Thokbirim | logo

২৬শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

পাহাড়ে নারীবাদী দর্শনের সাম্প্রতিক সংকট ও উত্তরণ ভাবনা ।। ডেনিম চাকমা

প্রকাশিত : মে ২৪, ২০২১, ২১:৩১

পাহাড়ে নারীবাদী দর্শনের সাম্প্রতিক সংকট ও উত্তরণ ভাবনা ।। ডেনিম চাকমা

এদেশের নারীবাদী দর্শন বা নারীর প্রতি পুরুষের সহিংসতাকে থিওরাইজ বা তত্ত্বায়ন করার ক্ষেত্রে কতগুলো সংকট তৈরি হয়। নারীর অভিজ্ঞতা যেমন রাজনৈতিক লড়াইয়ের পথ দেখায়, তেমনি একে কেন্দ্র করে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ওঠে।

ধর্মগত, জাতিগত, ভাষাগত, বর্ণগত, শ্রেণিগত, যৌনতাকেন্দ্রিক ও ক্ষততা কাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে নারীদের মধ্যকার ভিন্নিতাগুলো নারীর অভিজ্ঞতার জটিল ধরন হয়ে থাকে। যেমন, এদেশের ক্ষমতা কাঠামো বা অধিপতি সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরা।

পাহাড়িদের ওপর প্রতিদিনের নিপীড়ন বাঙালিদের কাছে ইস্যু হয়ে ওঠে না, গুরুত্বও পায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে সেনাবাহিনী/বাঙালিদের দ্বারা বড় ধরনের সহিংসতা যেমন ঘরবাড়ি পোড়ানো বা বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তার ওপর অন্যান্য সার্বক্ষণিক নিপীড়ন অধিপতি বাঙালির চোখের আড়ালে থেকে যায়। শ্রেণি, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ক্ষেত্রে সহিংসতা ভিন্ন হয়। 

নারীবাদ কেবলি যৌনঅধিকার আদায়ের আন্দোলন-লড়াই নয়, বরং এটি জীবনের প্রতিদিনের রাজনীতি, সেটিকে কেন্দ্র করে লড়াই। নারীর ওপর সহিংসতা পণ্য আর পুঁজিবাদের রাজনীতির যোগসূত্রে গঠিত। নারীর ওপর সহিংসতা প্রতিরোধ প্রকারান্তরে এক নিরন্তর লড়াই; এই লড়াই কেবল পুরুষতন্ত্রের লড়াই নয়, এই লড়াই ভোগবাদ, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধেও।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি নারী কোন বিশেষ অভিজ্ঞতা থেকে সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে “হিল উইমেন্স ফেডারেশন” গঠন করে সংগ্রাম চালিয়েছিল বা যাচ্ছে এই তাগিদ বোঝা পাহাড়ের নারীবাদী বা বাংলাদেশের নারী আন্দোলনকারীদের জন্য জরুরি।

বাঙালি পুরুষ দ্বারা, সেনাবাহিনী দ্বারা পাহাড়ি নারী প্রতিদিনই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শুধু এটা বললে হবে না যে সে নারী বলেই নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, বরং আমাদের অপরাপর ও সংশ্লিষ্ট কারণ অনুসন্ধান করতে হবে, আমাদের বুঝতে হবে যে, সে বাঙালি নয়, সে ভিন্ন জাতিসত্ত্বা বা আদিবাসী। সে পাহাড়ি। সে পাহাড়ের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, পাহাড়ের আদিবাসী জাতিসত্তা টিকিয়ে রাখার জন্য লড়াই করছে।

পাহাড়ি নারীর নির্যাতনের অভিজ্ঞতা কীভাবে একজন বাঙালি নারী বা পশ্চিমা নারীর অভিজ্ঞতা থেকে ভিন্ন, তা খুঁজে বের করতে হবে, জাতিগত ভিন্নতাকে তাত্ত্বিক গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু দেখা যায় যে এদেশের নারী আন্দোলনে পাহাড়ি নারীর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রান্তিকতাকে, তার নিপীড়নের অভিজ্ঞতাকে বুঝে না। বুঝতেও চায় না।

এদেশের নারী আন্দোলনে নারীদের মধ্যকার ভিন্নতা – শ্রেণি, ধর্ম, জাতি, বর্ণ, ভাষা-ইস্যু হিসেবে খুব একটা জায়গা পায়নি বরং পশ্চিমা সমাজ-বাস্তবতা নির্ভর ধ্যান-ধারণাই প্রধাণ্য পেয়েছে। ফলে আইনি সংস্কারের ওপরই প্রধান মনোযোগ দেওয়া হয় হয়েছে। সহিংসতা মোকাবেলায় এটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু একইসঙ্গে অপ্রতুল।

পশ্চিমাতে নারীবাদ ১৯৮০ ‘র পুরো দশক জুড়ে পূর্বতন নারীবাদী দর্শনকে একপেশে হিসেবে চিন্থিত করে। তাদের যুক্তি হচ্ছেঃ দার্শনিকেরা শুধু পশ্চিমের শ্বেতাঙ্গ মধ্যবিত্ত নারীর সমস্যা ও তার কারণ বিবেচনা করেছে; নিম্নবিত্ত নারী, বিভিন্ন সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর নারী, তৃতীয় বিশ্বের নারী, কৃষ্ণাঙ্গ নারী, এশীয় নারী, আফ্রো-আমেরিকান নারী বা আরব নারীদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার কারণ এ নারীবাদের বিবেচনার বাইরে ছিল।

চিত্রকর্ম তিতাস চাকমা

চিত্রকর্ম তিতাস চাকমা

নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বুঝতে আমাদের অবশ্যই শ্রেণি, বর্ণ, জাতি, ধর্ম, পেশা ইত্যাদির ভিত্তিতে অভিজ্ঞতাকে দেখতে হবে। একটি নির্দিষ্ট এলাকা, জাতি বা বর্ণের সঙ্গে ধর্ম, শ্রেণি পেশা বা অন্যান্য উপাদানগুলো পরস্পর ছেদ করে, পরস্পরের মধ্যে প্রবিষ্ট থাকে।

আর্থ-সামাজিক ভিন্ন হওয়ার অর্থ হচ্ছে নারীর প্রতি সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। যেমন মধ্যবিত্ত নারী আর গৃহশ্রমিক নারীর অভিজ্ঞতা আলাদা। তবে শুধু এটুকুই পার্থক্য নয়, এই মধ্যবিত্ত নারী যদি পাহাড়ি হয়, কিংবা হিন্দু ধর্মের হয় তাহলে মধ্যবিত্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের অভিজ্ঞতা মুসলমাননের তুলনায় ভিন্ন।

কঠিন হলেও সত্য যে, আমাদের পাহাড়ের সমাজে ধর্ষণের অস্তিত্ব ছিল না কিন্তু আমরা পাহাড়িরা দিন দিন যতো বাঙালির সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেছি বা আসতে হয়েছে ততো আমাদের পাহাড়ের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি নষ্ট হচ্ছে। ধর্ষণও আজকাল পাহাড়ে কিছুটা প্রভাব পড়েছে।

এদেশের বেশিরভাগ নারীবাদী সহিংসতা বিষয়ক আলোচনা পুরুষ কেন্দ্রিক বিদ্যমান, এবং এটা এক ধরনের সংকট তৈরি করে। এই আলোচনার কেন্দ্রে হচ্ছে, নিপীড়ক পুরুষ, পুরুষ-ই সহিংসতা ঘটায়, বা পুরুষ-ই সহিংসতার নায়ক এ ধরনের উচ্চারণ যা ধরে নেয় যে পুরুষের ক্ষমতা একচ্ছত্র। ধরে নেয় যে, সহিংস কাজে পুরুষ সক্রিয় আর নারী নিস্ক্রিয়।

এই চিত্রাঙ্কন নারীর নিস্ক্রিয় চেহারা তৈরি করতে সাহায্য করে। নারী মাত্রই সহিংসতার শিকার বা নারী দুর্বল বলেই সহিংসতার শিকার। তার কারণে সমস্যার সৃষ্টি হয়ঃ, পুরুষের কর্তৃত্বপূর্ণ আচরণ বৈধতা পায়। আর অন্যদিকে নারীও যে সহিংসতায় সক্রিয় হতে পারে, হয়ও যেমন ধরেন, রুয়ান্ডা বা আবু ঘারিব কারাগারের অত্যাচারী নারী, বা জল্লাদ শাশুড়ি তা চোখের আড়াল থেকে যায়।

এছাড়া রুয়ান্ডার গৃহযুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, শিশুহত্যার মতো সহিংস ঘটনায় নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, নারীর চিরাচরিত নিস্ক্রিয়তা, অ-সহিংস। সহিংসতা কেবল পুরুষই ঘটায় এধরনের পরিচয়/ধারণাকে ভেঙ্গে দেয়।

রুয়ান্ডার গৃহযুদ্ধে দেখা গেছে যে একজন নারী, জিনি মা, সেবিকা বা শিক্ষিকা হিসেবে রক্ষক, প্রতিপালকের ভুমিকা পালন করেছেন, তিনিই রাষ্ট্রের নাগরিক দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে শত্রু এথনিক গোষ্ঠীর নারী, পুরুষ বা শিশু হত্যা করতে, তাদের ধর্ষণ করতে সৈন্যদের সাহায্য করেছে।

যদিও রুয়ান্ডা গণহত্যার উপর প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে গণহত্যায় অভিযুক্ত এসব নারীরা, নারী বলেই সকল অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়েছে, শাস্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। ফলে আমরা বলতে পারি যে নারী যখন এ ধরনের সহিংসতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তখন সে তার নারীবাদী প্রটেক্টর এর ভূমিকাকে অতিক্রম করে।

শুধু রুয়ান্ডা নয় অসংখ্য উদাহারণ দেওয়া যায়, আমাদের দৈনন্দিন চেনাজানার মধ্যে ঘটে যাওয়া শাশুড়ির চিত্র, পতিতালয়ের সর্দারনী-সহিংসতায় নারীরা যে সক্রিয় হয় সেটাই স্পষ্ট। কিংবা পাহাড়িরা অনেকে মদ খায়। এখানে শুধুমাত্র পুরুষতন্ত্রের দোষ খুঁজলে হবে না। কারণ সেই মদ বেশিরভাগ কিন্তু নারীরাও তৈরি করে, সেই জন্য কিছুটা হলেও নারীদের কারণে বা এলিট সমাজের কারণে পাহাড়ে মদের প্রভাব বেশি পড়েছে। আবার এটিকে এলিট সমাজে বাবা-মা’রাও সমর্থন করে।

বাংলাদেশের নারী  সংগঠনগুলোর অন্যতম এজেন্ডা হলো নারীর ক্ষমতায়ন। সহিংসতার বিরুদ্ধে তাদের কার্যক্রম থেকে আমরা পাই, তাতে দেখা যায় যে যৌতুক, ধর্ষণ বা ফতোয়ার মতো ঘটনাগুলো তারা প্রাধান্য দেয়। নিকটাত্মীয় দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে ধর্ষণ বা ধর্মীয় রীতিনীতি কারণে ধর্ষণ ইত্যাদি এসব তাদের প্রাধান্যের বাইরে।

চিত্রকর্ম তিতাস চাকমা

চিত্রকর্ম তিতাস চাকমা

আমার মতে, একজন পুরুষ যদি যৌন চাহিদা মেটানোর জন্য বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক করতে পারে তাহলে নারী কেন পারবে না!? একজন পুরুষ যা করতে পারে একজন নারী কেন করতে পারবে না?

আমার মনে হয়, এদেশে সবচেয়ে বেশি নারী ধর্ষিত হয় বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে। এই দেশের নারী কেবলই হতে চায় নারী, মানুষ কখনো নয়। মস্তিষ্কচর্চায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। অবশ্য শৈশবে শিশুর চোখ দিয়েও দেখেছি আমরা নারী-পুরুষকে সমাজে পৃথক করার ভুমিকা। এসব কিছুই যেন কত স্বাভাবিক, প্রশ্নহীন, সর্বজনীন। এসব জানাশোনা দিয়ে তৈরি পুতুলখেলার রাজনীতি।

নারীর উপর সহিংসতাকে চিনতে বা বুঝতে হলে জাতিগত নিপীড়ন, পুঁজিবাদী বিশ্ব, ভোগবাদ, পুরুষত্ববাদ, রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় রাজনীতির সম্পর্কে আগে মনোযোগ দিতে হবে। এদেশের নারীবাদী তাত্ত্বিকদের কাছে নারীবাদী দর্শনের সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া যায় না।

নারীবাদী লড়াইয়ে ইতোমধ্যে অর্জিত হয়েছে। যেমন, নিপীড়নমূলক আচরণ, অত্যাচার, যৌতুক, বৌকে পেটানো, গালাগালি, শারীরিক, মানসিক-মানসিক-যৌন নির্যাতন। যেখানে কিনা আগে মনে করা হতো, এসব কিনা ব্যক্তিগত অর্থাৎ গোপনীয় বিষয়। নারীবাদীরা-ই প্রথম এ বিষয়গুলো তোলেন। তার আগে এগুলো অনুচ্চারিত বা অদৃশ্য ছিল।

নারীবাদী লড়াইয়ে ইতোমধ্যে অর্জিত হওয়া সত্ত্বেও এই বিষয়গুলো বিবেচনা না করলে এদেশের নারী আন্দোলনও বিশেষ শ্রেণির নারীর অধিকার আদায়ের ইস্যুভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে, দেশের, পাহাড়ের, ভিন্ন জাতিস্বত্তার সংস্কৃতি আর সব নারীর বিচ্ছিন্নতা বাড়তে থাকবে।



গারো উত্তরাধিকার আইন এবং পুরুষদের স্বোপার্জিত সম্পত্তি বিষয়ক আইনের বই  ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’

প্রমোদ মানকিন স্মরণে কবি মতেন্দ্র মানখিনের কবিতা

করোনায় পাহাড়ি আদিবাসীদের সংকটময় জীবন যাপন

করোনায় কেমন যাচ্ছে আদিবাসীদের জীবন 

করোনাকালীন তিনটি কবিতা ।। মতেন্দ্র মানখিন

একজন ভালো মনের মানুষ ব্রাদার গিয়োম ।।  কিউবার্ট রেমা

ইকো-ট্যু‌রিজম প্রকল্প বানাম ১৭ কোটি টাকার হিস্যা

গারো ভাষায় জেগে ওঠার গান -হাই আনচিং খ্রেংনা

 

 




সম্পাদক : মিঠুন রাকসাম

উপদেষ্টা : মতেন্দ্র মানখিন, থিওফিল নকরেক

যোগাযোগ:  ১৯ মণিপুরিপাড়া, সংসদ এভিনিউ ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। 01787161281, 01575090829

thokbirim281@gmail.com

 

থকবিরিমে প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। Copyright 2020 © Thokbirim.com.

Design by Raytahost