পূর্ব প্রকাশের পর…
গারোদের বিশ্বাস মতে, আদি নর ও নারীর সৃষ্টির স্থান,“আ۰মিতং আ۰সিলজং”। কিন্তু এই স্থানটি কোথায় তাহা কেউ বলিতে পারে না। গারোরা বলিয়া থাকে তাহারা এই উপমহাদেশে তিব্বত (কোট, বোড) হইতে আসিয়াছে। কিন্তু তিব্বতে বসবাস করিবার পূর্বে তাহারা কোথায় ছিলো? পণ্ডিতেরা মনে করেন, ‘চীন দেশের লোকেরাও প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে মধ্য-এশিয়া হইতে আসিয়াছে। তাহার পরেও বিভিন্ন সময়ে বিশাল চীন দেশে মধ্য হইতে বিভিন্ন সময়ে তুরানি, তার্তারি, সিদিয় (শক বা সিবিয়ান) প্রভৃতি অনেক জাতি আসিয়াছে। গারোরাও কোন না কোন সময়ে চীন দেশে আসিয়া থাকিবে। অনেকে মনে করেন, গারোরা তিব্বত আসিবার আগে পশ্চিম চীনের হোয়াংহো ও ইয়াংসিকিয়াং নদীদ্বয়ের উৎসমুখের উপত্যকাগুলিতে বসবাস করিত।
সেইসব স্থান হইতে গারোরা ধীরে ধীরে বিভিন্ন কারণে তিব্বতে চলিয়া আসে। তখন হয়ত তাহারা গারো নামে পরিচিত ছিলো না, অন্য কোন নামে পরিচিত ছিলো। কিন্তু গারোরা যে বৃহৎ মঙ্গোলীয় জাতি-গোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত ছিলো ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। অনেক জাতি, জাতির সমন্বয়েই মঙ্গোলীয় জাতিগোষ্ঠির সৃষ্টি। সমস্ত মধ্য এশিয়া, উত্তর-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব-দক্ষিণ এশিয়া মঙ্গোলীয়দের বাসস্থান।
এই বৃহৎ মঙ্গোলীয় জাতিগোষ্ঠিকে প্রধানত দুইটি ভাগে ভাগ করিয়া বুঝাইত- Golden Horde I White Horde পশ্চিমাংশের মঙ্গোলীয়রা White Horde এর অন্তর্ভুক্ত এবং পূবাংশের মঙ্গোলীয়রা White Horde -এর অন্তর্ভুক্ত পণ্ডিতেরা মনে করেন, গারোরা তিব্বত-চীন পরিবারের লোক। তাহা হইলে গারো White Horde এর অন্তর্ভুক্ত। তিব্বতে বসবাসকারী হিসাবে ভোট জাতি বা বোডো জাতি। ড: গ্রিয়ারসনের ভাষা জরিপ অনুসারে টিবেটো বার্মাণ ভাষা-গোষ্ঠির লোক। এই বোডো জাতির লোকদেরকেই বৈদিক সাহিত্যের রামায়ণ ও মহাভারত সহাকাব্যে ‘কিয়াত’ জাতি বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। মি.আর. এম. নাম তাঁহার The Background of Assamese Culture পুস্তকের পনের পৃষ্ঠায় লিখিয়াছেন-‘The word ‘kirat’ therefore , is a general term refer ring to the people of the Mongolian origin and it refer specially to the Bodos.’
কৃত্তিবাস রচিত রামায়ণের কিস্কিন্ধ্যাকারে সীতার অস্বেষণে সুগ্রীব কর্তৃক পূবদিকে সেনাপতি বিনোদেব নেতৃত্বে বানর সৈন্য প্রেরণকালে তাহাদের বলা হইয়াছে-
“ব্রহ্মর পর্বতে বঙ্গে করিহ প্রবেশ।
মন্দর পর্বতে যাও কিরাতের দেশ।।
যাইবে কর্ণাট দেশে আর শাকদ্বীপে
জানিবে কিরাট আছে অত্যদ্ভুত রূপে।।
কনক চাঁপার মত শরীরের বর্ম
উঠান খানার মত ধরে দুই কর্ণ।।
থালা হেন মুখখান তাম্র বর্ণ কেশ।
এক পায়ে চলে পথ বিক্রমে বিশেষ।।
জলের ভিতরে বৈসে মৎস্যবৎ মুখ।
মানুষ ধরিয়া খায় আইসে সম্মুখ।।
বলিয়া মনুষ্য ব্যাঘ্র তাহাদের খ্যাতি।
আতপর সহিতে নারে কিরাতের জাতি।।
সীতা লয়ে থাকে যদি কিরাতের ঘরে।
যত্ন করি চাহিও তথায় লঙ্কেশ্বরে।।”
কৃত্তিবাস বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে এই রামায়ণ মহাকাব্য বাংলায় লিখেন। মহামুনি বাল্মীকির সংস্কৃত ভাষায় লেখা মূল রামায়ন মাহাকাব্যের সঙ্গে ইহার মিল আছে কিনা জানি না। এই উদ্ধৃতিতে ব্রহ্মপুত্র নদ পার হইলে মন্দর পর্বত পাওয়া যাইবে বলা হইয়াছে। এই মন্দর পর্বতই গারো পাহাড়। গারো পাহাড় একটি পাহাড় নয়, পাহাড়ের শ্রেণি। এই পাহাড়ে অনেক আলাদা আলাদা পাহাড় আছে।
তাহাদের নামও আলাদা আলাদা। এই “মন্দর পর্বত”. গারো পাহাড়ের “মংরে আ۰ব্রি”-মংরে পাহাড়। ইহা চিৎমাং পাহাড়ের পশ্চিমে অবস্থিত এবং বর্তমানেও এই পাহাড় ‘মংয়ে আ۰বি নামেই পরিচিত।
চলবে…
কভার ছবি : গারো নারী (সাবিত্রী চিরান) আদুরি বাজাচ্ছে। সংগৃহীত
লেখক পরিচিতি
গারো সম্প্রদায়ের জ্ঞানতাপস, পণ্ডিতজন রেভা. মণীন্দ্রনাথ মারাক জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। বর্তমনে তিনি দুর্গাপুর থানা ধীন নিজ বাড়ি বিরিশিরির পশ্চিম উৎরাইল গ্রামে বসবাস করছেন। দুই ছেলে এক মেয়ে। স্ত্রী প্রতিভা দারিংও একজন শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে অবসরে আছেন। রেভা. মণীন্দ্রনাথ মারাকের অনেক লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। উনার গারো সংস্কৃতি এবং বিরিশিরি মিশিন এবং ব্যাপ্টিস্ট মণ্ডলীর ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বই।

লেখক মণীন্দ্রনাথ মারাক
আরো লেখা
সংস্কৃতি সংরক্ষণে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জানার প্রয়োজনীয়তা ।। পর্ব-১ ।। মণীন্দ্রনাথ মারাক
সংস্কৃতি সংরক্ষণে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জানার প্রয়োজনীয়তা ।। পর্ব-২ ।। মণীন্দ্রনাথ মারাক
গারো অঞ্চলে খ্রিষ্ট ধর্মের আগমন ।। শেষ পর্ব ।। মণীন্দ্রনাথ মারাক
গারো জাতিসত্তার উজ্জ্বল নক্ষত্র রেভা. মণীন্দ্রনাথ মারাক ।। নীলু রুরাম
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত
-
রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর উৎসব ওয়ানগালা
: রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও...
-
আজ লেখক ও চিন্তক আলবার্ট মানকিন-এর স্মরণসভা ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান
: মধুপুর গড়াঞ্চলের আদিবাসী নেতা, চিন্তাবিদ, লেখক, সমাজকর্মী, এনজিও কর্মী আলবাট...
-
গুলশান বনানী ওয়ানগালা ২১ অক্টোবর শনিবার
: গুলশান বনানী ওয়ানগালা ২১ অক্টোবর শনিবার আদি সাংসারেক গারো জাতিগোষ্ঠীর...
-
১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ...
-
রে রে : হায়রে আমার কাঞ্জিয়া ।। নীলু রুরাম
: সমর সাংমার রেরে নিয়েই শুরু করি তবে একটু আলাদা। আমাদের...
-
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিরাপদ ব্যবহার ।। জাডিল মৃ
: এক. সময় স্রোতের সাথে আবাহমান ছুটে চলা প্রযুক্তির উন্নতি, মানব...
‘রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর উৎসব ওয়ানগালা’
: রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও......বিস্তারিত
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত