দেল্লাং নকমির গাকিমিৎদ
প্রথম পর্যায়ে সাংসারেক গারোরা মানুষ মরলে মরা লাশ আগুনে পুড়ে ছাই করে, পুড়ে যাওয়া কিছু হাড়, কিছু ছাই তুলে নিয়ে একটি ছোট ঘর তৈরি করে। এই ছোট ঘরের ভেতরে সাদা কাপড়ে বা লাল কাপড়ে দোলনা বেঁধে, সেই দোলনার ভেতরে পোড়া হাড় ও ছাই যত্ন করে রেখে দেয় এটাই দেল্লাং নকথিব বাংলায় ‘আত্মার ঘর’। সাংসারেক গারোদের বিশ্বাস এ রকম, পোড়া হাড় ছাই মরা গারোদের ব্যবহার্য জিনিস আবার ঘরে রাখলে আত্মা চলে যাবে না সেই সাথে দেল্লাং নকথিবে বসবাস করবে। যতক্ষণ মরা লোকের আত্মীয়-স্বজন গ্রাম প্রতিবেশী বিদায় দিবে না ততক্ষণ সেই আত্মার ঘরে বসবাস করবে সকাল বিকাল। আত্মার ঘরে খাবার দিতে হবে। আত্মার ঘরের আত্মাকে বিদায় দেওয়ার নির্দিষ্ট সময় আছে। সাংসারেক গারোরা ক্যালেন্ডার বানাতো শিমুল গাছে যখন লাল ফুল ফুটতো তখনি আত্মার ঘরের আত্মাকে বিদায় দেওয়ার উপযুক্ত সময়। এই বছর প্রস্তুতি নিতে না পারলে পরের বছর একই সময় দেল্লাং নকথিব বা আত্মার ঘর পুড়ে সবাই একত্র হয়ে আত্মাকে বিদায় দিবে, এটাই সাংসারেক গারোদের নিয়ম, এটাকে সাংসারেক গারো ভাষায় মিমাংকাম বলে।
মিমাং কামের বাংলা হল আত্মার কাজ। সংস্কৃতি কোনদিন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, পরবর্তীতে সাংসারেক গারোরা দেল্লাং নকথিব বা আত্মার ঘর তৈরি করেনি, শিমুল ফুল ফোটার জন্যে অপেক্ষা করেনি। মরার সাথে সাথে আত্মীয়-স্বজন গ্রাম প্রতিবেশী মিলে মাচাং তৈরি করে সাংসারেক গারোরা গানচি জাচাং বলে তার উপর রেখে লাশটি পুড়ে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে সব অনুষ্ঠানিক কাজ শেষ করে। আর দেল্লাং নকথিব তৈরি করেনি, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অপেক্ষা করেনি, সঙ্গে সঙ্গে মিমাংকাম বা আত্মার কাজ শেষ করে দেয়। আত্মার কাজকে শ্রাদ্ধও বলা হয়, আগে দেল্লাং নকথিব রাখায় ভাল ছিল, একটি বছর পর শ্রাদ্ধ খাওয়া দাওয়া হতো পরবর্তিতে মরা লাশকে সামনে রেখে শ্রাদ্ধ করা, খাওয়া দাওয়া করা ভাল দেখায় না। যখন দেল্লাং বা আত্মার ঘর পুড়ে শেষ করে শুধু জ্বলন্ত অঙ্গার লাল হয়ে জ্বলতে থাকবে তখন দেল্লাং গাকিমিৎদা নাচ শুরু হবে। এই নাচ শুধু মহিলারা করে। লাশ পুড়ানোর সময় যারা নাচবে তারা প্রস্তুতি নেয় মাথায় কথিব বা পাগড়ি বাঁধে। গলায় রিপবক রিকমাছু বা মালা পড়ে নতুন দকমান্দা বা জামা কাপড় পরে। আর যে মহিলারা নাচবে তাদের সব সময় পবিত্র হতে হয়। কামাল বা পুরোহিত আগেই ঘোষণা দেয়। দোষী বা অপবিত্র মহিলারা এই নাচে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। কারণ নাচতে নাচতে জ্বলন্ত অঙ্গার পায়ে মাড়িয়ে নিভাতে হবে, পবিত্র না হলে পা পুড়ে যাবে।
পুরুষেরাও প্রস্তুতি নেয় মাথা সাদা কাপড়ে কথিব বা পাগড়ি বাঁধে। বড় মোরগের লেজের লম্বা পালক অনেকগুলো একসাথে বেঁধে পাগড়ির উপরে বাঁধে, সাদা হাতাওয়ালা গেঞ্জি পড়ে। হাটু পর্যন্ত সাদা কাপড়ের ধুতি পড়ে কয়েকটি দামা বা ঢোল জোগার করে কয়েকটি রাং বা অন্য ধরনের করতাল দুই তিনটি আদুরো, এক ধরনের বাঁশি, দুই তিনটি কাল এটাও অন্য ধরনের বাঁশি আরো অন্যান্য বাদ্য বাজনা জোগার করে। সব কিছু প্রস্তুতি শেষ হলে কামাল বা পুরোহিত সবাইকে তার সামনে ডাকে দেবতাকে ভোগ দিয়ে মন্ত্র পড়ে যারা নাচবে তাদেরকে দেবতা যেন রক্ষা করে তার বর চায়। পরে আস্তে আস্তে বাজনা বাজাতে থাকে মহিলারা একজনের পিছনে আর একজন লাইন করে জ্বলন্ত অঙ্গারের চারদিকে বাজনার তালে ছন্দ মিলিয়ে নাচতে নাচতে চারিদিকে ধীর গতিতে ঘুরে। মাহিলারা তের বা পনেরজন কিংবা তার উপরেও থাকতে পারে। বাজনা বাদকেরা আস্তে আস্তে বাজনার গতি বাড়াতে থাকে মহিলারাও বাজনার সাথে তাল মিলিয়ে নাচের গতি বাড়ায়। মাহিলাদের দলনেত্রী আছে। সে সবার আগে থাকে তার পিছনের সঙ্গীরা নেত্রীর সাথে তাল মিলিয়ে নেচে নেচে অগ্রসর হয়। নাচের তাল না মিললে হবে না, উল্টা-পল্টা করলেও চলবে না। মরা লাশ পুড়ানো জ্বলন্ত অঙ্গার বাজনার তালে তালে নাচতে নাচতে পায়ে মাড়িয়ে জ্বলন্ত অঙ্গার নেভাতে হবে। বাজনা দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়, নাচও তাল মিলিয়ে দ্রুততর হয়। দ্রুত নাচতে নাচতে সামনের দলনেত্রী হঠাৎ পা দিয়ে জ্বলন্ত অঙ্গার ছিটিয়ে দেয়। আর পিছনে যারা নেচে নেচে অগ্রসর হয়, তারা পায়ে পাতা দিয়ে মাড়িয়ে জ্বলন্ত অঙ্গার নিভিয়ে ফেলবে, নিভানো শেষ হলে আবার দল নেত্রী নাচতে নাচতে পা দিয়ে অঙ্গার ছিটিয়ে দিবে। এভাবে কিছু সময় জ্বলন্ত অঙ্গার নেভানোর পর বাদকেরা বাজনার গতি কমিয়ে দেবে, মহিলারাও নাচের গতি কমিয়ে দেবে।
এক সময় বাজনা বন্ধ করলে নাচও বন্ধ হয়ে যায়। সবাই বিশ্রাম নেয়। ভুল ত্রুটি থাকলে আলোচনার মাধ্যমে সারিয়ে নেয়, কিছু নাস্তা পানি করে সবাই এক ফং মদ্য পান করে, শুকিয়ে যাওয়া গলা ভিজিয়ে নেয়, বয়স্ক-বয়স্কা লোকেরা পরামর্শ দেয়। আবার আস্তে আস্তে বাজনা বাজতে থাকে। দল নেত্রী উঠে দাঁড়ায়, তার পিছনে সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ায়। বাজনার তালে তালে লাশ পুড়ানো জ্বলন্ত অঙ্গারের চারিদিকে নাচতে নাচতে ঘুরতে থাকে।
এই দেল্লাং গাকিমিৎদা নাচ তারাতারি শেষ হয় না, তিন চার ঘন্টা মাঝে মাঝে আরো বেশি সময় লাগে। এটা দলনেত্রীর উপর নির্ভর করে, সে যত তাড়াতাড়ি জ্বলন্ত অঙ্গার পা দিয়ে ছিটিয়ে দিতে পারবে তত তাড়াতাড়ি শেষ হবে। সব সময় অঙ্গার পায়ে মাড়িয়ে নিভিয়ে ছাই করলেই শেষ নয়, বিশ্রাম নিয়ে যারা নেচেছে তারাই লাশ পুড়ানো ছাই হাতে নিয়ে উপস্থিত সবার গালেও মাখিয়ে দেবে। যারা বাদ্য বাজনা বাজায় তাদের গালেও ছাই মাখাবে, কেউ না করবে না, উঠে দাঁড়িয়ে পালাবে না, মরা দেহের ছাই মাখতে দেবে, এটাকে সাংসারেক গারোরা দিম মরক খাল্লা বা ছাই খেলা বলে। ছাই মাখানো খেলা বেশি সময় নেয় না আধা ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। এই ছাই গালে মাখানোর ব্যাখ্যা আছে, এতে মরা লোকের আত্মা শান্তি পাবে, সবাই তাকে ভালবেসে আদর করে গালে ছাই মাখিয়ে বিদায় দিচ্ছে।
ছাই খেলার পরে বাজনা বাদকেরা উঠে দাঁড়াবে দামা বা ঢোল গালায় ঝুঁলিয়ে সারি সারি লাইন করে দাঁড়াবে, প্রত্যেক বাদকের বাম পাশে একজন মহিলা দাঁড়াবে। পুরুষেরা নেচে নেচে ঢোল বাজাবে আর মহিলারা ডান হাত মাথা সমান উপরে উঠাবে, আর হাতের পাতা আঙ্গুল নাড়িয়ে নেচে নেচে হাত নাড়য়ে বিদায় জানাবে, সাংসারেক গারোরা বলে ‘জাকপা দারেং উললেংই’ অনুষ্ঠান শেষ করে। বিদায় অনুষ্ঠান বেশি দেরি করে না। সেই লাশ পুড়ানো জায়গার চারিদিকে কয়েকবার ঘুরেই শেষ, প্রথমে আস্তে বাজনা বাজায় আর আস্তে নাচে পরে জোরে তাড়াতাড়ি বাজায় আর নাচও দ্রুত হয়। তারপর বাজনা আবার খুব আস্তে আস্তে নামায় আর নাচও আস্তে হয়ে যায়। এক সময় বাজনাও থামে নাচও থামে, তার মানে শেষ। এই অনুষ্ঠান যেহেতু সারাদিন ব্যাপী হয় তাই সবার জন্যে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা, দূরে কাছের আত্মীয়-স্বজন গ্রাম প্রতিবেশী সবাই উপস্থিত থাকে। এই হলো সাংসারেক গারোদের মিমাংকাম বাংলায় শ্রাদ্ধ, গোত্র ভেদে ভিন্ন রকমও হতে পারে, সব গোত্রের মিমাংকাম দেখতে পারিনি।
।। প্রচ্ছদ নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
মাটিরাঙ্গায় ফুটবল টুর্নামেন্টে থৈলা পাড়া একাদশের উপর হামলা, আহত ৭
কামারখালি গ্রামবাসীরা ভাগ্যবান ।। জর্জ রুরাম
একদিন আমার পৃথিবী ।। ফাদার বাইওলেন চাম্বুগং
https://www.facebook.com/thokbirim/videos/1163701897348748
সামাজিক বনায়নের নামে আদিবাসীদের নিজ বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে দ্বিতীয় দিনের বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ।
Gepostet von Thokbirimnews.com am Mittwoch, 16. September 2020
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত
-
রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর উৎসব ওয়ানগালা
: রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও...
-
আজ লেখক ও চিন্তক আলবার্ট মানকিন-এর স্মরণসভা ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান
: মধুপুর গড়াঞ্চলের আদিবাসী নেতা, চিন্তাবিদ, লেখক, সমাজকর্মী, এনজিও কর্মী আলবাট...
-
গুলশান বনানী ওয়ানগালা ২১ অক্টোবর শনিবার
: গুলশান বনানী ওয়ানগালা ২১ অক্টোবর শনিবার আদি সাংসারেক গারো জাতিগোষ্ঠীর...
-
১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ...
-
রে রে : হায়রে আমার কাঞ্জিয়া ।। নীলু রুরাম
: সমর সাংমার রেরে নিয়েই শুরু করি তবে একটু আলাদা। আমাদের...
-
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিরাপদ ব্যবহার ।। জাডিল মৃ
: এক. সময় স্রোতের সাথে আবাহমান ছুটে চলা প্রযুক্তির উন্নতি, মানব...
‘রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর উৎসব ওয়ানগালা’
: রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও......বিস্তারিত
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত