কড়া বিলুপ্তপ্রায় ক্ষুদ্র এক জাতিগোষ্ঠী। মাত্র ১৭টি পরিবার নিয়ে দিনাজপুরের বিরল উপজেলার হালজায় রাঙ্গন গ্রামে বসবাস করে আসছে এই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠি। রাস্তার এধার ওধার নিয়ে হালজায় ও রাঙ্গন গ্রাম। কড়াদের মতে এই হালজায় রাঙ্গন গ্রামেই তাদের অস্তিত্ব। তবে বিরল উপজেলার সীমান্তের বড়াইপাড়ায় ১টি পরিবার আর দিনাজপুর সদরের ঘুঘুডাংগা গ্রামে ২টি পরিবার আছে বলে জানা গেছে। বিলুপ্ত প্রায় এই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠি মূলত কৃষি নির্ভর। নিজেদের জমিজমা এখন অন্যদের দখলে। এইসব বিরূপ প্রতিকুলতার কারণে অনেকেই দেশান্তর হয়েছে। দৈনন্দিন জীবন জীবিকা নির্বাহ করে অন্যের জমিতে শ্রম দিয়ে। সারা বছর অভাবে অভাবে দিন কাটে তাদের। তারপরও সামর্থ্যরে মধ্যে যতটুকু করা সম্ভব তা দিয়ে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব কারাম পূজায় সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে সকলে মিলে আনন্দ উৎসব করেছে।
কড়া পাড়ায় এ ধর্মীয় কারাম (খিল কদম) গসাই (গাছ) উৎসব ভাদ্র মাসে পাঁচদিন ধরে হয়। তাই ঘরে ঘরে উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা সকলে। এই উৎসব গত ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১১ তারিখে বিকেলে বালুমাটি মিশানো মাটি বাঁশের (বড় ও ছোট দু’টি) ডালিতে ভরে মাসকলাই বীজ বুনার মধ্য দিয়ে প্রথম দিনের কারাম পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। শেষ হয় ১৩ সেপ্টেম্বর সকাল ১০ ঘটিকায়। ঘরের মেয়েরাই মাসকলাই বুনে। কড়া আদিবাসীদের বিশ্বাস, ঘরের মেয়েদের কাছেই পরিবারের সকলের জন্য সৃষ্টিকর্তা আর্শিবাদ দিয়ে থাকেন। তাই ভাদ্র মাস আসলেই মেয়েরা শ্বশুর বাড়ি থেকে নিজ বাবা মা’র বাড়িতে আসে ও সপ্তাহব্যাপী এই পূজার নানা আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নেয়।
মাসকলাই বুননকারী সকলে ডালিতে নিজ নিজ সীমানা চিহ্নিত করে রাখে বিশেষ গাছের ডাল বা কাঠি ব্যবহার করে। বিবাহিতরা সিঁদুর আর অবিবাহিত মেয়েরা কাঠিতে কাজল মাখিয়ে নিজেদের সীমানা চিহ্নিত করে রাখে। তাছাড়া ডালির মাঝখানে সামাজিকভাবে মনোনিত একজন পুরুষ বাঁশের কাঠি দিয়ে সীমানা করে বীজ ছিটিয়ে দেয়। শেষের দিন যে জায়গায় মারুয়া বা আখড়া (পূজার স্থান, পূজার স্থানকে কড়া ভাষায় মারুয়া বা আখাড়া বলে) করা হয়েছে, সেখানে মনোনিত এই পুরুষ-ই কারাম গাছের ডাল (খিল কদম গাছের ডাল) গেড়ে দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতায প্রধান ভূমিকা পালন করে। মাসকলাই বুনার পর থেকে বুননকারী মেয়েরা শুধু নিরামিষ খেয়ে থাকে। আর সেই মনোনিত পুরুষেরও নিরামিষ খেতে হয়। তাদের বিশ্বাস এই, কেউ যদি পাঁচদিনে নিরামিশ খাওয়ার নিয়ম ভাঙে অর্থাৎ আমিষ বা মাছ খায় তাহলে তার মাসকলাই চারার সীমানায় মাছের আঁশ দেখা যাবে, আর কেউ যদি গরম ভাত খায়, তাহলে কলাই চারা ভাল গজাবে না বা লালচে রং ধারণ করে মরে যাবে। এইভাবে ডালিতে মাসকলাই বুনার মধ্য দিয়ে সৃষ্টিকর্তার প্রতি তাদের বিশ্বস্ততার পরীক্ষা করে থাকে।
মাসকলাই বীজ বুনার পর ডালি দুটি মাহাত (গ্রাম প্রধান)-এর বাড়িতে রাখা হয়। এই ডালি যে কেউ ছুতে বা ধরতে পারে না, শুধুমাত্র মেয়েরা-ই ছুতে বা ধরতে পারে। তবে অবিবাহিত পুরুষরাও এই ডালি ছুতে বা ধরতে পারে। প্রতিদিন তিনবার (সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায়) করে মাসকলাই চারাতে হলুদ মিশানো পানি ছিটিয়ে দেয়। আর পঞ্চম দিনে চার বার পানি ছিটিয়ে দেয়। তাছাড়া প্রতিদিন হলুদ পানি ছিটানোর সময় মাসকলাই ডালি নিয়ে মেয়েরা মারুয়া বা আখড়ার চারিপাশে গান গেয়ে ও নেচে নেচে আনন্দ করে।
শেষের দিন সর্ববৃহৎ পূজা। সকাল থেকেই মাসকলাই বুননকারী মেয়েরা উপোস থাকে এই আশায় যে, সৃষ্টিকর্তা যেন সারাবছর তাদের পরিবারে সুখ শান্তি’র আর্শিবাদ বর্ষণ করেন এবং রোগ ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভ করেন। মনোনিত সেই পুরুষও উপোস থাকে। উপোস করা মেয়েদের জন্য পরিবার থেকে নতুন শাড়ি দেয়া হয়। আর মনোনিত পুরুষের জন্যও নতুন সাদা ধূতি দেয়া হয়। আর সন্ধ্যা হওয়া মাত্রই পূজার স্থান মারুয়া বা আখাড়াতে সেই ডালি দুটি (বড়টি পিড়িতে ও ছোটটি মাটিতে) পাশাপাশি রাখা হয়। পাড়ার নারী পুরুষ সকলে মারুয়া বা আখাড়া স্থানে তিনটি তিনটি করে শাপলা ফুল দিয়ে সাজাতে সাজাতে গাইতে থাকে-
‘ফুলাকে গেড়য়া কোনামাসে শিংআসনে
ভাদরা মাসেতো শিংআসনে’।
অর্থাৎ
ফুল দিয়ে মন্ডপ কোন মাসে সাজাই
ভাদ্র মাসে সকলে মিলে সাজাই।
সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে ঢোল মাদল বাজিয়ে মনোনিত পুরুষকে নতুন সাদা ধূতি কাপড় পড়িয়ে কারাম গাছের (খিল কদম গাছের ডাল) ডাল নিতে জঙ্গলে যায়। সাথে থাকে কাসার থালায় হরেক রকমের ফুল, মাটির প্রদীপ, ধান পাতা, দুবলা ঘাস ও ধুপ হাতে সকলে আনন্দ করতে করতে গাছের ডালে পিঠা ঝুলিয়ে সৃষ্টিকর্তার নামে উৎসর্গ করে গাছের ডাল কেটে নিয়ে আসে ও মারুয়া বা আখাড়াতে গেড়ে দিয়ে গাইতে থাকে-
এঁ হিয়ো গামাকের
ভাদর রামহে
মাওয়ান জেনিয়াতো হোরে
দেলিয়োকো (ডালি) দেওয়া ফুলাহারা মুরুগা
কাঠ্ঠামোর দিয়ানে ঘুরাই
বোনাসে বাধা খেলে যাই।
অর্থাৎ
এখানে এই গ্রামে
ভাদ্রমাস আসলে
নতুন শাড়িতে সেজে নতুন রূপে মেয়ে
ডালিতে মাসকলাই, শাপলা ও
মোরগ নিয়ে
আখড়াতে ঘুরে ঘুরে বন্দনা করি।
এরই মধ্যে মারুয়া বা আখড়ার পাশে মাটির প্রদীপ জালানো হয়। ধুপ দিয়ে মারুয়া বা আখড়া’র পাশে বসেন পূজারী যোগেন কড়া। তিনি গ্রামের মাহাতো (গ্রাম প্রধান)। পূজার স্থানে দুটি মোরগ, কলা পাতায় আতব চাল, বোতলে চুয়ানি (মদ), সিদুর ও কাঁসার ঘটিতে পানি নিয়ে পূজারী প্রথমত একটি মোরগকে পানি ছিটিয়ে চুয়ানি মিশানো আতব চাল খাওয়ায়, ও মাথায় সিদুর পরিয়ে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে বলি উৎসর্গ করে। একই ভাবে আরেকটি মোরগও উৎসর্গ করে। উৎসর্গকৃত মোরগের মাংস পরের দিন সকালে মাহাত-এর বাড়ীতে খিচুরি রান্না করে সকলকে একটু একটু করে খাওয়ানো হয়।
এদিকে মাসকলাই বুননকারী মেয়েরা নতুন শাড়ি ও নিজস্ব অলংকারে সজ্জ্বিত হয়। নিজ নিজ বাড়ি থেকে মাটির প্রদীপ জালিয়ে, পিঠা, সিদুর, ফুল ও ভিজানো কাঁচা ছোলা কাঁসার থালায় সাজিয়ে প্রথমত শিব দেবতার প্রতি প্রণাম জানায়। তারপর মারুয়া বা আখড়ার চারি পাশে গোল হয়ে বসে। সোনিয়া কড়া অর্নগল গান গাইতে থাকে, পাশে শেফথি কড়া সুরে সুরে গায়। অন্যান্যরাও তাদের সাথে সাথে গাইতে থাকে-
লতন লতন সুপ (কাপড়) দিয়া
লতন পারবেতি
আঝো কারামাকের রাতি।
অর্থাৎ
নতুন নতুন কাপড়ে সাজে মেয়ে
মা তুমি বাতি জালাও তেল দিয়ে
আজকের কারামের রাতে।
পূজা শেষে সাতান কড়া কারাম পূজার ইতিহাস বলতে থাকে। আর ইতিহাস বলার সময় মেয়েরা নিজ নিজ থালা থেকে আখড়া বা মারুয়া’র কারাম গাছের ডালে ফুল ছিটিয়ে দেয়। এভাবে অনেকক্ষণ ইতিহাস বলা চলতে থাকে। পরবর্তীতে তারা সুতায় বাঁধা পিঠা কারাম গাছের ডালে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে বেঁধে দেয়। আর মেয়েরা নিজ নিজ পরিবারের জন্য আর্শিবাদ প্রার্থনা জানায়। কড়া জাতিগোষ্ঠির বিশ্বাস সৃষ্টিকর্তা পরিবারের জন্য মেয়েদের কাছে-ই আর্শিবাদ দিয়ে থাকেন। কোন কারণে কারও পরিবারে যদি কোন মেয়ে না থাকে বা পূজায় উপস্থিত হতে না পারে তাহলে পরিবারের ছেলেকে মেয়ে সাজিয়ে হলেও সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে আর্শিবাদ চেয়ে নেয়। পূজা শেষে উপোসকারী মেয়েরা ভিজানো কাঁচা ছোলা খেয়ে উপোস ভাঙে।
গল্প শেষে সকলে মিলে কারাম গাছের চারিদিকে গানের সাথে সাথে নাচতে থাকে। কাঁসার থালায় মাটির প্রদীপ জালিয়ে মেয়োরা নাচতে থাকে। আর একটার পর একটা গান গাইতে থাকে ও সকলে মিলে গানের তালে তালে নাচতে থাকে-
কারাম গসাই কারাম গসাই
জোস যশশারাইল
আর ভাদর মাসে আনব নেহি আর।
অর্থাৎ
কারাম গাছ কারাম গাছ
শ্বশুর বাড়ী যাই
ভাদর মাস ছাড়া আসবনা তো আর।
সারারাত নাচগান আনন্দ উৎসবে যেমন মেতে থাকে, তেমনি বাড়ি বাড়ি তাল পিঠা, তেল পিঠা, চালের রুটি, রান্না করা মাংস ও হাড়িয়া বা চুয়ানি (মদ) একে অপরকে খাওয়ানোর পর্বও চলতে থাকে। আনন্দের যেন কমটি নেই কারও।
পরের দিন খুব সকাল থেকেই গানের তালে তালে দল বেঁধে কারাম গাছের চারিদিকে নাচতে থাকে। সাধারণত এই পূজার সময় বৃষ্টি হয়। এবারে বৃষ্টি না হলেও গানে গানে বৃষ্টির কথা বলে পূজার আখড়াতে পানি ঢেলে কাদা করে দিয়ে একে অপরকে কাদা মাটি মাখায় ও আনন্দ করে। তারপর আখড়া থেকে কারাম গাছ ও ডালি তুলে নেয় ও ধুপ হাতে ঢোল মাদল বাজিয়ে নাচতে নাচতে ও গাইতে গাইতে কারাম গাছ ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য অগ্রসর হয় ও জলাশয়ে কারাম গাছের ডাল ভাসানোর মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় কারাম পূজা। কিন্তু শেষ হয়েও শেষ হয় না ঢোল মাদল ও গানের সুর —দুর থেকে দুরে আরও দূরে — বাতাসে মিশে বেড়াই ‘কারাম গসাই কারাম গসাই’ !
লেখাটি ২০১১ সালের। লেখক সুমনা চিসিম ২০১১ সালের ৯ -১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ‘কারাম গসাই’ উৎসবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
আরো লেখা…
প্রকৃতির উপহার ও প্রাকৃতিক সুস্থ থাকা । শেষ পর্ব।। সুমনা চিসিম
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত
-
রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর উৎসব ওয়ানগালা
: রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও...
-
আজ লেখক ও চিন্তক আলবার্ট মানকিন-এর স্মরণসভা ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান
: মধুপুর গড়াঞ্চলের আদিবাসী নেতা, চিন্তাবিদ, লেখক, সমাজকর্মী, এনজিও কর্মী আলবাট...
-
গুলশান বনানী ওয়ানগালা ২১ অক্টোবর শনিবার
: গুলশান বনানী ওয়ানগালা ২১ অক্টোবর শনিবার আদি সাংসারেক গারো জাতিগোষ্ঠীর...
-
১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ...
-
রে রে : হায়রে আমার কাঞ্জিয়া ।। নীলু রুরাম
: সমর সাংমার রেরে নিয়েই শুরু করি তবে একটু আলাদা। আমাদের...
-
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিরাপদ ব্যবহার ।। জাডিল মৃ
: এক. সময় স্রোতের সাথে আবাহমান ছুটে চলা প্রযুক্তির উন্নতি, মানব...
‘রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর উৎসব ওয়ানগালা’
: রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও......বিস্তারিত
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত