Thokbirim | logo

৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

গারো খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বড়দিন উপলক্ষ্যে প্রস্তুতি ও উদযাপন ।। ফাদার শিমন হাচ্ছা

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৫, ২০২০, ১৩:৫২

গারো খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বড়দিন উপলক্ষ্যে প্রস্তুতি ও উদযাপন ।। ফাদার শিমন হাচ্ছা

আজ ২৫ ডিসেম্বর। প্রভু যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের জন্য একটি পবিত্র দিন, শুভদিন, গুরুত্বপূর্ণ দিন। মানব মুক্তির ইতিহাসে যুগান্তকারী একটি ঘটনা, একটি নতুন অধ্যায়ের শুভ সূচনা। এদিনে ঈশ্বর মানুষকে  ভালোবেসে মানুষের রূপ ধরে নেমে এসেছিলেন এ জগতে, এসেছিলেন পতিত মানব সমাজকে উদ্ধার করতে। এ অন্যান্য মন্ত্রনাদাতা; শক্তিমান ঈশ্বর শাশ্বত পিতা, শান্তি রাজ, (ইস-৯:৬-৭) ইম্মানুয়েল (ইসা-৭:১৪) এ প্রতিশ্রুতি মুক্তিদাতার আগমনে ইস্রা্রায়েল জাতি নিয়েছিল ব্যাপক প্রস্তুতি, ঠিক তেমনি খ্রিস্টান সমাজও যিশু খ্রিস্টের জন্মবার্ষিকী সুন্দর ও পবিত্রভাবে পালন করার জন্য আধ্যাত্মিক ও জাগতিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে থাকে।

বাইবেলের পুরাতন নিয়মে ভাবী মুক্তিদাতাকে স্বাগত জানাতে ইস্র্রায়েল জাতি তাদের পাপের জন্য অনুতাপ ও অনুশোচনা করেছিল। প্রবক্তা যোয়েলের গ্রন্থে উল্লেখ আছে “উপবাস করো, চোখের জল ফেলতে ফেলতে বিলাপ করতে থাক। নিজের পোশাক নয়, নিজের হৃদয়টা ছিঁড়ে ফেল তোমরা। ভক্তম-লীর জন্য শুদ্ধি ক্রিয়ার আয়োজন করো। বৃদ্ধদের একত্র করো, শিশুদের এমনকি কোলের শিশুদেরকেও জড় করে আন, ভগবানের সেবাতেই যাজকেরা চোখের জল ফেলুক। ওগো ভগবান, তোমরা আপন জাতির মানুষদের রেহাই দাও(২:১২-১৭।”

“যাজকেরা চটের কাপড় কোমরে জড়িয়ে বিলাপ কর, যজ্ঞবেদীর সেবক যারা তোমরাও চিৎকার কর, এসো আমার পরমেশ্বরের সেবক যারা, চটের কাপড়ে সারারাত জেগে কাটাও, কারণ তোমাদের পরমেশ্বরের গৃহ শস্য নৈবেদ্য ও পানীয় থেকে বঞ্চিত। উপবাস পালনে নিজেদের পবিত্র কর।”(১:১৩-১৪ )

এভাবেই অনুতাপ ও অনুশোচনা করার মধ্য দিয়ে তারা শুনতে পেয়েছিল সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে এই বাণী “পৃথিবীর প্রান্ত সীমা পর্যন্ত আজ ভগবান ঘোষণা করে চলেছেন-কন্যাকে তুমি-একথা বলো, ওই দেখো, তোমার মুক্তিদাতা আসছেন। তার সঙ্গে, ওই দেখো, তাঁর অর্জিত পুরস্কার তাঁর সামনে, ওই যে, তার বিজয় সম্পদ, তোমাদের বলা হবে পবিত্র জাতি ভগবানের বিমুক্তজন” আর তোমাকে বলা হবে অণে¦ষিতা, অপরিত্যক্তা নগরী। (ইসা-৬২:১১-১২)

বর্তমান খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যেও ২৫ ডিসেম্বর প্রভু যিশুর জন্মবার্ষিকী পালনের খ্রিস্টভক্তদের বিশেষ আধ্যাত্মিক প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। যে দেশে (আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন) খ্রিস্টান সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে তারা বড়দিনের জন্য সেপ্টেম্বর মাস থেকেই প্রস্তুতির আয়োজন করে, নগর সাজানো, দোকানে বিভিন্ন আকর্ষণীয় জিনিস এনে ভোক্তাদের আকৃষ্ট করা বড় বড় রাস্তা বা বাড়ির আঙ্গিনায় গোসালা নির্মাণ করা, আলোকসজ্জা ইত্যাদি।

আমাদের বাংলাদেশে বিশেষভাবে গারো খ্রিস্টান অধ্যূষিত এলাকায় নেত্রকোণা, শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইলের মিশন/বিভাগ) বড়দিনের জন্য কীভাবে আধ্যাত্মিক ও সামাজিক প্রস্তুতি নেয়া হয় সে বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই।

১. আধ্যাত্মিক ও অন্যান্য প্রস্তুতি :

ক. ক্যাথলিক যাজকগণ ও অন্যান্য খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের পাস্টরগণ ডিসেম্বর মাস শুরু হওয়ার সাথে সাথেই খ্রিস্টান অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে গিয়ে খ্রিস্টভক্তদের নিয়ে প্রার্থনা/খ্রিস্টযাগ/বাইবেল আলোচনা করেন।

খ. ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের খ্রিস্টভক্তগণ যাজকদের কাছে ব্যক্তিগত পাপস্বীকার করে থাকে। অন্যান্য সম্প্রদায়ের খ্রিস্টভক্তগণ পূনর্মিলনী সভা করে থাকে, যাতে করে বড়দিনের পূর্বে ব্যক্তি ব্যক্তিতে যে রেষারেষি, মনোমালিন্য, ঝগড়াঝাটি, বিবাদ রয়েছে তা দূর করে দেওয়া। একজন আর একজনকে ক্ষমা দান করা যেমন, যিশু বলছেন-“তোমরা যদি পরের দোষত্রুটি ক্ষমাকর, তবে তোমাদের স্বর্গস্থ পিতা তোমাদের ক্ষমা করবেন, কিন্তু তোমরা যদি পরকে ক্ষমা না করো, তোমাদের পিতা তোমাদেরর দোষত্রুটি ক্ষমা করবে না।”(মথি ৬:১৪-১৫)

গ) যাজক/পাস্টরগণ প্রত্যেক খ্রিস্টান পল্লিতে গিয়ে খ্রিস্টযাগ/প্রার্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এবং প্রভুর ভোজের (খ্রিস্টপ্রসাদ) ব্যবস্থা করা হয়। এ খ্রিস্টপ্রসাদ লাভের ফলে খ্রিস্টভক্তদের অন্তরের বিশ্বাস যেন দৃঢ় ও সতেজ হয়।

ঘ. খ্রিস্টান পরিবারের বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, পঙ্গু, অন্ধ, মানসিক রোগী তাদের সুস্থতার জন্য বিশেষ প্রার্থনা। খ্রিস্ট প্রসাদ বিতরণ করা। খ্রিস্টপ্রভু তাদের জন্য, তা তারা যেন উপলব্ধি ও বিশ্বাস করতে পারে।

ঙ. প্রত্যেক খ্রিস্টান পরিবার পরিদর্শন করা বিশেষভাবে যে পরিবারে, অশান্তি বিশৃঙ্খলা, দাম্পত্য কলহ্, অভাবী, নির্যাতীত, অবহেলিত। সে পরিবারে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলা, শান্তি স্থাপনে চেষ্টা করা, কিছু অনুদান দেয়া যাতে সে পরিবাগুলোও সুন্দরভাবে বড়দিন উদ্যাপন করতে পারে।

চ. প্রত্যেক পরিবার বড়দিন আসার আগেই আঙ্গিনা পরিস্কার  করা, ঘর ছানী দেওয়া ঘরের ভেতরের/বাহিরে লেপ দেয়।

ছ. ছেলেমেয়েদের/আপনজনদের জন্য কাপড় তৈরি করা, উপহার সামগ্রী কেনা।

জ. শিক্ষিত সমাজে বড়দিনের কার্ড পাঠিয়ে পরস্পর-পরস্পরকে শুভেচ্ছা বিনিময় করা।

ঝ. বড়দিনের প্রীতিভোজ, পূর্বে গ্রামের সবাই মিলে একই বাড়িতে ভোজের আয়োজন করা হত ভোজের জন্য যাবতীয় খরচ-পাতি ঐ পরিবারই বহন করে থাকে। এটা আগের বছরই নির্ধারণ করে রাখা হত। কোন কোন গ্রামে এ রেওয়াজটা আছে আবার কোন কোন এলাকায় প্রত্যেক পরিবার থেকে লোক সংখ্যা অনুসারে চাঁদা সংগ্রহ করে পিকনিকের মত একটি নির্দিষ্ট স্থানে প্রেম ভোজের ব্যবস্থা করা হয়। এ প্রেম ভোজে প্রধান মেনুর মধ্যে থাকে শূকরের মাংস।

এভাবেই খ্রিস্টানগণ মাস ধরে বড়দিনের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে থাকে এবং বড়দিনের উৎসবের দিন মূলত ২৪ তারিখ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয়। সেদিন সন্ধ্যায় অথবা মধ্যরাত্রিতে (১২:০০) বিশেষ উপাসনা বা প্রার্থনা সভার আয়োজন করা হয়। উপাসনা অনুষ্ঠান শেষ হলে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পালা। সেদিনই আবার কোন কোন খ্রিস্টান পল্লিতে প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি গিয়ে দলবেধে কীর্তন গেয়ে রাত কাটায়।

২৫ ডিসেম্বর সকালে প্রতিটি গির্জায় খ্রিস্টযাগ বা প্রাথর্না অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এ সময় প্রত্যেক খ্রিস্টভক্ত উপাসনা অনুষ্ঠানে যোগদান করে থাকেন, তারা এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের হৃদয়ের অর্ঘ্য নিবেদন করে তাদের প্রিয় মুক্তিদাতার কাছে। হৃদয়ের অর্ঘ্য নিবেদনের শেষে তারা সবাই মিলে আয়োজিত প্রেম ভোজে অংশ গ্রহণ করে। এভাবেই মিলন ও আনন্দের মধ্য দিয়ে শেষ হয় বড়দিন উদযাপন।

।। কভার ছবি সংগৃহীত



 




সম্পাদক : মিঠুন রাকসাম

উপদেষ্টা : মতেন্দ্র মানখিন, থিওফিল নকরেক

যোগাযোগ:  ১৯ মণিপুরিপাড়া, সংসদ এভিনিউ ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। 01787161281, 01575090829

thokbirim281@gmail.com

 

থকবিরিমে প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। Copyright 2020 © Thokbirim.com.

Design by Raytahost