চারদিকে ইটের দেয়াল, সীমানা প্রাচীর। দুই বর্ষীয়ান রেইন ট্রি মুখোমুখি দুই প্রান্তে আজ যদিও ওরা নেই। নেই সারি সারি মেহগনি গাছ। তবে এখনো রয়ে গেছে একই কম্পাউন্ডের ভিতর সেন্ট এন্ড্রোজ উচ্চ বিদ্যালয়, সেন্ট মেরিজ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, দুই স্কুলের মাঝখানে সবুজ ঘাস বিছানো মাঠ, সেন্ট এন্ড্রোজ প্রাথমিক বিদ্যালয়, বড় পুকুর আর তার দুই পাশে সান বাঁধানো ঘাট। বলছিলাম আমার শৈশব, কৈশর এবং তারুণ্যের স্মৃতি সেন্ট এন্ড্রোজ মিশনের কথা। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে খ্রিস্টান এংলিকান সম্প্রদায়ের একদল ফ্রান্সিসকান বাঙালি সন্ন্যাসীদের দ্বারা মান্দি অঞ্চলে গড়ে উঠা সেন্ট এন্ড্রোজ মিশন। যাঁরা জীবদ্দশায় কোন বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ করেননি এবং সুদূর বরিশালে নিজেদের পরিজন ত্যাগ করে এসে ব্রতীয় জীবনের সম্পূর্ণ নিঃস্ব, বশ্যতা ও শুচিতার জীবনে আমরণ বিশ্বস্তভাবে উৎসর্গীকৃত থেকেছেন। ভাষায়, চলনে-বলনে, আচারে বাঙালিয়ানা ভুলে একেকজন হয়ে উঠেছিলেন মান্দি সত্তা (গারো)।
বলতে ভুলে গেছি স্কটল্যান্ডের কোন এক সেন্ট এন্ড্রোজ নামক গির্জার আদলে তৈরি লাল ছাদঅলা গির্জাসহ সেন্ট মেরিজ সন্ন্যাসিনীদের সংঘ, সেন্ট মেরিজ ছাত্রীবাসের কথাও। সন্ন্যাসিনীরা গুটিকয়েক উত্তরসূরীক্রমে রয়ে গেলেও উত্তরসূরীর অভাবে সন্ন্যাসীরা আর নেই। নেই তাদের সন্ন্যাস প্রতিষ্ঠান সেন্ট এন্ড্রোজ ভ্রাতৃসংঘ। তবে রয়ে গেছে তাদের গড়া আরেক প্রতিষ্ঠান সেন্ট এন্ড্রোজ বয়েজ হোস্টেল আমি একসময় যে ডরমিটরির ছাত্র ছিলাম।
এই ডরমিটরির কথা বললাম এজন্যে যে আমার মনে পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকাকালীন আমি হোস্টেল লাইব্রেরি থেকে প্রথম যে কয়টি বই পড়েছিলাম তার মধ্যে একটি হল বিশিষ্ট কলামিস্ট এবং আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং-এর ‘আদিবাসী মেয়ে’ বইটির কথা (বইয়ের শিরোনামের ক্ষেত্রে ভুল হতেও পারে)। বইটা একদিনেই পড়ে শেষ করেছিলাম।
অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলব ভীষণ ভালোলাগা কাজ করছিল সেদিন। বাংলাদেশে বৈচিত্রময় অনেক জাতিসত্তার কথা জানতে পেরেছিলাম। যাদের কথা জানতাম না তেমন নতুন নতুন জাতির কথা জানতেও পারলাম। খাসিয়া, বোম, হাজং, কোচ, ডালু, সাঁওতাল, ত্রিপুরা কিংবা চাকমা, মারমা তাদের কথা জানতাম। আমার বড় বোনের সাথে নার্সিং ট্রেনিং নিয়েছিলেন খাসিয়া জাতিসত্তার এক দিদি। খুবই উচ্ছল, প্রাণবন্ত ছিলেন তিনি। ছিলেন বোম জাতিসত্তার এক দিদিও। আরেকজন যিনি ছিলেন হাজং জাতিসত্তা থেকে তিনি অবশ্য এখন আমারই বৌদি। কিন্তু আদিবাসী মেয়ে বইটি পড়ে জানতে পেরেছিলাম খেয়াং, খুমি, রাখাইনসহ আরও বেশ কিছু জাতিসত্তার কথা যারা আমার জন্য নতুন ছিল।
বিশেষভাবে খেয়াং জাতিসত্তার কথা আমাকে সেদিন প্রবলভাবে টেনেছিল। আর সৌভাগ্যবশত কলেজ জীবনে এক খেয়াং মেয়ের সাথে পরিচিত হই। আন্তরিক, মিশুকে, কর্মঠ, মেধাবী এবং সুন্দর নেতৃত্ব দক্ষতাসম্পন্ন। একটি টিম পরিচালনা করছিল সে। তাকে যখন খুব কাছে থেকে দেখেছি সেই সময়গুলোতে ‘আদিবাসী মেয়ে’ বইয়ের খেয়াং অধ্যায়টা খুব করে মনে পড়ছিল। কতোটা আত্মপ্রত্যয়ী, সংগ্রামী, এবং কষ্টসহিষ্ণু হলে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল পাড়ি দিয়ে পদে পদে বাধা বিপদ ডিঙিয়ে এতোদূর সমতলে স্বপ্ন পূরণে আসতে পারে। অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের বঞ্চনা, নির্যাতনের ইতিহাসের এক জ্বলন্ত অধ্যায় হয়েও কোন প্রকার মালিন্য তাকে স্পর্শ করেনি। হাসিখুশী, চটপটে খেয়াং বন্ধু সেদিন বলছিল তাদের গ্রামটা উঁচু পাহাড়ে। অনেকগুলো পাহাড় ডিঙিয়ে তারপর তাদের সেই পাহাড়। পাহাড় পেরোতে পেরোতেই প্রায় যেন একদিনের পথ। অথচ সেই পাহাড় থেকেই অনেক কষ্ট করে অনেক দূরে পাহাড়ের ঢালে এসে ঝিরি থেকে তাদের পানি সংগ্রহ করতে হয়। এক রুঢ় কঠিন জীবন সংগ্রাম তবু এতটুকুতে ওরা কেউ দমে না।
‘আদিবাসী মেয়ে’ বইটির পাশাপাশি একই লেখকের আরো একটি বই পড়ার সুযোগ হয় পরবর্তীতে। বইটির নাম ‘দেশহীন মানুষের কথা’। এ দুটি বই-ই আদিবাসী জাতিসত্তাসমূহের সাথে শুধু পরিচয়ই ঘটায়নি হাতেখড়িও দিয়েছিল সহজ ভাষায় তাদের জীবন-জীবিকা, শোষণ-বঞ্চনার জীবনে প্রতিনিয়ত লড়াই করে বেঁচে থাকার সকরুণ গল্পে। অবহেলিত জীবনে নেমে আসা কালো ছায়া; অন্যায়-অবিচারে জর্জরিত জীবন যাদের দুঃখ দেখার কেউ নেই, কান্না শোনার মতো কেউ নেই। নিজ দেশে যারা হয় বাস্তুচ্যুত, ভূমিহারা কিংবা দেশান্তরী। বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির করাল থাবায় যাদের বরণ করে নিতে হয় অসহায়ত্বের এক নির্মম পরিণতি।
এবার মূল কথায় আসি। বর্তমান প্রজন্ম কি এ দুটো বইয়ের সাথে পরিচিত? যাদের হাতে হাতে স্মার্ট ফোন, গেমসের নেশায় যারা বুঁদ তারা কি নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন? ভার্সিটি পড়ুয়া অধিকাংশ মান্দি ছেলেমেয়ে কি বই দুটো নেড়েচেড়ে দেখেছে কখনো নাকি অনেকের গ্রন্থদ্বয়ের নামই শুনেনি এমন অবস্থা? যেসব হাই ফ্যাশনেবল মান্দি মেয়েরা কালাচাঁদপুরের রাস্তায় মান্দি ছেলের হাত ধরে হাঁটতে জানে না, কালো হোক কি ধলা, সুস্থ কি অসুস্থ, চাই বৃহৎ নৃগোষ্ঠীর কোন ছেলের হাত ধরা, এভাবে এক সময় নীল জগতে পদার্পণ, নিজেকে নিগৃহীত করে যারা অপরে সুখ খুঁজে তারা যদি একবারের জন্যে হলেও বইদুটোর সন্ধান পেত তবে কি সেই নীল পাহাড়ে, প্রপাত-ঝর্ণায়, অরণ্যের গন্ধে খুঁজে পেত তার অস্তিত্বের ঘ্রাণ? তার গর্ভধারিণী মায়ের ঘ্রাণ, যিনি এক পরম মমতায় শোভাময় আঁচলে আগলে রাখেন আমাদের? জানি না। সদুত্তর হয়তো আমার কাছেও নেই।
কথাগুলোর অবতারণা করলাম যেসব মান্দি ছেলেমেয়ে আদিবাসী এবং নিজ জাতিসত্তা ও অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন ও সমাধান খুঁজেন, আত্মপরিচয়ের পথদিশা হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে বেড়ান, স্লোগানে-মিছিলে, ফেস্টুন-প্ল্যাকার্ডে প্রকম্পিত পথে হেঁটে যান অথচ অধিকাংশই হয়তো অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ে, ভালোবাসাকে না জেনেই যেমন ভালোবাসি বলা, তাদের অনেকের জন্যই বইদুটো হতে পারে প্রাথমিক ভিত্তি। আমি তা বলছি অন্তত আমার জন্য বইদুটো তাই-ই হয়েছে। এটাই আমার অভিমত। তবে নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিতেই হবে বইদুটো আমাদের অব্যক্ত বেদনার কথা বলে। অনেক না বলা কথা যা আমরা বলতে পারি না সেইসব পাথর ভেঙে জলস্রোত নির্গত হবে নিশ্চয়।
তবে এখন একথা শুনে যাদের ব্যক্তি সঞ্জীবের প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব তারা ক্ষেপেও গেলেও ক্ষেপে যেতে পারে। শেষতক এ কথাই বলব ব্যক্তির প্রতি রাগ, ক্ষোভ থাকতেই পারে তবে তার অনবদ্য উত্তম সৃষ্টির প্রতি সেই এক মনোভাব পোষণ করা হবে অসমীচীন। ব্যক্তির প্রতি অসন্তোষ জ্ঞাপন করা যায় কিন্তু তার হিতকর সৃষ্টিকে অস্বীকার করা যায় না।
কথাগুলো বললাম কারোর পক্ষে ওকালতি করে নয় কিংবা অন্ধভক্তি থেকেও নয়।
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত
-
রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর উৎসব ওয়ানগালা
: রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও...
-
আজ লেখক ও চিন্তক আলবার্ট মানকিন-এর স্মরণসভা ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান
: মধুপুর গড়াঞ্চলের আদিবাসী নেতা, চিন্তাবিদ, লেখক, সমাজকর্মী, এনজিও কর্মী আলবাট...
-
গুলশান বনানী ওয়ানগালা ২১ অক্টোবর শনিবার
: গুলশান বনানী ওয়ানগালা ২১ অক্টোবর শনিবার আদি সাংসারেক গারো জাতিগোষ্ঠীর...
-
১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ...
-
রে রে : হায়রে আমার কাঞ্জিয়া ।। নীলু রুরাম
: সমর সাংমার রেরে নিয়েই শুরু করি তবে একটু আলাদা। আমাদের...
-
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিরাপদ ব্যবহার ।। জাডিল মৃ
: এক. সময় স্রোতের সাথে আবাহমান ছুটে চলা প্রযুক্তির উন্নতি, মানব...
‘রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর উৎসব ওয়ানগালা’
: রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও......বিস্তারিত
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত