ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাদদেশ সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার সীমান্তঘেঁষা গ্রাম “রাজাই”। এ গ্রামেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন খাসিয়া জনগোষ্ঠীর এক বিপ্লবী রাজা উইক্লিব সিম। রাজা উইক্লিব সিম-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র বর্তমানে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক এন্ড্রু সলোমার এর সাথে দীর্ঘ দিনের পরিচয় লেখকের। সেই সুবাদে রাজার বাড়িতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ও সেই পরিবারের সাথে সুসম্পর্ক আছে। আজ ২১ শে অক্টোবর, এই মহান বিপ্লবী খাসিয়া রাজার ৩১তম মৃত্যু বার্ষিকী। এই দিনে তাঁর পরিবার ও এলাকাবাসী রাজাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আয়োজন করে প্রতিবছর। কিছুদিন আগে, উনার জ্যেষ্ঠ ছেলে এন্ড্রু সলোমার (লেখক কাকা বলে সম্বোধন করেন) এর কাছ থেকে আমন্ত্রণ পেলাম। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে এই বিপ্লবী রাজার মৃত্যুবার্ষিকীতে যাওয়ার সুযোগ হলো না। তবে এই প্রচারবিমুখ রাজার সংগ্রামের কথা মানুষকে জানানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। রাজার পারিবারিক ও বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে যতদূর জানতে পারি, রাজা উইক্লিব সিম, বর্তমান ভারতের মেঘালয়ের নংস্টইন (Hima Nongstoin ) রাজ্যের রাজা (‘Syiem Khynnah’) ছিলেন। পুরো নাম উইক্লিব সিম (১৯০৯-১৯৮৮)।
যে ব্যক্তির কথা বলছি, তিনি কোন সাধারন মানুষ ছিলেন না, তিনি উচ্চ শিক্ষিত, দূরদর্শীসম্পন্ন বীর বিপ্লবী খাসিয়া রাজা ছিলেন। খাসিয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রথম ইঞ্জিনিয়ার। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন গুজরাটের বারোদা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে, ১৯৩৭ সালে পাশ করেছেন। তারপর উচ্চতর পড়াশুনার উদ্দেশ্যে স্কলারশিপ পেয়ে ইংল্যান্ড গমন করেন। ওখান থেকে ফিরে, নংস্টইন স্টেটের রাজার দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। তিনিই রাজা হওয়ার জন্য উত্তরাধিকারী ছিলেন। বয়সের ভারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন তখনকার রাজা তাঁর আপন মামা সিব সিং সিম, কাজেই তাকেই রাজ্যের হাল ধরতে হয়েছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটিশদের হয়ে রোড কনস্ট্রাকশন বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে (বার্মা-মোরে রোড কনস্ট্রাকশন প্রজেক্টে) কাজ করেছেন। তখন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তাঁর দক্ষতা দেখে ব্রিটিশরা অবাক ও অনেক প্রশংসা করেছিলেন।
ইংরেজদের মেঘালয় দখলের পূর্বে, খাসি অধ্যুষিত অঞ্চল ২৫টি রাজ্যে বিভক্ত ছিলো। বিভিন্ন চতুর্মুখী দখলদারিত্ব সত্ত্বেও খাসি রাজ্যগুলোর স্বাতন্ত্র্যিক বৈশিষ্ট্য তাঁরা বজায় রেখেছিলো। অর্থাৎ শিলং , জোয়াইসহ কিছু অঞ্চল ছিলো – British territories অন্তর্ভুক্ত আর অন্যান্য খাসি রাজ্যগুলোতে ব্রিটিশদের আধিপত্য ছিলো না (British Government Had No Territorial Rights)। সঙ্গত কারণেই ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান ভাগের সময় যোধপুর, জুনাগড়, হায়দ্রাবাদ ,জম্মু- কাশ্মীর ও আরও কয়েকটি দেশি রাজ্যসহ বর্তমান মেঘালয়ের ২৫টি খাসিয়া রাজ্যগুলো স্ট্যান্ডস্টিল চুক্তির (Standstill agreement) আওতায় ছিলো, অর্থাৎ পূর্বের মত চুক্তি ও প্রশাসনিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হবে অন্তত ২ বছরের জন্য। কিন্তু ভারত সরকার সেনা পাঠিয়ে জোর পূর্বক ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাক্সেসন (Instrument of Accession and Annexed Agreement) চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে খাসি রাজাদের। রাজা উইক্লিব সিম এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন এবং ১৩ জানুয়ারি ১৯৪৮ নংস্টিনকে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করেন। এতে