আমাকে সমাজে বন্ধু-বান্ধব, দুলাভাই টাইপের অনেকেই নানান নামে ডাকে। কেউ ডাকে কবি, কেউ গবেষক, কেউ কৃষিবিদ, কেউ নেতা, সাস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষানুরাগী, কেউ বলে অফিসার, সমাজ সেবক ইত্যাদি। জানিনা আমি এতগুলি নামের অধিকারী কিনা! কিন্তু আমি ভাবী সাধারণ একজন জেন্ডার-বান্ধব মানুষ। সবসময় জেন্ডার সমতায় আমি বিশ্বাসী। সাধারণ জেন্ডার-বান্ধব মানুষের পাশাপাশি আমি একজন পিতা। আদর্শ পিতা কিনা তাও বলতে পারছি না কারণ আদর্শ পিতার সঙ্গার অনেক বৈশিষ্টের সাথে আমি নিজেকে মিলাতে পারিনা। তবে চেষ্টা করি সন্তানদের অনেক ভালবাসতে, আদর করতে, তাদের নিয়ে সুন্দর সুন্দর জায়গায় ঘুরতে, সাজগোছ করাতে আর সকল ধরণের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাদের নিয়ে যেতে। বিশেষ করে বড় ছেলের (প্রোটিয়াস সাহিত্য আরেং) ছোট-বড় সব ধরনের আবদার রক্ষা করতে আমি সাধ্যমত চেষ্টা করি সবসময়, কিন্তু তার ছোটটার এখনও আবদার করার মত বয়স হয়নি। কখনও কখনও আবদার রক্ষা করতে পারিনা। কোন কোন ক্ষেত্রে অনেকদিন পরে হলেও আবদার রক্ষা করি। একসময় তার বয়স যখন ৩ বছর ছিল তখন তাকে নিয়ে তার মা এবং আমি বড়দিনের গির্জা অনুষ্ঠানে নিজ ধর্মপল্লীতে প্রার্থনা সভায় অংশগ্রহণ করছিলাম । তখন একবার মায়ের কাছে আর একবার বাবার কাছে দৌড়ে আসতো আর যেতো। গির্জা অনুষ্ঠানের মাঝ পথে একসময় আমাকে এমন করে বলল “চল বাবা আমাকে একটি বন্ধুক কিনে দাও।” আমি বললাম- “বাবা যিশু রাগ করবে এখন যাবনা, গির্জার পরে যাব।” কিন্তু কোনমতেই ছাড়লনা শুধু কাঁদতে লাগল। সহ্য করতে না পেরে আমি তাকে নিয়ে দোকানে গেলাম আর বিভিন্ন ধরণের বন্ধুক দেখালাম। সে একটি বন্ধুক পছন্দ করলো। বন্ধুকটি অনেক বড় আর আধুনিক মনে হল। দোকানদারের কাছে দাম জিজ্ঞেস করলাম, বাচ্চার আগ্রহের দিকে চেয়ে দুর্বল জায়গায় আঘাট হানার মত দোকানদার দুইহাজার টাকা দাম চাইলো। আমি দেখলাম এধরণের বন্ধুক আমি যে শহরে বাস করি সেখানে ৫০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা হবে। আমি দোকানদারকে বললাম, একহাজার টাকা দেব, দেন। কিন্তু দোকানদার বললো, এক পয়সাও কমাবোনা। তখন আমার এমন রাগ হলো, শিশুর আগ্রহের মত একটি দুর্বল জায়গা দেখে কায়দা করে সে এতগুলি দাম চাচ্ছে। শেষে রাগ করে অনেক কান্না করা সত্যেও ছেলেটাকে জোর করে নিয়ে আসলাম, গির্জায়। গির্জা শেষে ভাবলাম, জমি বিক্রি করে হলেও বন্ধুকটা কিনতে হবে। অবশেষে দুইহাজার টাকাই কিনে দিলাম। অনেক খুশী হলো সে। তার খুশী দেখে স্বর্গীয় সুখ অনুভব করলাম। আমি কিন্তু আসল বন্ধুকের কথা বলছিনা আপনাদের, খেলনা বন্ধুকের কথা বলছি। কখনও কখনও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমি যখন স্টেজে বিভিন্ন প্রোগ্রাকে অংশগ্রহণ করি, ঠিক সেই সময় হঠাৎ করে বাবাকে বিব্রত করে বাবার কোলে চলে যাওয়া ইত্যাদি অনেক বিব্রতকর পরিবেশে পরতে হয়েছে তাকে নিয়ে।এমন কিছু অভিজ্ঞতামূলক অনুভূতি আজ আপনাদের সাথে সহভাগিতা করতে চাই। একসময় আমরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ময়মনসিংহ জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী ‘চুগান’ উৎসব পালন করছিলাম। সেই অনুষ্ঠানে আমি সভাপতিত্ব করছিলাম, অপরদিকে ময়মনসিংহ জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক মুসতাকীম বিল্লাহ ফারুকী মহোদয় প্রধান অতিথি হিসেবে আসীন রয়েছেন। অনুষ্ঠানটি ঐতিহ্যবাহী নাচ-গান, বাদ্য-বাজনাসহকারে পালিত হচ্ছিল। ঠিক সেই মুহুর্তে তার মাকে (মায়া আরেং) ডিঙিয়ে হঠাৎ করে স্টেজে দৌড়ে এসে বাবার কোলে বসল। সবাই বাপ-ছেলের কাছে তাকিয়ে আছে। তখন আমি সত্যিকারভাবে খুবই বিব্রতকর অবস্থায় পরেছিলাম। পরে জোর করে তার মায়ের কাছে তাকে তুলে দেই। অনেক কান্না করছিল। তার কান্না দূর থেকে শুনা যাচ্ছিল কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ না হওয়ায় তাকে আদর করতে পারিনী। সেদিন একজন বাবা হিসেবে আমার অনেক কষ্টও হয়েছিল তার কান্না শুনে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করি পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলিতে নেতৃত্ব দেই, সেই কারণে বিভিন্ন সময় স্টেজে যেতে হয় আমাকে। এটা আমার জন্য একটি সাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু আমি কখনও কোন একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পুরোহিত্য করিনী। তবে একসময় আমার নিজ গ্রামে বড়দিনসংলগ্ন সময় হওয়ার কারণে পুরোহিত (ফাদার, রেভারেন্ড, পাস্টার, ফামং)না পাওয়ার কারণে একটি বিয়ে বাড়িতে ধন্যবাদ প্রার্থনা সভা পরিচালনা করার জন্য ঐ পরিবার এবং গ্রামের লোকেরা সাধাসাধি করছিল। আমি না করা সত্বেও তাঁরা জোর করলো, তাই বাধ্য হয়ে রাজি হলাম। কিন্তু বিয়ের প্রার্থনার সময় বাইবেলের একটি পদ “অতএব ঈশ্বর যাহার যোগ করিয়া দিয়াছেন, মনুষ্য তাহার বিয়োগ না করুক।” মথি লিখিত সুসমাচার: ১৯ অধ্যায়: ৬ পদ পাঠ করতে হয়। এপদ ছাড়া সাধারণত বিয়ের প্রার্থনা ভাল করে হয়না। সেই পদটি খুঁজেই পাচ্ছিলাম না। যাক অনেক কষ্টে ঐ ফাদার সেই ফামং করে যোগার হলো বাইবেলের পদটি ।যথারীতি প্রার্থনা সভা শুরু করলাম। উঠান ভরা মানুষ। আমি পুরোহিতের আসনে বসে বিবাহ বিষয়ে সারমন্ড(বয়ান)দিচ্ছিলাম। ঠিক সেই সময় হঠাৎ করে গির্জার বেদিতে দৌড়ে এসে বাবার কোলে বসে পড়ল। আমি এত বিব্রতকর হলাম আবার। ঐসময় তার মাসী (আম্মু বলে ডাকে সে)জয়া এসে জোর করে নিয়ে গেল। জোরে চিৎকার করে করে কাঁদতে লাগল। কি বিব্রতকর অবস্থা সেদিনও! এমন অনেক বিব্রতকর অবস্থায়ও ছেলেকে অনেক ভালোবেসে আদর-যত্ন করে লালন পালন করেছি আমরা। কিন্তু এখন সে একটু বড় হয়েছে, তাই তেমন বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেনা। সেইরকম পরিস্থিতির শিকার আর হয়না ইদানিং। কিন্তু ইদানিং কয়েক সপ্তাহ আগে সে আমার কাছে আবদার করল বাবা আমাকে ২০টি মার্বেল নিয়ে এসো। আমি তাকে কথা দিলাম আনবো বলে। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পার হওয়া সত্বেও আমি আর মার্বেল আনতে পারছিলাম না। সপ্তাহে আমি একবার করে বাড়িতে আসি। কিন্তু রাস্তার অনেক দোকান খুঁজেও আমি মার্বেল ক্রয় করতে পারিনাই, কারণ করোনাকালীন সময়ে মার্বেল নাকি শাপ্লাই হয়না। কি বিব্রতকর অবস্থা! শেষে আজ প্রাতিষ্ঠানিক সফরে নেত্রকোণা জেলার পূর্বধলায় গিয়েও অনেক খুঁজেছি কিন্তু পাইনি। না পেয়ে হতাশ হয়ে ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া উপজেলায়(নিজ উপজেলা) এসে, এদোকান সেদোকান করে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আর পাচ্ছিলামনা মার্বেলের সন্ধান। ঠিক সেইরকম একটি মুহুর্তে একজন বললেন, শাহীনের দোকানে পাওয়া যাবে। কিন্তু সেখানে গিয়েও পাওয়া গেলনা। হতাশ হয়ে ফিরে আসব ঠিক ঐমুহুর্তে হঠাৎ একজন বললেন, “আমার এখানে আছে কিন্তু দুই-একটি করে পেকেট ভেঙে বিক্রি করবনা।” জিজ্ঞেস করলাম, পেকেট মানে? দোকানদার বললো, বস্তা। বস্তা খোলা যাবে না। কি মুশকিল! ২০টির পরিবর্তে এক বস্তা? শেষে দাম জানতে চাইলাম এক বস্তা মার্বেলের দাম কত? দাম যাইহোক ভালোবাসার চেয়ে এক বস্তা মার্বেলের দামতো আর বেশি হতে পারেনা। শেষে ২০টি মার্বেলের পরিবর্তে এক বস্তা মার্বেল কেনা হল। বাড়িতে এসে তার হাতে তুলে দিলাম। ধরে রাখতে পারছিলো না সে ওজনের জন্য। পরে মা-ছেলে ধরে মাটিতে নামালো। আজ সে অনেক খুশী। তার খুশীতে আমরাও খুশী হলাম। ভালোবাসার চেয়ে অন্যকিছুর মূল্য তুলনা হতে পারে না।
লেখক পরিচিতি: কবি, পিএইচ.ডি গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্হীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত
-
রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর উৎসব ওয়ানগালা
: রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও...
-
আজ লেখক ও চিন্তক আলবার্ট মানকিন-এর স্মরণসভা ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান
: মধুপুর গড়াঞ্চলের আদিবাসী নেতা, চিন্তাবিদ, লেখক, সমাজকর্মী, এনজিও কর্মী আলবাট...
-
গুলশান বনানী ওয়ানগালা ২১ অক্টোবর শনিবার
: গুলশান বনানী ওয়ানগালা ২১ অক্টোবর শনিবার আদি সাংসারেক গারো জাতিগোষ্ঠীর...
-
১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ...
-
রে রে : হায়রে আমার কাঞ্জিয়া ।। নীলু রুরাম
: সমর সাংমার রেরে নিয়েই শুরু করি তবে একটু আলাদা। আমাদের...
-
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিরাপদ ব্যবহার ।। জাডিল মৃ
: এক. সময় স্রোতের সাথে আবাহমান ছুটে চলা প্রযুক্তির উন্নতি, মানব...
‘রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর উৎসব ওয়ানগালা’
: রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও......বিস্তারিত
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত