Thokbirim | logo

২৫শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | ১০ই ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

কোভিড-১৯ ও আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ।। সোহেল হাজং

প্রকাশিত : আগস্ট ০৯, ২০২০, ১১:২৯

কোভিড-১৯ ও আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ।। সোহেল হাজং

আজ ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। সারা বিশ্বে এই দিবসকে কেন্দ্র করে নানা অনুষ্ঠান ও সভাসেমিনার হয়ে থাকে। কিন্তু  অন্যান্য বছরের মতো এই বছর কোভিড-১৯-এর মহামারির কারণে প্রত্যক্ষ উপস্থিত থেকে সভাসমাবেশ কিংবা র‌্যালি করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে দিনব্যাপী ভার্চুয়াল নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা সংগঠন স্বাস্থ্যবিধি মেনে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন করছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাও এই দিনে বিশেষ লেখা প্রকাশ করে থাকে। থকবিরিমও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে থকবিরিম শুরু থেকেই আদিবাসীদের জীবন জীবিকা, তাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে নিয়মিত লেখা প্রকাশ করে আসছে। শুধু আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস কিংবা যেকোনো দিবসকে কেন্দ্র করে নয় থকবিরিম সব সময় সকল জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য-ভাষাকে সম্মান করে আসছে।  আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস সফল হোক সুন্দর হোক। থকবিরিম পাঠকদের জানাই আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের শুভেচ্ছা। আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসকে কেন্দ্র করে থাকছে বিশেষ লেখা। আজ প্রকাশ হলো হাজং সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট লেখক সোহেল হাজংয়ের  লেখা- সম্পাদক।

আজ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। জাতিসংঘ ঘোষিত এ দিবসটি এবার সব জায়গায় অন্যরকমভাবে পালিত হচ্ছে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে।

বৈশ্বিক এ মহামারি অবস্থার সাথে মিল রেখে জাতিসংঘ আজকের এ দিনটির মূল থীম নির্ধারণ করেছে “কোভিড-১৯ ও ইন্ডিজেনাস পিপলস রিজিলিয়েন্স”।  জাতিসংঘের মহাসচিব এন্তোরিও গুতেরাস দিবসটি উপলক্ষে এবারের বাণী দিয়েছেন ভিডিও বার্তার মাধ্যমে। তিনি বলেছেন, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্বের প্রায় ৪৭ কোটি আদিবাসীদের জীবনেও ক্ষতিকর প্রভাব বিরাজ করছে। আদিবাসীরা বিভিন্ন বৈষম্য ও আর্থ-সামাজিক দূরাবস্থার শিকার হচ্ছেন। এই সময়ে আদিবাসীরা এই মহামারি কিভাবে মোকাবেলা করছেন সেটাও  উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন,  থাইল্যান্ড-এর “কারেন” আদিবাসীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী লকডাউন প্রথা “ক্রো-ঈ” (গ্রামবন্ধ) প্রবর্তন করে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবকে মোকাবেলা করছেন। তিনি বলেছেন, জাতিসংঘ আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বদ্ধ পরিকর। তিনি এ মহামারি থেকে আদিবাসীদের সুরক্ষা ও তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্রের সকল প্রক্রিয়ার সাথে আদিবাসীদের যুক্ত করার আহবান জানিয়েছেন।

আজকের এই দিবসটি পালনে হয়তো আদিবাসীদের সেই বৈচিত্র্যপূর্ণ আয়োজন লক্ষ করা যাবে না। কারণ কোভিড-১৯ মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারাকে ব্যাহত করে  দিয়েছে। তাই বেশিরভাগ আয়োজন হচ্ছে ভার্চুয়াল মাধ্যমে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম জাতিসংঘের দেওয়া থিমের সাথে সংগতি রেখে দিবসটির থিম নির্ধারণ করেছে “কোভিড-১৯ মহামারিতে আদিবাসীদের জীবন-জীবিকার সংগ্রাম”।

স্বাভাবিক অবস্থায় যেমন প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নানা বৈষম্য, অবহেলা ও প্রান্তিকতার শিকার হয়। এরকম বৈশ্বিক মহামারিতেও তাদের ক্ষতির পরিমাণ যে বেশি, সেটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। সারাবিশ্বে এই মহামারি সময়ে আদিবাসীদের নানারকম পরিস্থিতি সম্মুখীনের খবর আমরা পাচ্ছি।  আদিবাসীরাও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছে আবার অনেকে এই ভাইরাস প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। তবে, এসব প্রান্তিক মানুষদের কাছে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার চেয়ে অন্যান্য সংকটগুলো চরম আকার ধারণ করছে। তার মধ্যে রয়েছে- চরম খাদ্য সংকট, কর্মহীন হয়ে পড়া, বর্ণ বৈষম্যের শিকার, মিলিটারাইজেশন, নারীর প্রতি সহিসংতা, ভূমি দখল, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা গ্রহণে পেছনে থাকা ইত্যাদি।

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের এই সময়ে চাকরির জন্য আমি থাইল্যান্ডে অবস্থান করছি। দিবসটি পালন উপলক্ষে আমাদের প্রতিষ্ঠান-এশিয়া ইন্ডিজেনাস পিপলস প্যাক্ট (এআইপিপি) এবার ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে গত ৫-৭ আগস্ট এই ৩ দিনে। সবগুলোই অনলাইন আলোচনা।  এসব টেকনিক্যাল পদ্ধতিতে অংশগ্রহণে আদিবাসীদের অভিজ্ঞতা কম থাকলেও আমি দেখেনি কোনো আলোচনায় কোনো দেশ থেকে নির্ধারিত অতিথি/আলোচক কেউ অংশ নিতে বাদ পড়েছেন। তার মানে, সারাবিশ্বের আদিবাসী নেতৃবৃন্দ এসময় তাদের অবস্থা ও অধিকারের কথা বলার জন্য খুবই সোচ্চার আছেন। তারা এসময় আদিবাসীদের জীবন সংগ্রামের কথা বলেছেন, দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে পড়ার কথা বলেছেন, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও অন্যান্য উদ্যোগের কথা বলেছেন, আদিবাসী নারী, প্রতিবন্ধী, যুব ও সার্বিক মানুষের মহামারি মোকাবেলার চরম অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন।  সেসাথে তাদের প্রতি অন্যায়,  অবহেলা, বঞ্চনা, মানবাধিকার লঙ্ঘণ ও অব্যবস্থাপনার কথাও ওঠে এসেছে।  এছাড়াও ভালো কিছু উদ্যোগের কথা আমরা জানতে পেরেছি। আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী প্রথা ও জ্ঞান  কাজে লাগিয়ে কিভাবে এ মহামারিকে আদিবাসীরা মোকাবেলা করছে সে গল্পও চলে এসেছে। তারা তাদের সহনশীলতা ও সক্ষমতার কথা বলেছেন। তারা বলছেন, এই মহামারি দেখিয়ে দিয়েছে, আদিবাসী সংস্কৃতি, প্রথা ও ব্যবস্থাপনা বিশ্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এ মহামারি তাদের আবারও সেই আগের সামাজিক ব্যবস্থাপনাতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। পাহাড় ও বননির্ভর মানুষকে প্রকৃতির প্রতি ভালবাসার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি পালনে উদ্বুদ্ধ করেছে।  এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে যে, জুমচাষ নির্ভর এ আদিবাসীরা নিজস্ব পদ্ধতিতে নিজের গ্রামে লকডাউন সিস্টেম চালু রেখে এখনও করোনা ভাইরাস হতে নিরাপদে আছেন।

থাইল্যান্ডে আদিবাসী দিবস উদযাপন

পৃথিবীর অন্যতম পর্যটনকেন্দ্রিক দেশ থাইল্যান্ড-কে শুরুরদিকে কোভিড-১৯ এর সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশের সাথে তুলনা করা হলেও সে ঝুঁকি তারা কাটিয়ে ওঠতে সক্ষম হয়েছে।  এ মহামারি শুরু হওয়ার প্রায় ৩ মাস পূর্ব থেকে আমি এখানে। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস শনাক্তের একমাসের অধিক সময় আগে থেকে থাইল্যান্ডে কোভিড-১৯ সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়।  কিন্তু থাইল্যান্ড সরকারের কার্যকর ব্যবস্থাপনা, জনগণের সহায়তা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণে অসম্ভবভাবে এদেশ কোভিড-১৯ কে জয় করে চলেছে।  আমি গত ৩ মাসে এদেশে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ৫৮ এর ঘরকে টপকাতে দেখিনি।  সারাদেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৩ হাজারের কিছু ওপরে। মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা স্থবির রয়েছে। সেজন্য থাইল্যান্ডের মানুষ কিছুটা স্বস্তির মধ্যে রয়েছে লক্ষ করছি। সে তুলনায় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থা খুবই ভয়াবহ।

কোভিড-১৯ প্রার্দুভাবের এই যখন থাইল্যান্ডের অবস্থা তখন এখানেও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস।  থাইল্যান্ডের স্থানীয় সংগঠনগুলো সরাসরি ও ভার্চুয়াল দুইভাবেও আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসটি পালন করে চলেছে। “ইমপেক্ট” নামে এআইপিপির একটি পার্টনার প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে আমরা গতকাল থেকে দু’দিনব্যাপী আদিবাসী দিবসে অংশগ্রহণ করছি। অনুষ্ঠানে দেখলাম, দূর পাহাড় থেকে আদিবাসীরা তাদের জুম ফসল, পাহাড়ি ফলমূল, হাতের কাজের পণ্য/সামগ্রি নিয়ে নিজস্ব পোশাক পড়ে দলে দলে অনুষ্ঠানে যোগদান করেছেন। অংশকারীদের অধিকাংশই নারী যারা এসব কৃষিপণ্য উৎপাদনের সাথে সরাসরি জড়িত। কিছু স্টলে দেখলাম তারা পাহাড়ের সবজি ফ্রি-তে বিলি করছে। আলোচনার মাধ্যমে  তাদের অভিজ্ঞতা  বিনিময় করছে। যারা যোগ দিতে পারেননি তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনলাইনে অনুষ্ঠান উপভোগ করছেন। কিন্তু বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই হয়তো এভাবে সরাসরি অনুষ্ঠান আয়োজনের কোন সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, জাতীয় হাজং সংগঠনসহ  বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানগুলো হচ্ছে অনলাইনে। তবুও যেন আমরা সকলে কাছাকাছি থাকি আমাদের অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করি। কিভাবে এই মহামারিকে কাটিয়ে ওঠতে পারি সেটা নিয়ে যেন সকলের প্রচেষ্টায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হই। সকলকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের শুভেচ্ছা।

।। কভার প্রচ্ছদ তিতাস চাকমা

 

লেখক পরিচিতি :

সোহেল হাজং হাজং সম্প্রদায়ের একজন তরুণ লেখক, সংগঠক ও মানবাধিকারকর্মী। তাঁর আদিবাসী বিষয়ক দুটি প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হয়েছে। স্থায়ী নিবাস নালিতাবাড়ি থানা। বর্তমানে কর্মসূত্রে চিয়াংমাই, থাইল্যান্ড অবস্থান করছেন।

লেখক সোহেল হাজং

 




সম্পাদক : মিঠুন রাকসাম

উপদেষ্টা : মতেন্দ্র মানখিন, থিওফিল নকরেক

যোগাযোগ:  ১৯ মণিপুরিপাড়া, সংসদ এভিনিউ ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। 01787161281, 01575090829

thokbirim281@gmail.com

 

থকবিরিমে প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। Copyright 2020 © Thokbirim.com.

Design by Raytahost