সে অনেক দিন আগের কথা। সেই সময়ে আর একদল মানুষ মিলেমিশে বিনদেংগু রংছিংখল থাকরু মালিক এ বসবাস করছিল। দেবতা মানুষের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব ছিল এমনকি বিবাহাদিও চলত।
প্রবল পরাক্রান্ত সালজং গিংমাৎফার কন্যা খাবু রেনছে নরিমবি দিকখিমবি অত্যন্ত রুপবতী ছিল। খাবু রেনছের মাহারীর নাম রংবাং। তার পিতা অনেক খুঁজে পেতে দু’ছেরং আনিং প্রিং ওয়ানা ছিনিং গ্রিং ওয়াছানার সাথে মেয়েটির বিবাহ দেয়।
সেই বছরে না বুঝে দুমেরং দু’ছেরং দেবতা মিসি সালজং এর যাতায়াতের পথে ঝুম চাষ করে বসল। এতে মিসি সালজং রেগে গিয়ে তাকে হত্যা করে। সেই সময়ে গায়রা তার মাতৃগর্ভে ছিল।
বিধবা খাবু রেনছের মামা তার রুপ যৌবন দেখে মুদ্ধ হয়ে নানাভাবে তার মন জয়ের চেষ্টা করে। কিন্তু উদাসীন খাবু রেনছের কাছ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায় না । সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে সে বামিন রা’ছার পরামর্শে মংগেরা ভিজানো বাঁশি ও বংবিনা বাজিয়ে তাকে বশ করে ।
সাত বছর ধরে গর্ভে ধারণ করলে খাবু রেনছের আত্মীয় স্বজন ভয় পেয়ে ভাবল:
“মেয়ের গর্ভে কি যেন জন্ম গ্রহণ করেছে।”
এদিকে বিশিকরম বিধাতারে গিয়ে ওয়ানা ওয়াংআ বুছ ছমকা আরফা বিন্দফাকে বললঃ
“খাবু রেনছের এই সন্তান তোমার চেয়ে অধিক শক্তিশালী হবে।”
এই কথা শুনে ওয়ানা ওয়াংআ সুযোগ খুঁজতে লাগল কীভাবে গর্র্ভস্থ সন্তানসহ খাবু রেনছেকে শেষ করা যায়। এর প্রথম ইঙ্গিত হিসাবে সে খাবু রেনছের এক বাদীকে হত্যা করে।
“গয়রা বড় হলে তুমি তার সাথে লড়াই করো, এখনই কি।” এই কথা বলে বিশিকরম ওয়াংনা ওয়াংআকে নিরস্ত করে। মাতৃগর্ভে অবস্থানকালেই গয়রা বলে উঠে:
“আমাকে গয়রা বলে ডাকবে।”
খাবু রেনছের আত্মীয়ের এ কথা শুনে দারুণ ভয় পেয়ে গেল । যাতে নির্বিঘ্নে জন্ম সুসম্পন্ন হয় সেই জন্য তারা সালজং এর উদ্দেশ্যে একটা পাঁঠা মানত করল ।
গায়রাকে মারবার জন্য ওয়ানা ওয়াআ তাকে ধরে রইল, কিন্ত জন্মের সময় থেকেই গয়রা ছিল অত্যন্ত চালাক। ওয়ানা ওয়াংআকে তার দিকে অগ্রসর হতে দেখেই সে ফট করে লাফিয়ে পালালো ।
জন্মের সকালে তার মা তার চারদিকে মুগার কাপড় দিয়ে ঘিরে তাকে বিছানায় শুইয়ে রেখে স্নানকরার জন্ম ঝর্ণাতে চলে গেল। মায়ের পেছনে ফেরার সাথেই গয়রা লাফিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে গ্রামের নকফান্তেতে গিয়ে দামা বাজিয়ে, “গয়রা..” গয়ো… গয়রা… গয়রা… গয়রা।” বলে গান গেয়ে নাচতে লাগল।
“হায়, হায়, কে যেন আমার বাচ্চটার নাম ধরে তামাশা করছে।” এই বলে মা ঘাট থেকে দৌড়ে এল। নকফান্তেতে এসে তার চক্ষু স্থির, গয়রা তার লম্বা কাঁচা নাভি সহ লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চেঁচিয়ে বেড়াচ্ছে। মাকে দেখেই সে লক্ষী ছেলের মত কোলে উঠে বসল। মা আদর করে তাকে দুধ খাইয়ে বিছানায় এনে শোয়ালো। যতক্ষণ মা কাছে ছিল গয়রা ঘুমের ভান করে পড়ে রইল। মা গেলে সে আবার উঠে মাঠের উপর দিয়ে, পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে, নদী নালা পার হয়ে বেড়াতে লাগল। মা আসার আগে বাড়ি ফিরে বিছানায় এল। দুধ খাওয়াবার জন্য মা কোলে নিতেই:
‘‘গয়রা… গয়রা…. গয়রা….গয়রা….গয়রা….গয়রা….গয়রা” বলে তালে তালে সে যুদ্ধের নাচের মহড়া দিতে লাগল।
জম্মের সময়কার মানত পূর্ণ করবার উদ্দেশ্যে রকমান মে’আ ছেংমাং ফান্থে কয়েকজন সঙ্গীসহ দিম্বিল ব্রি ফালওয়াং আ’দিং বাজারে পাঁঠা কিনতে গেল। পথে পাহাড় সমান উচু, সাত মাথা ওয়ালা ওয়াক মাংগানছি শূকর দানব তাদের গিলে ফেলে। সেই ওয়াক মাংগানছির মাথার তালুতে চাঁদের মত উজ্জল চোখ, পিঠে বাঁশের ঝাড়ের মত লোম ছিল। দাঁড়ালে সেই প্রাণির নাক তুরা পর্বতের সমান ও লেজ ব্রহ্মপুত্র নদীর পানিতে ডুবে যেত। সে নিজ ইচ্ছানুযায়ী পৃথিবী পরিভ্রমণ করে ক্ষেতের যাবতীয় ফসল নষ্ট করে লোকজনদের ভয় দেখাতো।
গয়রার জম্মের আগে আর মামা দিনা অকপেত, দিদি রাংক্ষেত, আখুয়াবেল আরা বেলবেল মিসির বংশধরদের সাথে যুদ্ধের শেষে এই শূকরটাকে শিশু অবস্থায় পাতালপুরি থেকে নিয়ে এসেছিল। পাথর দিয়ে একটা খোঁয়াড় তৈরি করে তাকে সেখানে রাখা হয়েছিল। ক্রমে সেই শূকর এত বড় হল যে, খোয়াড়ে জায়গা না হওয়াতে খোয়াড় ভেঙে তাকে বার করতে হল। পরে সে খোয়াড়ের বাইরেই অবস্থান করতে লাগল। একবার তাকে খাবার দেবার সময়ে সে দিনা অকপেত, দিদি রাংক্ষেত, আখুয়াবেল, আরাবেলকে খাবার ভেবে খাবারের সাথে খেয়ে ফেলে। তখন থেকে কেউ সাহস করে তার কাছে যেত না। ক্রমে তার দেহ এত বিরাট আকার ধারণ করল যে, দুনিয়ার মানুষ ভীত হয়ে তাকে ‘‘ওয়াক মাংগানছি আরাগন্দি’’ নাম দিল।
বাজারে যাবার পথে রকমান মে’আ ছেংমান ফান্তেকে গিলে খাবার খবর সাত বছর পরে গ্রামের লোকেরা জানতে পারল। কিন্তু ভয়ে কেউ এ কথা নিয়ে আলোচনা করল না।
চার বছর বয়সে গয়রা তার মায়ের দুধ ছাড়লো। আর সেই সময়েই তার জম্মকালীন নাভি শুকিয়ে পড়ে গেল। দিনে দিনে সে অত্যন্ত বলশালী ও প্রতাপশালী হয়ে উঠল। তার বুদ্ধি ও শক্তির সাথে কেউ পাল্লা দিতে পারত না। শত্রুর সাথে মোকাবিলায় তার ক্ষিপ্ততা ও সাহস ছিল তুলনাহীন।
ছোট বেলা থেকেই সে সমবয়সীদের নানা ভাবে উত্যক্ত করে তুলল। কারো কান্না শুনে প্রশ্ন করলে জবাব শোনা যেত, ‘‘গয়রা ক্ষেপাচ্ছে।” সে একা একা ঘুরে বেড়াতো। কোন বালককে গিলা বা অন্য কিছু খেলতে দেখলে কেড়ে নিত, বালি দিয়ে ঘর বানিয়ে খেললে লাথি মেরে ভেঙ্গে ফেলত। শৌর্য্যে বীর্য্যে আর সকলকে ছাড়িয়ে যাওয়াতে সবাই তাকে থকফা অকফেত দিনা খাফেত বলে লাগত।
যৌবনে তার শক্তি ও সাহস আরও বেড়ে গেল। যে সমস্ত প্রাণী মানুষের ক্ষতি সাধন করত ক্ষিপ্র গতিতে সেই সেই সব বন্য জন্তু, জলের কুমীর ইত্যাদি ধরে খেলা তার স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল। হয়তো কোনদিন তার চেয়ে শক্তিশালী কারো পাল্লায় পড়ে জানটা বেঘোরে যাবে- এই ভয়ে কেউ ওয়াক মাংগানছি শূকর দানবের কথা তাকে জানালো না। একদিন সে তার সমবয়সীদের বলর: ‘‘চল আমরা ব্রহ্মপুত্রের চরে গিলা খেলতে যাই।” খেলায় কেউ তার সাথে পেরে উঠল না। প্রতিবারই ক্ষিপ্রতার সাথে অব্যর্থ লক্ষ্যে গিলা লুকে সে জঙ্গলে ছুড়ে ফেলে দিতে লাগল। বার বার হেরে গিয়ে তারা রেগে পালিয়ে গেল। সে যাতে সহজে নাগাল না পায় এমন দূরে দাড়িয়ে তাদের মধ্যে বেশি সাহসী ব্যক্তি চিৎকার দিয়ে বলল:
‘‘শক্তিহীন বালকদের কাছেই তুমি নিজের বল প্রকাশ করে থাক। বাপের বেটা হলে তোমার মামা, তোমার দাদুকে যে গিলে ফেলেছিল সেই ওয়াক মাংগানছিকে কেন মার না?”
তাদের বিদ্রুপ শুনে ওয়াক মাংগানছির বিষয়ে জানবার জন্য সে তার দিদিমার কাছে গেল:
‘‘ওয়াক মাংগানছি আরা গন্দির নাম শুনে তোমার কাছে জানতে এলাম জিনিসটা কী।” তার দিদিমার বয়স সাত কুড়ি সাত বৎসর। সে কাপতে কাপতে বলল:
‘‘আইআও! অবুজ বালকের জন্য শূকর দানবের কথা কে এমন ভাবে বলল?”
বার বার জিজ্ঞাসা করেও সে তার কাছ থেকে কোন জবাব পেল না। শেষে রেগে গিয়ে দরজা সমান এক কাকড়া ধরে এনে বলল:
‘‘দিদিমা, তুমি যদি ওয়াক মাংগানছির বিষয়ে আমাকে না বল তবে দেখেছ তো, এই বিরাট কাকড়ার দাড়া দিয়ে জোরে খোচা দেব।”
এক গুয়ে গয়রার জেদে শেষ পর্যন্ত সব কথা খুলে বলতে হল। মামার দুর্ভাগ্যের কথা শুনে তার মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে উঠল। ওয়াক মাংগানছির নাম দুনিয়া থেকে মুছে ফেলার জন্য সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হল। সেই যুগে পশু-পাখি কুমিররুপী দৈত দানব যারা মানুষের ক্ষতি সাধন করত তাদের নির্মুল করাই বীরত্বের পরিচায়ক ছিল এবং তাতে তার নাম পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়ে যেত। তখন গয়রার বয়স এক কুড়ি দশ বৎসর।
অস্ত্র লাভের জন্য গয়রা পূর্ব দিকে সালগ্রার বাজারের উদ্দেশ্যে রওয়া হল। একদিনে বারটা বাজার পার হয়ে সে মাকখার বাজারে এসে পৌছালো। পথে জ্ঞানী গ্রিংজেং ও ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা আবাল জেংএর সাথে বন্ধুত্ব হল। তারা তাকে প্রয়োজনীয় নানা বিষয়ে পরামর্শ দিল এবং শেষে বলল:
‘‘কোন কাজে হাত দেবার আগে দেবতার আশীর্বাদ লওয়া কর্তব্য।”
তারা তাকে রাংবালদি রাংবিলবিলদা পর্যন্ত এগিয়ে দিলে এরির পোষাক ও পাগড়ি মাথায় রেজা গংগা ওরফে থআজেং আবালজেং এর সাথে তাদের সাক্ষাৎ হল আর তখন থেকেই সে গয়রার বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে গেল।
থআজেং আবালজেংএর সাথে গয়রা যখন কামার আয়ফা মান্দে আজেফার কাছে যাচ্ছিল তখন মাৎছুরু থরি মাৎছা খালসি কামার শালায় বসে মনোযোগের সাথে তার কাজকর্ম দেখছিল। বহু দিন থেকে তারও একখানা মনের মত মি’ল্লামের গোপন বাসনা ছিল। বসে থাকতে থাকতে মাৎছুরুর পেট ফুলে গেলে সে হঠাত জোরে বাতাস ছাড়ল। তার ভীষণ ভয় হতে লাগল এই বুঝি আজেফা তার লোহার হাতুরী দিয়ে দিল এক ঘা। কিন্তু মাৎছুরু থি’থত ফল খাওয়াতে সেই বাতাস সুগন্ধ ছড়িয়েছিল, তাই আজেফা তাকে বলল:
‘‘থি’থত ফল যতদিন থাকবে তুমি রোজ আমার কামার শালায় এসে এ রকম সুগন্ধি বাতাস ছড়ালে আমি তোমাকে সুন্দর একখানা মি’ল্লাম তৈরি করে দেব।”
মাৎছুরু খুশি হয়ে রোজ এল। তার কথা মত আজেফা তাকে মি’ল্লাম উপহার দিল। সেই মি’মিল্লাম এত ভারি ছিল যে সেটা বয়ে নিয়ে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হল না। টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে যাবার খ্রেক মে’আ আমাক ওয়াছেক বানরের সাথে দেখা হল। সে জিজ্ঞাসা করল:
‘‘বন্ধু, এত বিরাট একখান মি’ল্লাম তুমি কোথা থেকে পেলে?”
সে সব কথা খুলে বলল। বানরেরও ওমন একখানা মি’ল্লাম পাবার ইচ্ছা জাগল। পেট ভরে ফাসিম (গন্ধ ওয়ালা এক প্রকার বুনো পাতা) খেয়ে সে আজেফার কামার শালায় গিয়ে বিশ্রী গন্ধ ছড়াতে লাগল। আজেফা রেগে গিয়ে হাতুরী দিয়ে তার পেছনে এক ঘা দিল। সে দিন থেকেই তার আর তার বংশধরদের পেছন চ্যাপ্টা হয়ে গেল।
এদিকে পথ চলতে চলতে মাৎছুরু গয়রার সাক্ষাৎ পেল। চমৎকৃত হয়ে গয়রা বলল: ‘‘আইআ! তোমার মি’ল্লাম খুবই সুন্দর, একটু ধরে দেখতে দেবে?”
সেই মি’ল্লাম-এর ফলা দুইটি, এক এক ফলা বার হাত চওড়া, লম্বায় চার কুড়ি দশ হাত। তার আগা থেকে বাট পর্যন্ত এমন চক চকে ধারালো যে, রোদের আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল। গয়রা মি’ল্লামটা ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতেই বিদ্যুতের মত ঝলসে উঠতে লাগল। তা দেখে কোন দিকে না তাকিয়ে মাৎছুরু প্রাণ ভয়ে পালিয়ে গেল।
গয়রা বলল:
‘‘আরে পালাচ্ছ কেন? ভয় নাই, ভয় নাই।”
দূর থেকে চিৎকার দিয়ে সে বলল:
‘‘তুমি ওটা নেবে তো নাও, ফেলে দেবে তো দাও, এমন মারাত্মক জিনিস আমার প্রয়োজন নাই।”
গয়রা হাতের লাঠিটা তার দিকে ছুড়ে ফেলে বলল:
‘‘নাও, তবে এটা তোমার জন্য, নিলে নাও, না চাইলে ফেলে দাও।”
লাঠিটা সোজা মাৎছুরুর পেছনে বিধে গেল। সেদিন থেকেই সেটা মাৎছুরুর বাহারে লেজ হয়ে রইল। এমন তুলনা বিহীন মি’ল্লাম পেয়ে গয়রা খুবই খুশি হল।
এবার সে দিকগিল খংসিল-এর কামার শালায় গিয়ে তাকে অনুরোধ করল:
‘‘এক টানে বারটা তীর ছুড়ে মারা যায় এমন ধনুক আমাকে তৈরি করে দাও।”
কিন্তু দিকগিল খংসিল তার দিকে ফিরেও তাকাল না কথার জবাবও দিল না। বার দিন বার রাত অপেক্ষা করেও যখন সে কাজে হাত দিল না তখন থআজেং আবালজেং রেগে গিয়ে বলল:
‘‘দেখ দেখ দিকগিল খংসিল, ভাল চাও তো আমার বন্ধুর কথা মত কাজ কর, নতুবা আমার হাতের এই কুড়াল দেখছ তো, এই দিয়ে তোমার ঘরের একটা খুটিও আস্ত রাখব না। তার মারমুখী রুপ দেখে সে রাজি হল। লোকজন নিয়ে দিন রাত কাজ করে বার দিন পর সে তীর ধনুক গয়রার হাতে তুলে দিল। পরীক্ষা স্বরুপ দিকগিল খংসিল গয়রাকে বলল:
‘‘আমার উঠানের উপরে যে আম গাছটা আছে তোমার তীর ধনুক দিয়ে সেটা মেরে দেখ তো?”
‘‘গাছটা যদি পড়ে যায় তবে এর জন্য আমার কাছ থেকে কিছু দাবি করবে না বল?”
‘না কিছু দাবি করব না।”
গয়রা তীর মারতেই গাছটা ভেঙে পড়ে গেল। শুধু একটা শিকড় মাটির সাথে লেগে রইল। গয়রা মন্ত্র পড়ে গাছটা আগের মত বড় করে তুলল। গয়রার তীরের বিষের গন্ধ আজো আম গাছে পাওয়া যায়।
গয়রার শক্তি দেখে দিকগিল খংসিল মুগ্ধ হয়ে গেল। তীর ধনুকের মূল্য তো সে চাইলই না উপরন্তু তাকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে মদ মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করল। এরপর থআজেং আবালজেংকে নিয়ে সে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করে ওয়ারি গিৎছাকএ এসে উপস্থিত হল। ‘‘আবার দেখা হবে বন্ধু।” এই কথা বলে থআজেং তার কাছ থেকে বিদায় নিল। পথে যেতে যেতে সে তার তীর ধনুক দিয়ে গাছে আঘাত করতে করতে চলল। তীর ধনুকের শব্দে ভয় পেয়ে লোকজন মারা যেতে লাগল। গয়রা তাদের দেহে তীর ধনুক স্পর্শ করতেই তারা আবার বেঁচে উঠল।
বাড়ি পৌছালে গয়রার মা বোনেরা সাতদিন সাতরাত্রি ধরে দেবতার পূজা করল। তার মা ও দিদিমা আদর করে ‘‘ছু বিৎছি” খাইয়ে সতর্ক করে বলল:
‘‘বাছা, তুমি শূকর দানবের সাথে যুদ্ধ করতে চাইছ, কিন্তু তার সাথে পারবে কি?”
গয়রা গর্ব করে বলল:
‘‘কেন চিন্তা করছ মা, কেন অনর্থক মন খারাপ করছ দিদিমা, দেবতার আশীর্বাদ নিয়ে আমি তার সাথে যুদ্ধ করব।”
পুত্রের অমঙ্গল আশঙ্কায় মা বলল:
‘‘শূকর দানব পৃথিবীর ভীতি স্বরুপ, একমাত্র দেবতারা তার মৃত্যুর উপায় জানে। লড়তে গিয়ে তোমার জীবন বিপন্ন হতে পারে। শক্তিতে না কুলালে বেপরোয়াভাবে তার সাথে যুদ্ধ করো না, বাছা।
‘‘কেবল দেবতারাই ওয়াক মাংগানছি আরাগন্দিকে মারতে পারে, এ কথা সত্য। দেবতার আশীর্র্বাদ পেলে আমিও সে কাজ করতে পারব। মানুষের শত্রু এই শূকর দানবকে আমি হত্যা করবই।”
এই কথা বলে গয়রা মাআল মিত্তে ও থেংথে বাছার সাথে বন্ধুত্ব করে ওয়াক মাংগানছিকে হত্যার পরিকল্পনা করল। থআজেং আবালজেং গয়রার কাছে ফিরে এল দু’জনে খুজতে খুজতে শূকর দানবকে রাংসিৎরাম এ গিয়ে তার নাগাল পেল। গয়রা একা তাকে আক্রমণ করতে সাহস করল না। কুড়াল দিয়ে আঘাত করে শূকর দানবের ঘুম ভাঙানোর ভার পড়ল থআজেং আবালজেং-এর উপর। যুদ্ধের সময়ে পাথরের উপরে উঠে শত্রুকে মারবার জন্য পাথর সংগ্রহের ভার পেল মাআল মিত্তে ও থেংথে রা’ছা। পৃথিবীতে কোন পাথর না থাকায় মাআল মিত্তে পাতালে গিয়ে পাথর সংগ্রহ করলে থেংথে রা’ছা সেগুলো পৃথিবীতে জমা করে রাখতে লাগল।
গয়রা প্রস্তুত হলে থআজেং আবালজেং চুপে চুপে গিয়ে কুড়াল দিয়ে শূকর দানবের পাছায় কোপ বসালো। শূকরটা চমকে ঘুম থেকে জেগে উঠল। গয়রাকে দেখে গো ধরে চিৎকার করতে করতে সে তার দিকে দৌড়ে এলো। বিরতি বিহীনভাবে গয়রা তীর মারতে লাগল। সহ্য করতে না পেরে সে পালিয়ে গেল। তার পায়ের চিহৃ ধরে অনুসরণ করতে করতে গয়রা অনবরত তীর মারতে লাগল। আহত, রক্তাক্ত শূকর দানবটি পাহাড় ডিঙাতে না পেরে নকরেক, মিদাম, খিলবলমা, মিথংবল, জা’দিসিল, গংগ্রত, গাওয়াকমা, গাওয়ে, রামছেংগা, নেংগ্রু প্রভৃতি সমতল ভূমি দিয়ে দৌড়ে পালাতে লাগল। ক্ষান্ত না দিয়ে তীর মারতে থাকলে শূকরটা প্রবল আক্রোশে পিছু ফিরে গয়রাকে আক্রমণ করল। গয়রা মাআল মিত্তে ও থেংথে রা’ছার জমিয়ে রাখা পাথরের উপরে চড়ে বসল। সেও নাক দিয়ে পাথরগুলো এদিক সেদিক ছুড়ে পা দিয়ে মাড়িয়ে ফেলতে লাগল। পরে সে গয়রার পিছু ধাওয়া করে মাআদি, বালফাকরাম, ছান্দদেংগা, ছখুসুতে এমন এক বিপদজনক জায়গায় এল যেখান থেকে পালাবার আর কোন পথ ছিল না। বিপদ দেখে গয়রা চিৎকার দিয়ে উঠল:
‘‘মামা, আমাকে বাঁচাও, বাঁচাও!”
মামা আ’নিং দয়নাগ্রাক ছিনিং দয়নাগাজা শূকর দানবকে আঘাত করলে কাঁপতে কাঁপতে সে মাটিতে পড়ে গেল। গয়রা তখন ‘‘খা গয়রা! গিসিলগিপা, ওয়াসাগিপা, সিলছিয়ারিগিপা, রংসিলছি, রংগিলসিম” বলে মি’ল্লামের এক কোপে শূকর দানবের মাথা কেটে ফেলল। সেই থেকে কোন শত্রুর উপরে জয়লাভ করলে গারোরা এই গয়রার নাম করে এই কথা বলে থাকে। শূকর দানবকে হত্যার পর থেকে পৃথিবীতে গয়রার নাম বিখ্যাত হয়ে গেল। শূকর দানবের পেট চিরে দেখা গেল যে, রকমান মে’আ ছেংমান ফান্থে ও অন্যান্যরা তখনো অজ্ঞান অবস্থায় বেচে আছে। গয়রার নকফান্থেতে নিয়ে গিয়ে সেবা শুশ্রুষা করলে তারা প্রাণ ফিরে পেল।
সাত বছর ধরে গয়রা শূকর দানবের সাথে যুদ্ধ করেছিল। সেই সময়ে পৃথিবী জুড়ে কেবল ধুমধাম আওয়াজ শোনা যেত। মনে হত শূন্যে উড়ে, পাতালে নেমে যুদ্ধ চলছে।
শূকর দানবের মাংস কেটে জাফাংমা, খিংওয়াংমা, নকখিমা, জামখিমা, গারা গানছি, ছিসাক, মাৎছি, দুয়াল, মি’গাম, নংগাল, দিকগিল, খামাল সকলের জন্য বিলানো হল। যুদ্ধে জয়ে কৃতজ্ঞতা স্বরুপ শূকরের সিনা ও কান দেবতা বিশিকরম ও বিদতারের উদ্দেশ্যে দিকবিল ব্রি ফালওয়াং আ’দিংএ উৎসর্গ করা হল। বিলানোর পরও যে মাংস বাকী রইল সেটা বারিংগ্রি ও ফাকরেগ্রিতে স্তুপাকারে রেখে দেওয়া হল। দাওয়া, দবু ও চিৎমাং পাহাড়ে মাংস কাটার চিহৃ আজো দেখা যায়।
মাংস রান্না হলে কে বেশি খেতে পারে তা পরীক্ষা করবার জন্য গয়রা বাঘ ওয়ানা ওয়াংআকে আমন্ত্রণ জানালো। কিন্তু ওয়ানা ওয়াংআর সাথে পেরে উঠা সম্ভব ছিল না তাই সে একটা ফন্দি করল, খেতে খেতে এমন ভান করল যেন গলায় মাংস আটকে গেছে। চোখ উল্টে কোন রকমে বলল: ‘‘পানি”
ওয়ানা ওয়াংআ ত্রিশটা চোঙা নিয়ে সমেশ্বরী নদীতে পানি আনতে গেল। এ দিকে চোঙাগুলোর সব তলা ছিল ফুটো, যতই পানি ভরে সব বেরিয়ে যায়। সে পড়ে গেল বিপদে।
এদিকে গয়রা তাহার নিজের ভাগের মাংস পাহাড়ের এদিক সেদিক ছুড়ে ফেলে দিল।
ওয়ানা ওয়াংআ ফিরে এলে পাতের অবশিষ্ট মাংস খেতে খেতে গয়রা বলল:
‘‘তুমি বড্ড দেরি করেছ, আমার গলায় আটকে যাওয়া মাংস নেমে গেছে। পানির জন্য অপেক্ষা না করে আমি আমার ভাগেরটা শেষ করে ফেলেছি।”
ওয়ানা ওয়াংআ সব কথা বিশ্বাস করে নিজের ভাগেরটা স্পর্শ পর্যন্ত করল না। তার ভাগের মাংস সব অলিং ঝর্ণার তীরে পাথরে রুপান্তরিত হয়ে আছে।
গয়রার বিজয়ে আনন্দিত হয়ে তার মা বোনেরা সাতদিন সাতরাত আনন্দ উৎসব করল। দেবতার উদ্দেশ্যে পূজা দেওয়া হল, লোকজনকে খাওয়ানো হল।
‘‘গর্ভে ধারণ করা সার্থক হয়েছে” এই কথা বলে তার দিদিমা খুব আদর করে তাকে ‘‘ছু বিৎছি” খাওয়ালো।
দেব দেবীরা খুশি হয়ে তাকে আশীর্বাদ করল। এরপর গয়রা দেবতাদের মত বাড়ি তৈরি করল। সেগুলো আজো আলফাকরামে আছে।
।। কথক: জিংনাং মারাক রাকসাম, রংবিংগিরি. গারো হিলস।
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত
-
রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর উৎসব ওয়ানগালা
: রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও...
-
আজ লেখক ও চিন্তক আলবার্ট মানকিন-এর স্মরণসভা ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান
: মধুপুর গড়াঞ্চলের আদিবাসী নেতা, চিন্তাবিদ, লেখক, সমাজকর্মী, এনজিও কর্মী আলবাট...
-
গুলশান বনানী ওয়ানগালা ২১ অক্টোবর শনিবার
: গুলশান বনানী ওয়ানগালা ২১ অক্টোবর শনিবার আদি সাংসারেক গারো জাতিগোষ্ঠীর...
-
১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ...
-
রে রে : হায়রে আমার কাঞ্জিয়া ।। নীলু রুরাম
: সমর সাংমার রেরে নিয়েই শুরু করি তবে একটু আলাদা। আমাদের...
-
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিরাপদ ব্যবহার ।। জাডিল মৃ
: এক. সময় স্রোতের সাথে আবাহমান ছুটে চলা প্রযুক্তির উন্নতি, মানব...
‘রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর উৎসব ওয়ানগালা’
: রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও......বিস্তারিত
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত