বাসন্তীর বাবা প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে ভাত খেয়ে ইন্ডিয়া পাহাড়ে যায়। সেখান থেকে লাকড়ি এনে বাজারে বিক্রি করে যে টাকা পায়, তাা দিয়েই সে পরিবার চালায়। বি. এস. এফ-রা যেদিন ইন্ডিয়া বর্ডার কড়া নিরাপত্তা দেয় সেদিন বাসনন্তীর বাবা পাহাড়ে যেতে না পরে না, তখন তাদের অনাহারে থাকতে হয়। অভাবের সংসার হলেও কষ্ট করে বাসন্তীর বাবা তার চার ছেলেমেয়েকেই পড়াশুনা করায়। তার স্বপ্ন ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে একদিন প্রতিষ্ঠিত হলে তাকে আর কষ্ট করতে হবে না। এই বুকভরা আশা নিয়ে সে প্রতিদিন পরিশ্রম করে।
একদিন হলো কী! প্রতিদিনের ন্যায় বাসন্তীর বাবা ইন্ডিয়া পাহাড় থেকে লাকড়ি নিয়ে আসছিলো, সেই সময় কয়েকজন বি. এস. এফ ঝোপঝাড় থেকে, ‘এই মামা, মামা, এডারমে আজা আজা’ বলে তাকে ডাক দেয়। বাসন্তীর বাবা শুনেও না শুনার ভান করে লাকড়ি ফেলে জঙ্গলে দৌড় দেয়। বি.এস.এফ-রা তাকে দেখতে পায় না। তারপরও তারা রাগ করে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। একটি গুলি বাসন্তীর বাবার পায়ে লাগে। মাটিতে পড়ে সে যন্ত্রনায় কাতরায়। তার পরনের গেঞ্জি ছিড়ে গুলিবিদ্ধ ক্ষতস্থান বাঁধে। বি. এস. এফ-রা তাকে খোঁজে না পেয়ে চলে গেলে সে খোঁড়িয়ে খোঁড়িয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
এদিকে তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে অপেক্ষা করে; রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার মধ্যস্থতায় ঈশ^রের কাছে প্রার্থনা করে তাদের বাবা যাতে নিরাপদে বাড়িতে পৌঁচ্ছতে পারে। তাদের প্রার্থনা শেষ হওয়ার পর পরই বাসন্তীর বাবা পায়ে গুলিবিদ্ধ যন্ত্রণায় আ-উ করে বাড়ির উঠানে পৌঁচ্ছে বাসন্তীর মাকে ডাক দেয়। তারা সবাই ঘর থেকে বের হয়ে গুলিবিদ্ধ পা দেখে হাউমাউ করে কাঁদে। তাড়াতাড়ি গরম পানি সিদ্ধ করে ক্ষতস্থানটি ধুয়েমুছে পরিস্কার করে।
এক দিন যায় দুই দিন যায় বাসন্তীর বাবার গুলিবিদ্ধ ক্ষতস্থানটি ভাল হয় না। এক পায়ে বর দিয়ে সে খোঁড়িয়ে খোঁড়িয়ে হাঁটে। আগের মতো আর পরিশ্রমের কাজ করতে পারে না। বাসন্তীর মা বাধ্য হয়ে মোড়ল বাড়িতে জি-এর কাজ করে। সারাদিন কাজ করে যা পায় তা দিয়েই পরিবার কোনোমতে চলে। পরিবারের এই দুর্বিসহ অবস্থা বাসন্তী মেনে নিতে পারে না। সে চিন্তা করে পরিবারের বড় মেয়ে হিসেবে তার কিছু করা দরকার, বিশেষ করে তার বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে অপারেশন করতে হবে যাতে সে আগের মতো হাঁটতে পারে এবং পরিবারও যাতে ভালমতো চলতে পারে । এই চিন্তা নিয়েই সে একদিন তার বাবা-মাকে তার ইচ্ছার কথা জানায়।
কিন্তু তার বাবা-মা তাকে কোনো মতেই ঢাকায় ছাড় ছিলো না। কারণ তাদের পরিচিত বলতে ঢাকায় কেউ নেই। বাসন্তীর ঢাকায় কাজ করতে যাবে শুনে একদিন এক বুড়ি তাদের বাড়িতে এসে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, “জনেশ শুনলাম বাসন্তী না-কি ঢাকায় যাবে?” জনেশ বললো, “ও-তো যেতে চায়, আচ্ছা মাসিমা আপনিই বলেন তো জানাশুনা নাই কীভাবে তাকে পাঠাই?” বুড়ি বললো, “জনেশ তাহলে এককাজ করো আমার মেয়ের বাসায় ৫ মাস থেকে ঢাকা শহরের পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানুক, সাথে সাথে আমার নাতিকে দেখাশুনা করুক। আমি আমার মেয়েকে বলবোনে প্রতিমাসে তোমাদেরকে যেন ৫ হাজার করে টাকা পাঠায়। আর হ্যাঁ চাকরির জন্য একদম চিন্তা করবে না আমার মেয়ের জামাইই ঠিক করে দিবে।” বুড়ির কথা শুনে বাসন্তীর বাবা-মা ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে তাকায়। মুচকি হেসে বুড়ি আবার বললো, “কি-হে জনেশ পাঠাবে না? জনেশের বলার আগেই বাসন্তী খুশি হয়ে বললো, “দাদি আমি যাবো কবে নিয়ে যাবেন।” বাসন্তীর খুশি দেখে জনেশ বললো, “ঠিক আছে মাসিমা আপনি যেটা ভাল বোঝেন সেটাই করেন”
দুই দিন পর বাসন্তী বুড়ির সাথে ঢাকায় আসে। এখানে তার কাজ ছোট্ট ১ বছরের শিশুর দেখাশুনা ও রান্নাবান্না করা। বুড়ির মেয়েটি ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নার্স করে। তার স্বামী মাস্টার্স পড়–য়া চাকরি খুঁজে না পাওয়ায় বেকার অবস্থায় বাসায় পড়ে থাকে। অলস মস্তিস্ক না-কি শয়তানের কারখানা। যেদিন বাসন্তী তাদের বাসায় উঠে সেদিন থেকেই বাসন্তীর প্রতি তার অন্যরকম দৃষ্টি। যতই দিন যায় ততই বাসন্তীর প্রতি তার লোভ বাড়তে থাকে। একদিন প্রতিদিনের মতো তার স্ত্রী যখন হাসপাতালে চলে যায় তখন সে ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে যেখানে বাসন্তী ও তার ছোট্ট শিশু বিছানায় বসে সিরিয়াল দেখছিল সেখানে গিয়ে টিভির সাউনড বাড়িয়ে দিয়ে বাসন্তীকে বিছানায় ঝাপটিয়ে ধরে। বাসন্তী চিৎকার করে কাঁদে। যাতে কেউ এসে তাকে বাঁচায়। কিন্তু কেউ এলো না। আসবেই বা কেমন করে বাসন্তীর কান্নামিশ্রিত আত্মচিৎকার সবই টিভির সান্ডেদের কাছে কিছুই নয়। বাসন্তী যাকে মামা বলে ডাকতো সেই নরপশুটি বাসন্তীকে ভোগ করার পর গলাটিপে বললো, “সাবধান যদি কাউকে বলে দিস তাহলে গলাটিপে মেরে রাস্তায় ফেলে দিবো। বাসন্তী এতে আরো ভয়ে খুকখুক করে কাঁদে। বিকেল তিনটার দিকে সেই নরপশুটি যখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিল তখন বাসন্তী বাসা থেকে বের হয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
দীর্ঘ ৮ ঘন্টার যাত্রা করে রাত ১০টার দিকে বাড়িতে পৌঁচ্ছে বাসন্তী তার বাবা-মাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। বাসন্তীর মা শুনেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। তার বাবা রাগে দুঃখে একজনকে সঙ্গে নিয়ে থানায় মামলা করতে যাচ্ছিল। কিন্তু যেতে পারলো না। বাসন্তীর মা বাঁধা দিয়ে বললো, “ও-গো তোমার কাছে কি টাকাপয়সা আছে থানায় যাচ্ছো? থানায় মামলা করলে তো আমাদের ভিটে বাড়ি বিক্রি করতে হবে। এক কাজ করো-না মাতববের কাছে যা।” বাসন্তীর বাবা, স্ত্রীর কথা মতো গ্রামের মাতবরের কাছে বিচার চাইতে যায়।
এক সপ্তাহের পর গ্রামের মাতবর তাদের বাড়িতে সালিশ ডাকে। উঠানের সামনে মাতবর চেয়ারে বসে আছে। তার ডান ও বাম পাশে গ্রামের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ। সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বাসন্তী ও তার মা-বাবা-ভাইবোনেরা, বুড়ি ও তার মেয়ে ও জামাই। তাদের চর্তুদিকে গ্রামের লোকজন। মাতবর যথাসমযে সালিশ শুরু করে। প্রথমেই বাসন্তীর বাবাকে বলতে বললো। বাসন্তীর বাবা হাত-পা কাঁপতে কাঁপতে বলতে শুরু করে, “আপনারা জানেন আমি অনেক আশা নিয়ে আমার মেয়েকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম যেন পরিবারের কিছুটা উপকার হয়। কিন্তু সেটা না হয়ে ঠিক উলটো হলো। আমার মেয়েকে এই বুড়ির জামাই ধর্ষণ করেছে। আমি এর ন্যায্য বিচার চাই।” বুড়ির আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে একজন উৎতেজিত হয়ে চিৎকার করে বলে, “অ্যাই ন্যায্য বিচার চাই না, ন্যায্য বিচার, নিজের মেয়ে যে কতখারাপ, নষ্টামি সেটা বলবে কে।” বাসন্তী কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু বলতে পারলো না। বুড়ির মেয়ে তাকে চুলটেনে মারে। বাসন্তীর মা তাকে সরিয়ে কেঁদে কেঁদে বলে, অন্যায় করেছে নিজেরা আবার মারে লজ্জা করে না।”
মাতবর সবাইকে থামিয়ে পরিবেশ শান্ত করে জামাইকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার সম¦ন্ধে ওরা যা বলছে সবই কি সত্যি ?” জামাই উত্তর দেয়,“না একদম না, সবই মিথ্যে বানানো।” বাসন্তী চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বলে, “মাতবর সাফ ও-যা বলছে সবই মিথ্যে, সে আমাকে রেফ করেছে।” বুড়ির মেয়ে ও তার আত্মীয় স্বজনরা রেগে দাঁত কটমট করে বলতে শুরু করে, “স্বর্ণার বাবা তাকে রেফ করেছে না, রেফ করেছে, যদি রেফই করে থাকে তাহলে তার প্রমাণ কই।” বাসন্তী ও তার বাবা-মা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। কারণ তাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই। মাতবর আবার সবাইকে শান্ত করে বাসন্তীকে জিজ্ঞেস করলো, “বাসন্তী তোমার কাছে কি কোনো প্রমাণ আছে? বাসন্তী কোনো উত্তর দেয় না। সে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ভাবছে ছোট্ট এক বছরের নিষ্পাপ শিশু কি সাক্ষ্য দিবে, সে তো কথাই বলতে পারে না।
এক পর্যায়ে গ্রামের মাতবর বাসন্তীর বাবাকে বুড়ি ও তার মেয়ে ও জামাই এর কাছে ক্ষমা চাইতে বলে। বাসন্তীর বাবা মাথা নিচু করে খোঁড়ায়ে খোঁড়ায়ে ক্ষমা চাইতে যায়। বাসন্তী কেঁদে কেঁদে তার বাবার পিছনে গিয়ে বাবার হাত টেনে যেতে মানা করে বলে, “যেও না বাবা, যেও না আমি বরং ক্ষমা চাইবো।” কিন্তু বাসন্তীর বাবা কোনো কথা শুনে না সামনে এগুতে থাকে। বাসন্তী সেখানে আর থাকতে পারে না। তার জন্য বাবা ক্ষমা চাইবে এটি সে সহ্য করতে পারলো না। সেখান থেকে সে আসতে আসতে বের হয়ে গোলো।
তার চোখ মুখে এখন কান্না নেই। আছে লজ্জা, অপমাণ ও কষ্টের মেঘচ্ছন্ন মুখ। তার চুলগুলো মৃদুমন্দ বাতাসের তালে তালে উড়ছে। ওড়নাটি গায়ে থাকলেও না থাকার মতো ঘাড় থেকে বুকের এক পাশ দিয়ে মাটির সাথে লেগে যাচ্ছে। কোথায় যে যাচ্ছে সে নিজেও জানে না। যেতে যেতে এক গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করে। যেখান থেকে সে আর ফিরলো না।।
প্রচ্ছদ তিতাস চাকমা
আরো লেখা…
সাংসারেক গারো নাচ ।। দেল্লাং নকমির গাকিমিৎদা ।। তর্পণ ঘাগ্রা
https://www.facebook.com/thokbirim/videos/1163701897348748
সামাজিক বনায়নের নামে আদিবাসীদের নিজ বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে দ্বিতীয় দিনের বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ।
Gepostet von Thokbirimnews.com am Mittwoch, 16. September 2020
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত
-
১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ...
-
রে রে : হায়রে আমার কাঞ্জিয়া ।। নীলু রুরাম
: সমর সাংমার রেরে নিয়েই শুরু করি তবে একটু আলাদা। আমাদের...
-
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিরাপদ ব্যবহার ।। জাডিল মৃ
: এক. সময় স্রোতের সাথে আবাহমান ছুটে চলা প্রযুক্তির উন্নতি, মানব...
-
বর্তমান সময়ের তুমুল জনপ্রিয় শিল্পী দিশন অন্তু রিছিলের জন্মদিন আজ
: বর্তমান সময়ের তুমুল জনপ্রিয় শিল্পী দিশন অন্তু রিছিলের জন্মদিন আজ।...
-
বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবতোষ যেত্রা আর নেই
: হালুয়াঘাট উপজেলার ৪নং সদর ইউনিয়নের কালিয়ানীকান্দা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা পাস্টার...
-
কেনিয়ার কৃষকরা হাতি তাড়াচ্ছে মৌমাছি দিয়ে
: কেনিয়ায় হাতির তাণ্ডব থেকে ফসল রক্ষায় ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে কৃষকরা।...
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত