Thokbirim | logo

২৫শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | ১০ই ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

আদর্শ গারো মা  ।। ধীরেশ চিরান

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৬, ২০২০, ১৪:৫২

আদর্শ গারো মা  ।। ধীরেশ চিরান

পাহাড় পাদদেশীয় জনাকীর্ণ হাম্পাল একটি প্রত্যন্ত গারো অধ্যুষিত জনপদ। শিক্ষাদীক্ষা তেমন নেই বললেই চলে। এলাকার গুটিকতক গ্রামে দু’একজন গ্রাজুয়েট দেখা মেলে। তাও শিক্ষার আধিক্যে মেয়েরা পাল্লায় ভারি। আশির দশকে গারোদের ডিগ্রি মাস্টার্স ডিগ্রিধারী ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা প্রায় দ্বিগুণ ছিল। তখন ডিজিটাল যুগের পূর্বে প্রধান শিক্ষক বিবাল অবসরে এসে এলাকায় একটি হাই স্কুল স্থাপনের উদ্যোগ নেন। পাঁচ থেকে সাত কিলোমিটার হাম্পালের ত্রিসীমান্তেও কোন হাইস্কুল ছিল না তখন। তার লক্ষ্য শিক্ষা বির্বজিত জনাকীর্ণ এই হাম্পালের মানুষকে আলোকিত করা। তিনি কর্ম জীবন শুরুর ১৯৬২ সাল থেকে দীর্ঘদিন ধরে নামিদামী স্কুলে শিক্ষাদান করে অনেক মানুষকে আলোকিত করেছেন। প্রধান শিক্ষক পদ থেকে অবসর নিলেও তার লক্ষ্য, মানুষকে শিক্ষাদান থেকে বিরত থাকতে পারেননি বিবাল। তার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে এক ধনাঢ্য মহিলা স্কুল স্থাপনের জন্য প্রায় তিন একর জমি দান করেন। সেই জমিতে ঐতিহাসিক অনিন্দ্য সুন্দরী গারো মেয়ের নামে ‘যুগিগপ্পা হাই স্কুল’ শুরু হয়।

প্রধান শিক্ষক বিবালের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল শিক্ষকতার সময় তিনি অনেক ছাত্র ছাত্রীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। তার ইচ্ছা ছিল এই মহান কাজে সেই সব ছাত্র ছাত্রীদের আলোকিত মানুষ গড়ার কাজে অংশীদার করা। বিবালের এই মহান উদ্যোগকে সফল করার জন্যই আমরা কজন অংশীদারিত্ব নিয়ে এগিয়ে আসি এবং শিক্ষকতার দায়িত্ব নেই। নতুন স্কুল স্থাপনের কথা ভাবা যত সহজ কাজটা কিন্তু ততটা সহজ নয়। তবে গ্রামের মানুষ বলে থাকেন ‘ক্ষেতে গেলে কাজের বাও’।

প্রধান শিক্ষক বিবালের নেতৃত্বে আমি, জুমাং, জাজং তিনজনে ক্ষেতে নামলাম। আমাদের সাথে এক মুসলিম বন্ধু বাসুভাই যোগ দিলেন। ক্লাশ শুরু হল ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ১৭ জন ছাত্র ছাত্রী নিয়ে এক আম গাছের তলায়। আমাদের চাহিদাটা একটা আকাশ কুসুম কল্পনা ছিল তখন। সবাই দু তিন বছর কাজ করেছি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সে অভিজ্ঞতাটা শিক্ষকতার জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম যে, যুগিগপ্পা হাই স্কুলকে প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। মানুষের চেষ্টার ফলে নাকি পাথরেও ফুল ফুটে। পাথরে ফুল ফুটানোর চ্যালেঞ্জই নিয়েছিলাম আমরা।

আমাদেরকে সাহস যুগানোর জন্য যোগ দিল আমাদের এক সহযোদ্ধা ৎরমা। তবে শিক্ষক হিসেবে নয়। গ্রামে ৎরমাকে সবাই মালফং বলে ডাকে। তবে মালফং আমাদের কাছে ৎরমা নামেই পরিচিত স্কুল কলেজ জীবন থেকে। আমাদের কলেজ জীবনে আমরা সাত জন বন্ধু ছিলাম যার মধ্যে চার জন ছিটকে পড়ল চাকরি নিয়ে। আমরা তিন জন আধা বেকার। ছাত্র জীবনে আমার প্রিয় গান মান্না দের বিখ্যাত ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গানটি গাইতাম এবং জমিয়ে আড্ডা দিতাম। সাত বন্ধুর মধ্যে দুইজন ছিল মেয়ে ৎরমা ও গিসিক। আমাদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া এতই মধুর যে কাউকে ভুল  বোঝার কোন সুযোগ ছিল না। ৎরমা ও গিসিক দু’জনই উচ্চ শিক্ষিত স্বচ্ছল ঘরের মেয়ে। দু’জনই দেখতেও বেশ সুন্দরী। অনেকে তাদের রাইসংমা বলত। একটা স্বচ্ছল ঘরের উচ্চ শিক্ষিতা সুন্দরী মেয়ে এবং ভাল একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হিসেবে রাইসংমা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের সাথে দু’জনের গর্বটা ছিল শূন্যের কোঠায়।

আমরা চার বন্ধু আমি, জুমাং, জাজং ও ৎরমা। স্কুলের ছাত্র সংগ্রহ করার জন্য ঘুরতাম আশেপাশের গ্রামের বাড়ি বাড়ি এবং গার্জেনদের উৎসাহিত করতাম যুগিগপ্পা হাই স্কুলে ছাত্র/ছাত্রী পাঠানোর জন্য। সাড়াও পেলাম গোটা দিন দশের মধ্যে। স্কুলে ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা হল আড়াইশ’র উপরে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যুগিগপ্পা হাই স্কুল এবার হবেই হবে। কাজের অবসরে আমরা চার বন্ধু এলাকার বিভিন্ন জায়গায় এক সাথে ঘুরতাম। তবে কারোর বাড়িতে নয়। রাস্তা ঘাট, খোলা মাঠ, পাহাড় নদীর সৌন্দর্য্য আস্বাদন করার জন্য চষে বেড়াতাম এদিক ওদিক চার জনে।

সেই সুন্দর জায়গাগুলোয় গারো পাহাড়ের পাদদেশীয় বহতা নদী চিজাঙ্গি ও জ্রাংচির বালুতে যদিও ইমারত গড়া হত না, তবে এক হাটু জলে নেমে জল কেলি করতাম আমরা। অনেকে বলত: তিন ছেলে এক মেয়ে এরা যে কী করে! তবে এলাকার সবাই জানত আমরা চার জন ভাল বন্ধু। শীতে জীর্ণশীর্ণকায় চিজাঙ্গি ও জ্রাংচি বর্ষায় কিন্তু খুবই খরস্রোতা ও প্রমত্তা। এই নদী পাড়ের পাহাড় ঘেরা লীলাভূমি পাখির চোখে দেখার জন্য মাঝে মধ্যে টিলায় উঠে ওয়াচ টাওয়ারের মত দেখে নিতাম প্রকৃতির ক্যানভাসে রাঙিয়ে দেয়া রূপ রং আর বৈচিত্র্যের ছবির মত জনপদের দৃশ্য। কিন্তু এই ক্যানভাসেও কোথায় যেন একটা শূন্যতা অনুভব করতাম আমাদের মধ্যে। এত আনন্দের মধ্যেও প্রায় সময় ৎরমার মনে বিষণ্নতা লক্ষ্য করতাম। ৎরমা খোলা মনের মানুষ হলেও কি যেন লুকাত আমাদের কাছে। ৎরমার বিষন্নতার কারণ উৎঘাটনে আমরাও চেষ্টা করতাম। আমরা তিন জন প্রায় সময় তাদের বাড়িতে যেতাম এবং বেশ জমিয়ে আড্ডা দিতাম। তার গার্জেনরাও আমাদের অন্যভাবে দেখতেন না, দেখতেন ৎরমার একান্ত বন্ধু হিসেবে। আমাদের সম্পর্ক বেশ আন্তরিক ছিল এবং তা শুধুই একে অপরের সাথে একান্ত বন্ধু হিসেবে।

তবে ৎরমার উচ্চাকাঙ্খা ও স্বপ্ন ছিল গগণচুম্বী। গারো সমাজে অবস্থান করে তার সেই স্বপ্ন পূরণ করা আদৌ সম্ভব ছিল না তখনকার সময়ে। গারোদের মধ্যে শিক্ষায় তখন মেয়েরা বেশ এগিয়ে ছিল। স্বাভাবিকভাবেই একজন শিক্ষিত গারো মেয়ে আশা করতেই পারে তার প্রিয় মানুষ শিক্ষাদীক্ষায় তার চেয়ে বেশি বা সমান বৈ কম হবে না। ৎরমার ভাবনাটাও অমূলক নয়। ৎরমাও চিন্তা করে তার প্রিয় মানুষ হবে একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, মেজিস্ট্রেট অথবা উচ্চ শিক্ষিত স্বচ্ছল একজন ব্যক্তি। তার সেই চিন্তা ভাবনাকে পুঁজি করে কিছু সুযোগ সন্ধানী আর্থিক স্বচ্ছল বিজাতীয় ব্যক্তিগণ তাদের বাড়িতে বেশ আনাগোনা করত। যদিও ঐ ব্যক্তিদের সাথে তার তেমন কথা হত না, কোন সম্পর্কও ছিল না।

সে সময় অতি উচ্চাকাংঙ্খী কিছু শিক্ষিত গারো মেয়ে গ্লোরি, মিকস্খিম, নিকসেং, রেংসিসহ গোটা সাতেক নিজ সমাজকে ছেড়ে অন্য সমাজে চলে গেছে। তার প্রভাব কিছুটা হলেও পড়ছিল সমস্ত গারো এলাকার উচ্চ শিক্ষিত গারো মেয়েদের উপর। পরিবেশ অনুকূলে থাকলে একজন মেয়ে কত দিন মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারে! পারিপার্শ্বিক চাপের কারণে একদিন হয়তো সমস্ত বাঁধ ভেঙে যেতে পারে মুহূর্তের মধ্যে। ৎরমাও চাপের মুখে ছিল। আমরা তিন জন একান্ত বন্ধু হিসেবে ৎরমাকে বুঝাতাম, সঙ্গ দিয়ে খোলাখুলি বলতাম, তুমি যদি গারো হিসেবে সমাজে থাকতে চাও তবে আমাদের সমাজে যা আছে তা নিয়েই ভাবতে হবে। আমাদের সমাজে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, মেজিস্ট্রেট খুঁজলে প্রিয় মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু সে প্রতিনিয়তই চাপের মুখে পড়ছিল পরিবার ও প্রভাবশালীদের জন্য। এই ব্যাধি থেকে মুক্ত করার জন্য আমরা তিন জন ৎরমাকে নিয়ে একটা নাটক সাজালাম। প্রায় সময় ৎরমাকে নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরতে থাকলাম প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সামনে দিয়েই।

মাঝে মাঝে আমি তাদের সামনে দিয়ে ৎরমাকে ডাকতাম ‘ৎরমা আস বেড়াতে যাই’। তার মা মৃদু আপত্তি করে ৎরমাকে বলত, তুমি ওদের সাথে যাও কেন ? কিন্তু ৎরমার মাসি বলতেন, যাক না বন্ধুদের সাথে, একা একা ঘরে বসে কী করবে ? কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দপাধ্যায়ের মত সেদিন আমি নায়কের মত তার মায়ের ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সামনে দিয়ে ৎরমাকে বেড়ানোর জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম। বলতে গেলে আমরা অজান্তেই ৎরমার সাথে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছি পরিবেশের কারণে। বার বার একই চিত্র দেখে প্রভাবশালী বিজাতীয় ব্যক্তিরা হতবাক হয়ে ভাবল, ৎরমাকে পাওয়ার চেষ্টা করা দুরাশা। তারা ৎরমার বাড়িতে আনাগোনা কমিয়ে দিল। কিছুদিন পর ৎরমাদের বাড়িতে আসা ছেড়েই দিল তারা। ৎরমা আমাদের কথা দিয়েছিল অন্য গারো মেয়েদের মত সে একই কাজ করবে না; যতই যোগ্যতা থাক কোন বিজাতীয় ব্যক্তিকে সে প্রিয় মানুষ করবে না কোন দিনও। সমান অসমান হউক নিজের সমাজের মধ্যে থাকবে সে। ৎরমা বলত আমি একজন আদর্শ গারো মা হতে চাই। পরবর্তীতে আমরা চলে এলেও সে তার কথা রেখেছিল এবং সমাজের মধ্যেই একজন গারো ছেলেকে প্রিয় মানুষ হিসেবে বেছে নিয়ে আদর্শ গারো মা হয়েছে।

শাব্বাশ ৎরমা! তোমার আদর্শের জন্য তোমাকে স্যালুট জানাই। তুমি পেরেছ একজন আদর্শ গারো মা হতে এবং অন্য অতি উচ্চাকাঙ্খী গারো মেয়েদেরও অনুপ্রাণিত করতে। ৎরমার আদর্শকে অনুসরণ করে সংসার জীবনে নিজের সমাজের ছেলেদের প্রিয় মানুষ করেছে অনেক গারো মেয়ে তখন।

প্রচ্ছদ তিতাস চাকমা

১৯৬৪ সালের রায়ত ।। শুধু আদিবাসী হত্যা নয় একটি ইতিহাস-সংস্কৃতির বৈচিত্র্যকেও হত্যা করা বটে ।।  সরোজ ম্রং

কেগিজা খিম্আ (অসবর্ণ বিবাহ) ।। গারো বিবাহ আইন




সম্পাদক : মিঠুন রাকসাম

উপদেষ্টা : মতেন্দ্র মানখিন, থিওফিল নকরেক

যোগাযোগ:  ১৯ মণিপুরিপাড়া, সংসদ এভিনিউ ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। 01787161281, 01575090829

thokbirim281@gmail.com

 

থকবিরিমে প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। Copyright 2020 © Thokbirim.com.

Design by Raytahost