ভারত সরকার ক্ষুদ্ধ হয়ে তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করেন । একই বছর তিনি ভারত সরকারের আদেশ অমান্য করে মেঘালয় অর্থাৎ গারো হিলস এবং খাসিয়া হিলসকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করতে ভারত সরকারের কাছে পত্র পাঠান। পত্র পেয়ে সরকার তাঁকে বন্দি করার নির্দেশ দেন। আত্মসমর্পন করতে অস্বীকৃতি জানান। তাঁকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়। শেষে রাজা বাধ্য হন ভারত ছাড়তে, তারপর তিনি প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তান (বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশ) এর সিলেটে এসে সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন, তৎকালীন পাকিস্তান সরকারও রাজাকে পূর্ণ অধিকার দিয়ে স্থায়ীভাবে এদেশে বসবাস করতে অনুমতি দেন, স্বাধীনচেতা উইক্লিব সেখানে এসে আশ্রয় নেন বর্তমান রাজাই গ্রামে এবং বিয়ে করেন তাহিরপুরের এক সলোমার পদবির খাসি মেয়েকে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁকে নাগরিকত্ব দিয়ে জমিজমার বন্দোবস্তও করে দেয়। তাহিরপুরের ‘রাজাই’ গ্রামের নাম এই সাহসী রাজা উইক্লিব সিমের নামেই হয়েছে। যেহেতু রাজা উচ্চশিক্ষিত ছিলেন, পাকিস্তান সরকার রাজাকে অনেকবার চাকুরি করতে অনুরোধ করেন, তারপর অনেক চিন্তা করে তিনি ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখনায় ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পাকিস্তান অধ্যায়ের প্রথম চাকুরি শুরু করেন। থাকতেন পশ্চিম হাউজিং কলোনির ডি-টাইপ কোয়ার্টারে। (Source: East Pakistan District Gazetteers: Sylhet – থেকে তথ্যটি সংগ্রহীত, “The leader of the Khasis is an Engineer in Fertilizer Factory, Fenchuganj”.
এখানেই তাঁর বড় ছেলে এন্ড্রু সলোমার এর জন্ম। তাঁর এক শ্যালক (রমেশ জুয়েল) থাকতেন এবং কারখানার ফুটবল অঙ্গনে তিনি বেশ পরিচিত মুখ ছিলেন। তারপর ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, শেষে টেকেরঘাট চুনা পাথর প্রকল্পে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
তিনি ১৯৬৬ সালে তাহিরপুরের টেকেরঘাটে চুনাপাথর খনিজ প্রকল্প চালু হয়। রাজা উইক্লিব সিম নিয়োগ পান চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। অত্যন্ত রুচিশীল রাজা উইক্লিব সিম স্যুট-টাই পরে অফিসে যেতেন প্রতিদিন। তাঁর বাহন ছিল ঘোড়া। নায়েব-গোমস্তাও ছিল। শিকারেরও নেশা ছিল। তবে কারখানায় তখন অনেক কাজ। বেশি ফুরসত পেতেন না রাজা। ছুটির দিনে বেরোতেন জংলি শুয়োর শিকারে। ধানের মৌসুমে মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে এসে ফসল নষ্ট করতো। রাজার লাইসেন্স করা বন্দুক ছিল চার-পাঁচটি। বন্দুকগুলো এখনো যত্ন করে রেখে দিয়েছেন তাঁর ছেলে এন্ড্রু সলোমার। শিকারের দিন বিকেল-বিকেল বের হতেন। গভীর রাত করে ফিরতেন। তবে ঘোড়া ছুটিয়ে অফিসে যেতেন সকাল-সকাল। রাজার অফিস মানে টেকেরঘাট খনি প্রকল্পের আয়তন ৩২৭ একর। প্রকল্পের ভেতর গড়ে তোলা হয়েছিল বিদ্যালয়, ব্যাংক, বাংলোবাড়ি ইত্যাদি। অফিস এলাকায় দুটি টিলাও ছিল। জানা যায়, রাজা অবসরে গিয়েছিলেন ১৯৭১ সালে। আর প্রকল্পটি আশির দশকে লোকসানিতে পড়ে। ক্রমাগত লোকসান দিতে দিতে ১৯৯৬ সালে এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। টেকেরঘাট দেশের একমাত্র চুনাপাথর প্রকল্প। এখন এর ৬০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি অযত্নে পড়ে আছে টেকেরঘাটে। রাজা সাহেব যত দিন বেঁচে ছিলেন, সময় পেলেই প্রকল্প এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন, যন্ত্রপাতিগুলো দেখভাল করতেন। তাঁর আসলে মায়া জন্মে গিয়েছিল।
স্বাধীনচেতা রাজা নিজের রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন যদিও সেটা আর সম্ভব হয়নি। তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদেও টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন স্বাধিকারের ব্যাপারে, তারপর তিনি নিজে জাতিসংঘের সদর দফতরে যান এবং তিনি ইউএন এর সাধারণ পরিষদের কাছে তাঁর আবেদনটি পেশ করেছিলেন এবং তিনি হিমা নংস্টইন এবং খাসি ও জৈন্তিয়া রাজ্যগুলি সামগ্রিকভাবে তাদের সহায়তার জন্য বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ পর্যন্ত করেছিলেন। দু’টি দেশ, সিরিয়া এবং জর্ডান, তাঁর অনুরোধকে স্বীকৃতি দিয়েছিলো।
তিনি রাজনৈতিকভাবেই শুধু সচেতন ছিলেন না, ছিলেন আর্তমানবতাবদীও। সিলেটে প্রথমে একটি ক্লিনিক খুলেছিলেন এবং মানব সেবায় আত্মসমর্পন করেন ।
আজ ভারতের মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম হয়ে জম্মু কাশ্মীর পর্যন্ত স্বাধীনতা-স্বাধিকারের যে সুপ্ত বাসনা বুলেটবিদ্ধ হয়ে ঝাঁঝরা হচ্ছে বারবার, একাই এর শুভ সুচনা করেছিলেন রাজা উইক্লিব অহিংস পদ্ধতিতে, রাজার বেশেই ঘুমিয়ে আছেন বাংলার মাটিতে, যাদুকাটা নদীর তীরে বারিক টিলার পাশে, রাজাই গ্রামে, তাঁর সমাধিতে তারই সেই বিখ্যাত উক্তি লেখা রয়েছেঃ “I WILL NEVER SET FOOT ON ANY PART OF THE INDIAN TERRITORY; IF I WISH TO DO SO, I’LL COME AS A CONQUEROR” ।
আজ ২১শে অক্টোবর তাঁর মৃত্যু বার্ষিকী । এ দিনে মেঘালয় জুড়ে খাসি যুবকেরা দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে শপথ নেয় তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আর দৃপ্তকন্ঠে উচ্চারণ করে তাঁর বাণী- “INDIAN BY FORCE, KHASI BY BLOOD”
যথার্থই তাঁকে বলা হয়ঃ The Founder of Hynniewtrep (Khasi State) Nationalism।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নে অবিচল ছিলেন, আত্মসমর্পণ করেননি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের কাছে কোনদিন।
আজকে এই মহান বিপ্লবী, অবিচল নীতিতে বিশ্বাসী খাসিয়া রাজার মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা!
তথ্য সহায়িকা : খাসিয়া প্রিন্স এন্ড্রু সলোমর, ইফতেখার মাহমুদ হেলিম, কালের কণ্ঠ পত্রিকা, রাজা উইক্লিব সিমের পরিবার)
বাসন্তী রেমার নতুন জীবনের সূচনা, তৈরি হচ্ছে দোকান ও পাঠাগার
শুভ বিজয়া দশমী ।। প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হল দুর্গাপূজা
নভেম্বরে নতুন গান ‘সালনি থেং’সুয়ে’ নিয়ে আসছে গারো ব্যান্ড দল-ব্লিডিং ফর সার্ভাইভাল
ওয়ানগালার তাৎপর্য ও গুরুত্ব || রেভা. মণীন্দ্রনাথ মারাক
সোমেশ্বরী(সিমসাং)নদীর অবৈধ বালু উত্তোলনের প্রতিবাদে মানববন্ধন
আত্মকথা ।। আমার বাইপাস অপারেশন ।। ফাদার শিমন হাচ্ছা
সংগঠনের ৩১ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বিএমএসসি
বাসন্তী রেমার হাতে তুলে দেওয়া হলো দুই লাখ পঁচাত্তর হাজার টাকা
কোভিড-১৯ ।। নিজে সচেতন হই, অন্যকেও সচেতন করি।। মানুয়েল চাম্বুগং
সামনে আরো ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় গান নিয়ে আসতে পারবো আশা করছি ।। পিংকি চিরান (এফ মাইনর)
গানের শিক্ষক পল্লব স্নাল স্মরণে ।। মতেন্দ্র মানখিন
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত
-
রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর উৎসব ওয়ানগালা
: রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও...
-
আজ লেখক ও চিন্তক আলবার্ট মানকিন-এর স্মরণসভা ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান
: মধুপুর গড়াঞ্চলের আদিবাসী নেতা, চিন্তাবিদ, লেখক, সমাজকর্মী, এনজিও কর্মী আলবাট...
-
গুলশান বনানী ওয়ানগালা ২১ অক্টোবর শনিবার
: গুলশান বনানী ওয়ানগালা ২১ অক্টোবর শনিবার আদি সাংসারেক গারো জাতিগোষ্ঠীর...
-
১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ...
-
রে রে : হায়রে আমার কাঞ্জিয়া ।। নীলু রুরাম
: সমর সাংমার রেরে নিয়েই শুরু করি তবে একটু আলাদা। আমাদের...
-
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিরাপদ ব্যবহার ।। জাডিল মৃ
: এক. সময় স্রোতের সাথে আবাহমান ছুটে চলা প্রযুক্তির উন্নতি, মানব...
‘রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর উৎসব ওয়ানগালা’
: রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও......বিস্তারিত
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত