পূর্ব প্রকাশের পর
এ-এক নতুন পরিবেশ চারদিকে পাহাড়। কাছেই ঘন বন। এখানে জনবসতি নেই। তারা কল্পনা করতে পারবে না যে এতদূর এসে তারা বসতি স্থাপন করছে। সেরেনজিং ওয়ালজাম। কয়েকদিন বনের ফলমূল খেয়ে ওদের কেটেছে। ওয়ালজচান প্রশ্ন তোলেছে সেরেনজিংকে-উদ্ধার করেছি বটে কিন্তু তুমি এখন পরস্ত্রী। সেরেনজিং প্রতিবাদ করে, খামালের মন্ত্রপাঠ আমি মানি না। বিশ্বাস করো এ বিয়ে বিয়ে নয়। ওরা জোর করে আমাকে বিয়ে দিয়েছে।
-তুমি,যে তার ঘর করেছো।
-ওরা আমাকে জোর করে থোরার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তোমার গা ছুঁয়ে বলছি আমি সতী।
-তার প্রমাণ?
– আমি মরে গেলে তুমি সুখী হবে?
ওয়ালজাম হঠাৎ করে এর অর্থ বুঝে উঠতে পারেনি। সেরেনজিং ভিজা কণ্ঠে বলে যায় পরীক্ষা করে দেখবে এইতো? আমি প্রস্তুত। ওয়ালজান দিশেহারা হয়ে যায়। পরীক্ষা! কী পরীক্ষা দেবে সেরনজিংকে? ছলো ছলো নয়নে সেরেনজিং বলে।
-সালজং দেবতার নামে দোহাই দিয়ে আর লাভ নেই। আমি আসল পরীক্ষাতেই যাবো বলে ওয়ালজানের দিকে কাতর নয়নে চেয়ে রইলো। সেরেনজিং। ওয়ালজান ধীরে বললো সে কেমন?
-অগ্নি পরীক্ষা! আমি আগুনে ঝাঁপ দেবো।
বলে রাখা ভাল- গারো সমাজে নারীদের সতীত্ব পরীক্ষা কিংবা অন্যকোনো কঠোর বিচারের রায় প্রকাশ করার জন্য দোষী ব্যক্তিকে আগুন কিংবা পানিতে পরীক্ষা করানোর প্রথা রয়েছে। আগুনে পুড়ে সততা পরীক্ষা করানোর প্রথা রয়েছে এই প্রথাকে গারো ভাষায় “ওয়ালও শোওয়া” আর পানিতে ডুবিয়ে সততা পরীক্ষাকে ‘চি রিপ্পা’ বলে। উক্ত অগ্নি পরীক্ষার কথা শুনে ওয়ালজামের বুক কেপে উঠলো। তবু সেরেনজিংয়ের ধীর কণ্ঠে প্রস্তুাব শেষ পর্যন্ত বাতিল করা গেল না। গাছের ডাল পালা দিয়ে গানচি বা চিতা তৈরি হল নির্জন বনে। কাঠ ঘষে ঘষে অগ্নি সংযোগ করা হল তাতে। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল অগ্নিশিখা। সেরেনজিং কান্নায় ভেঙে পড়ে। ততক্ষনে ওয়ালজান ও সেরনজিং কেঁদে কেঁদে বলে।
“দুকখো চাককে জাংগিবনজক সুক অংজাজক আ-সাকোও
খাদিং আনসেংয়ি দংবো রি.পেং আং সি.জকো”।
বাংলা
দুঃখে দুঃখে জীবন গেল সুখ হইল না কপালে
বন্ধু তুমি সুখে থেকো অভাগিনী মরিলে।”
কেঁদে কেঁদে একবার ওয়ালজাম ও আরেকবার জলন্ত চিতার দিকে চেয়ে সেরেনজিং ওয়ালজামের বুকে ঢলে পড়ে। একটু পড়েই বিস্ফারিত অশ্রু নয়নে গেয়ে ওঠে-
“সাক্ষী দংআ সাল জাজং হারংঙ্গা-বুরুং চিদারী
রংথালগিপা সেরেনজিং সিগ্নক ওয়ালো খাম্মারী।
বাংলা
সাক্ষী রইল চন্দ্র সূর্য পাহাড়-জঙ্গল এই নদী
আগুনে পুইড়া মরলাম আমি সেরনজিং সতী”।
অগ্নি চক্রের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় সেরেনজিং তাতে ঝাঁপ দেবে এমন সময় ওয়ালজান তাকে জড়িয়ে ধরে। ক্লান্ত সেরেনজিং ঢলে পড়ে মাটিতে। ওয়ালজান তাকে সুস্থ্য করে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে। কোটের পকেট থেকে একজোড়া ইয়ারিং বা কানের দুল ও আংগুলের একটি আংটি বের করে বলে-
-এ গুলো আমার মায়ের। এ স্মৃতিটুকুই রয়েছে কেবল। এর চেয়ে প্রিয় আমার কাছে আর কিছুই নেই। ওয়ালজান সেরেনজিংয়ের হাতের একটি আঙ্গুল বুকের কাছে টেনে ধরে বলে-
“জাকসিওনা জাকসিদেম নাচিলওনা ইয়ারিং
চাসংগিসিক রা.নাদে গানবো মিচিক সেরেনজিং।”
বাংলা
“আঙুলে এই আংিটি দিলাম কনে দিলাম ইয়ারিং
যুগে যুগে মনে রেখো তুমি প্রিয় সেরেনজিং।”
সেরেনজিং ওয়ালজানের বুকে মাথা লুকায়। পর ওয়ালজানের পায়ের ধূলো নিয়ে কপালে ঘষে বলে-
“জাকসিওনা জাকসিদেম নাচিলওনা ইয়ারিং
চাসং গিসিক রানাজক গান-গ্নক মিচিক সেরেনজিং”।
বাংলা
তোমার দেয়া আংটি আর কানের ইয়ারিং পরে
মনে রাখবো বন্ধু তোমায় সারাজনম ভরে।”
“সেরেনজিং পালা” সম্পর্কে আমার যতটুকু জানা তা দিয়েই এ সংক্ষিপ্ত কাহিনি তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। এই পালা বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সংযোজন বিয়োজন করে গাওয়া হচ্ছে। তবে যে ভাবেই হোক এ সেরেনজিং পালায় গারোদের কৃষ্টি সংস্কৃতির অনেক কিছুই যোগ হয়েছে।
এ পালাটি গারোদের ইতিহাস ঐতিহ্য ধারণ ও বহন করে রাখুক- আমি এ কামনা করছি। শেষে ঋণ স্বীকার করছি তৎকালীন সহকারী পরিচালক (উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি, বিরিশিরি জনাব, মো. আবদুর রশিদ মিয়ার কাছে। তিনি ‘জানিরা ’ তয় সংখ্যা ১৯৮১ সালে ১ম এ জাতীয় গবেষণা ধর্মী লেখা প্রকাশ করেছিলেন। তার লেখা আমি কিছুটা অনুসরণ করেছি। তার গানের অনুবাদগুলো সম্পূর্ণই বদলিয়ে দিয়েছি। কারণ অনেকটাই অসামঞ্জস্য বলে আমার মনে হয়েছে।
।। সমাপ্ত
লেখক পরিচিতি
মতেন্দ্র মানখিন গারো সম্প্রদায়ের একজন বিশিষ্ট কবি, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক। কবির প্রায় ৯টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

কবি মতেন্দ্র মানখিন ।। ছবি থকবিরিম
আরো লেখা
পালাগান সেরেজিং ।। পর্ব-৪ ।।মতেন্দ্র মানখিন
পালাগান সেরেজিং ।। পর্ব-৫।।মতেন্দ্র মানখিন
পালাগান সেরেজিং ।। পর্ব-৬।।মতেন্দ্র মানখিন
পালাগান ‘সেরেজিং’ ।। পর্ব-৭ ।।মতেন্দ্র মানখিন
উত্তরে লক ডাউন দক্ষিণে লাশের গন্ধ ।। মতেন্দ্র মানখিন
চু ।। গারো সম্প্রদায়ের প্রধান পানীয় ।। মতেন্দ্র মানখিন
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত
-
১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ...
-
রে রে : হায়রে আমার কাঞ্জিয়া ।। নীলু রুরাম
: সমর সাংমার রেরে নিয়েই শুরু করি তবে একটু আলাদা। আমাদের...
-
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিরাপদ ব্যবহার ।। জাডিল মৃ
: এক. সময় স্রোতের সাথে আবাহমান ছুটে চলা প্রযুক্তির উন্নতি, মানব...
-
বর্তমান সময়ের তুমুল জনপ্রিয় শিল্পী দিশন অন্তু রিছিলের জন্মদিন আজ
: বর্তমান সময়ের তুমুল জনপ্রিয় শিল্পী দিশন অন্তু রিছিলের জন্মদিন আজ।...
-
বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবতোষ যেত্রা আর নেই
: হালুয়াঘাট উপজেলার ৪নং সদর ইউনিয়নের কালিয়ানীকান্দা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা পাস্টার...
-
কেনিয়ার কৃষকরা হাতি তাড়াচ্ছে মৌমাছি দিয়ে
: কেনিয়ায় হাতির তাণ্ডব থেকে ফসল রক্ষায় ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে কৃষকরা।...
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত