আজ সেই টিকে থাকা হাজংদের সংখ্যা সারা বাংলাদেশে হবে প্রায় ১৮ হাজার। কিন্তু বিভিন্ন হামলা, মামলা, ষড়যন্ত্রে পড়ে আজ তারাও ভূমিহীন ও প্রান্তিক হয়ে পড়েছে। এখন হাজংদের মধ্যে ৭০-৮০ ভাগ পরিবার হবে দরিদ্র, হত-দরিদ্র কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির। বেশির ভাগ মানুষ শ্রমজীবী। দিন আনে দিন খায়। একদিন বসে থাকলে কারও কারও বাড়ির চুলোয় আগুন জ্বলে না! তাই, কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব যেভাবে চারিদিকে আক্রমণ করেছে তা অন্যান্যদের মতো হাজংদের মাঝেও বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সারাদেশ জুড়ে সাধারণ ছুটি বা লকডাউন শুরু হলে দরিদ্র হাজংরা কী করবে, কোথায় যাবে এ নিয়ে ছিল বড় ভাবনা!

আমি ছোটবেলা থেকে খেয়াল করছি, হাজংদের মধ্যে কেউ ভিক্ষা করে এমন আজও পায়নি। বাবার অনেক সম্পত্তি থাকলেও সম্পত্তি নষ্ট করে অনেককে পথে বসতে দেখেছি কিন্তু পথে বসে ঠেলায় পড়ে আবার কাজ করে তাদের ঘুরে দাঁড়াতে দেখেছি কিন্তু কাউকে ভিক্ষা করতে দেখেনি। হাজং সমাজে ‘আভিজাত্য’ বলে একটি কথা আছে। একসময় হাজংদের যখন অঢেল সম্পত্তি ছিল তখন এই আভিজাত্যটিও ছিল। এখন তারা ভূমিহীন, সম্পদহীন পরিবারে পরিণত হয়েছে কিন্তু কোন কোন দিক দিয়ে মনের আভিজাত্য এখনো যেন ধরে রেখেছে। না খেতে পেরে মারা গেলেও কখনো ভিক্ষা করবে না! আভিজাত্য নষ্ট হয়ে যাবে এমন ধারণা পোষণ করা লোক এখনও প্রচুর এ সমাজে! কিন্তু, করোনাকালে যখন কাজকর্মও শূন্য হওয়া শুরু করেছিল তখন ভাবছিলাম এই মানুষগুলো কোথায় যাবে! ঘরে খাবার না থাকলেও তো তারা কারও কাছে চেয়ে খেতে পারবে না! কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবে দীর্ঘদিন লকডাউন পরিস্থিতিতে দেশের মধ্যবিত্ত মূলধারার পরিবারগুলো পর্যন্ত হাত পাতা শুরু করেছে। সেখানে চাইতে না পারা দরিদ্র হাজং পরিবারগুলোর কি দশা হবে!

৪.

এ করুণ পরিস্থিতিতে আসলে জাতির সংগঠনগুলোর ভূমিকা অনেক থাকে। ঠিক তেমনি, বাংলাদেশ জাতীয় হাজং সংগঠনের আমাদের কয়েকজনের মধ্যে আলোচনা হয়। যার ফলে, গত ৪ঠা এপ্রিল জাতীয় হাজং সংগঠনের উদ্যোগে হাজং দরিদ্র মানুষগুলোকে বাঁচাতে একটি অনলাইন নেটওয়ার্ক বা সমন্বয়করী কমিটি সৃষ্টি হয়। কমিটির নাম দেয়া হয়, “কোভিড-১৯ মহামারিতে হাজং পরিবারের জন্য সহায়তা”। ফেসবুকে এ নামে একটি প্রাইভেট গ্রুপ পেজও খোলা হয়। ২০০ জনের উপরে যার সদস্য সংখ্যা। সকলে হাজং জনগোষ্ঠী থেকে। দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রাম থেকে হাজং সদস্যদের এ গ্রুপে যুক্ত হতে উৎসাহ দেয়া হয়েছিল। দেশের সংকটে পড়া হাজংদের খবরাখবর দ্রুত শেয়ার করার জন্য রয়েছে একটি ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ। সাপ্তাহিক নিয়মিত অনলাইন মিটিং ছাড়াও প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আপডেট তথ্য চলে আসে এ গ্রুপ একাউন্টে। ফলে সংকটে পড়া হাজং পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে যায় কেউ না কেউ। এভাবেই সবার সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় কোভিড-১৯ দূর্যোগকে মোকাবেলা করে প্রথম ধাপ পাড় করে দেয় হাজং সমাজ।

শত অভাবের মাঝেও চেয়ে খাওয়ার অভ্যাস কম এ হাজং পরিবারগুলোকে রক্ষার জন্য নেটওয়ার্কটি অভিনব পন্থা গ্রহণ করে। নেটওয়ার্কের সদস্য দ্বারা গ্রামভিত্তিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে চরম সংকটে পড়া ও ঝুঁকিতে থাকা হাজং পরিবারদের খোঁজে বের করা হয়। খাদ্য সংকটে পড়া হাজং পরিবারগুলোকে চাওয়ার আগেই তাদের মাঝে বিভিন্ন মাধ্যমে সাহায্য পৌঁছে দেয়া বা কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়! শর্ত থাকে, সাহায্য গ্রহণের সময় সাহায্যপ্রাপ্ত ব্যক্তির কোন ছবি তোলা যাবে না। কোন ছবি বা কারো নাম সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা যাবে না। কারণ দূর্যোগের সুযোগ নিয়ে এ মানুষগুলোকে ক্যামেরার সামনে দেখানোটা বড়ই অমানবিক মনে হতে পারে অনেকের কাছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, দেশের প্রায় ৭ কোটি মানুষ ত্রাণ পাচ্ছে এ কোভিড-১৯ মহামারি সময়ে। ৭ কোটি মানুষ মানে ৭ কোটি পরিবার এই ত্রাণের আওতায় চলে আসার কথা। এছাড়াও তো রয়েছে নানা সহায়তার প্যাকেজ। সুষ্ঠুভাবে এসব সরকারি সহায়তা বাস্তবায়ন হলে তো এই ৪ হাজার হাজং পরিবারের প্রায় সকলেই ত্রাণের আওতায় আসার কথা। কিন্তু হাজংদের মাঝে সেভাবে সরকারি ত্রাণ পৌঁছেনি। আমরা দেখেছি, উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরে শতশত আদিবাসী পরিবার রাস্তা অবরোধ করে রেখেছিল সরকারি ত্রাণের ন্যায্য দাবিতে।  এই করেনাকালে কোন কোন হাজং পরিবার মাত্র একবার করে ১০ টাকা কেজি দরের চাল গ্রহণ করতে পেরেছে। কলমাকান্দা, তাহিরপুর, ধরমপাশা, নালিতাবাড়ি, ধোবাউড়া ও ঝিনাইগাতী উপজেলার হাজং পরিবারগুলো ত্রাণ পেয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় কম। তবু কারো মাঝে কোন ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। স্থানীয় পর্যায়ে অনেক দরিদ্র হাজং পরিবারের নাম সরকারের সহায়তার তালিকায় অন্তর্ভূক্তও হয়নি। তারা অন্যদের মতো চাইতেও জানে না। ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সাথে সম্পর্ক রাখতে পারে না, এটি ত্রাণ না পাওয়ার একটি অন্যতম দুর্বল কারণ বলে অনেকে মনে করে। কিন্তু এই নেটওয়ার্ক দরিদ্র হাজং পরিবারের একটি তালিকা তৈরি করে সরকারের কাছে সহায়তার জন্য আবেদন করেছে। সমাজের মানুষকে বাঁচানোর জন্য হাজং নেতৃবৃন্দ সরকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে লবি, অ্যাডভোকেসি অব্যাহত রেখেছে।

বলা যায়, করোনারকালের প্রথম পর্যায়ে, হাজংদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সমন্বয়কারী নেটওয়ার্কটি দরিদ্র হাজং পরিবারকে সহযোগিতা করছে তিনভাবে-

১.      অ্যাডভোকেসি করার মাধ্যমে: সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণ বা সহায়তা কীভাবে দরিদ্র হাজং পরিবারের মাঝে পৌঁছে দেয়া যায় সে চেষ্টা করা,

২.      জরুরি খাদ্য সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে: যখন দেখা যায়, কোন দরিদ্র হাজং পরিবার সরকারি বা বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠান থেকে ত্রাণলাভে ব্যর্থ হচ্ছে এবং খাদ্য সংকটে রয়েছে তখন সে পরিবারকে তার গ্রাম অথবা পার্শ্ববর্তী গ্রামের কোন সচ্ছল হাজং পরিবারকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানানো হয়। সেটাও কোনকারণে সম্ভব না হলে নেটওয়ার্কের নিজস্ব তহবিল থেকে দরিদ্র পরিবারে সহায়তা পৌঁছে দেয়া হয়।

৩.     সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে: করোনা ভাইরাস এবং এর প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং আসন্ন ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় গাও বুড়া (গ্রাম্য মাতবর/ গ্রাম সমাজ), পূজা কমিটি ও অন্যান্যদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করা।

হাজং নেটওয়ার্কের উদ্যোগটি এখনো অব্যাহত রয়েছে। তবে বোরো ও আমন মৌসুমের কাজ শুরু হলে গ্রামের হাজংরা কাজে যোগ দেয় এবং বাইরে যাওয়ার বিধিনিষেধ সংকুচিত হয়ে আসলে বাইরে বেড়িয়ে পড়ে। দারিদ্র্যের চরম প্রভাবও এদের মাঝে আসতে আসতে কমতে থাকে। হাজংরা যে যেভাবে পারে কাজের খুঁজে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বের হয়ে পড়ে। নেটওয়ার্কে গত কয়েক সপ্তাহ যাবত করোনা মহামারির প্রভাবে কোন খারাপ খবর আসেনি। তবে আশঙ্কা বাদ দেওয়া হয়নি। এজন্য কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব সম্পূর্ণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা এ মহৎ উদ্যোগ চালিয়ে যাবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। তবে নেটওয়ার্কের মিটিং এখন প্রতি সপ্তাহে না হলেও প্রয়োজনানুসারে ডাকা হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তড়িৎগতিতে নেয়া হয়। তা’না হলে এ জাতির দরিদ্র পরিবারগুলোকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। এ নেটওয়ার্কের মূল চালিকা শক্তি হল হাজং ছাত্র ও যুব সমাজ। বাংলাদেশ হাজং ছাত্র সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। সকলের প্রচেষ্টায় নেটওয়ার্কটির মাধ্যমে লক্ষাধিক টাকা কোভিড-১৯ তহবিলে সংগ্রহ করতে পেরেছিল। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, যার প্রায় ৯০% টাকা জমা পড়েছে এই দরিদ্র হাজংদের মধ্য থেকেই। ১০০ টাকা, ৫০০ টাকা করে শুরু করে যে যেভাবে পেরেছে তহবিলে টাকা জমা দিয়েছে নিজ সমাজের লোকদের রক্ষার জন্য। এর চেয়ে আনন্দের ও মহৎ উদ্যোগ আর কি হতে পারে! সে তহবিল দিয়েই এ পর্যন্ত হাজংদের ৬০টি গ্রামে খাদ্য সংকটে পড়া প্রায় ৩৫০ হাজং পরিবারকে সহায়তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। সেই সাথে অসুস্থ হাজং ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা করেছে এ নেটওয়ার্ক। অর্থের চেয়েও হাজং সমাজের ধনী-গরিব, ছাত্র-যুব, বেকার-চাকরিজীবী এদের মাঝে এক ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দারুণভাবে করোনা মহামারি পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করতে সহায়তা করছে। অর্থ ছাড়াও ফ্রন্ট লাইনে কাজ করে, প্রয়োজনে পাশে থেকে, পরামর্শ দিয়ে কাজ করেছে সমাজের লোকজন। এ শক্তি স্থায়ী হলে করোনাকে জয় করা অবশ্যই সম্ভব। এই কাজের মডেলটি অন্যান্য আদিবাসীদের কাছেও একটি শিক্ষণীয় ও অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করতে পারে।



লেখক পরিচিতি

সোহেল হাজং সংগঠক ও মানবাধিকার কর্মী, সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয় হাজং সংগঠন। স্থায়ী ঠিকানা: গ্রাম দাওয়াকুড়া, ডাকঘর: চাটকিয়া, উপজেলা: নালিতাবাড়ি, জেলা: শেরপুর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ কল্যাণ বিভাগে লেখাপড়া করে বর্তমানে এশিয়া ইন্ডিজেনাস পিপলস প্যাক্ট (এআইপিপি) এর হিউম্যান রাইটস প্রোগ্রাম অফিসার হিসেবে থাইল্যান্ডে কর্মরত।



## দশটি নিবন্ধ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে। আজ প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় স্থান বিজয়ী সোহেল হাজং’র নিবন্ধ।




সম্পাদক : মিঠুন রাকসাম

উপদেষ্টা : মতেন্দ্র মানখিন, থিওফিল নকরেক

যোগাযোগ:  ১৯ মণিপুরিপাড়া, সংসদ এভিনিউ ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। 01787161281, 01575090829

thokbirim281@gmail.com

 

থকবিরিমে প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। Copyright 2020 © Thokbirim.com.

Design by Raytahost