Thokbirim | logo

২৫শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | ১০ই ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

উদ্যোক্তা হিসেবেও ভূমিকা রাখা শুধু সময়ের ব্যাপার ।। উদ্যোক্তা লাভলী ম্রং

প্রকাশিত : আগস্ট ০৭, ২০২০, ১৮:৪৫

উদ্যোক্তা হিসেবেও ভূমিকা রাখা শুধু সময়ের ব্যাপার ।। উদ্যোক্তা লাভলী ম্রং

লাভলী ম্রং নারী উদ্যোগক্তা হিসেবে কাজ করছেন ২০০৭ সাল থেকে। এই কাজে তাঁকে নানাবাঁধা অতিক্রম করে করতে হয়েছে। লাভলী ম্রং মুক্তাগাছা থানার মলাজানি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন। পিতা হরিশ হাউই, মাতা- রেনুকা ম্রং। এক ভাই, চার। বি.এ ডিগ্রি পাম করতে পারেননি। স্বামী লেখক ধীরেশ চিরান। চার ছেলে মেয়ে। বড় দুই ছেলে মেয়ে ডাক্তার, আর দুজন পড়ালেখা করছেন। বর্তমানে স্বামীর কর্মস্থলের সুবাদে প্রায় ৩৪ বছর ধরে ময়মনসিংহের ভাটিকাশরে অবস্থান করছেন। এখানেই তিনি ‘আসকি হ্যন্ডিক্রাপ্টস এন্ড টেইলারস’ নামে  দোকান দিয়েছেন। থকবিরিমের সাথে লাভলী ম্রং তার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প করেছেন। সেই গল্প পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো- সম্পাদক।

থকবিরিম :  কীভাবে শুরু ব্যবসার ?

লাভলী ম্রং : আমার ব্যবসা ২০০৭ খ্রিস্টাব্দ থেকেই মূলত শুরু। তবে তখন কোন মার্কেটে বা দোকানে নয়। নিজে সেলাইয়ের কাজ জানতাম তা দিয়ে বাসায় সেলাই মেশিন কিনে কিছু কিছু অর্ডারি সেলাই করতাম আশেপাশে মহিলাদের জামা কাপড়। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে মেয়েদের টপস ডিজাইন ও এমব্রোডারির কাজ অর্ডার নিতাম এবং হালুয়াঘাটে সাপ্লাই দিতাম। এই কাজের জন্য এলাকার ১০-১২ জন বাঙালি ও আদিবাসী মহিলাদের অর্ন্তভুক্ত করে কাজ করেছিলাম। এছাড়া বিভিন্ন জায়গা থেকে গারোদের ড্রেস বিশেষ করে দকবান্দা, দকশারি, ওড়না, খুটিপ, উত্তরীওসহ বিভিন্ন নাচের জিনিসপত্র ও ক্রাপ্টস সরবরাহ করা হত। এছাড়া চিট্টাগাং-এর চাকমা মারমাদের ড্রেস, জামালপুরের থ্রিপিস, বিছানার চাদর, নক্সিকাঁথা, কুশন কভার, পর্দা, বাহারী ধরনের মহিলাদের ব্যাগ ইত্যাদি সংগ্রহ করে বাসাতেই বিক্রয় করতাম। তখন থেকেই একটা দোকান নিয়ে ব্যবসা করার জন্য পরিকল্পনা করি এবং স্থান খোঁজতে থাকি। কিন্তু সুবিধে মত স্থান না পাওয়াতে দোকান নেওয়া হয়ে ওঠেনি। অবশেষে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে পাদ্রি মিশন স্কুল মোড়ে দোকান ভাড়া নিয়ে আসকি হ্যান্ডিক্রাপ্টস নামে শুরু করি। তখন মিশন স্কুল মোড়ে মাত্র চারটি দোকান এবং দুইটি চায়ের দোকান ছিল।

থকবিরিম :  পুঁজি (টাকা) কত নিয়ে শুরু? কেউ সহায়তা করেছে কিনা?

লাভলী ম্রং : আসকি হ্যান্ডিক্রাপ্টস নামে দোকান নেওয়ার পর দোকানের ডেকোরেশন ও সিকিউরিটি  মানিসহ প্রায় দেড়লাখ এবং দোকানের মালামালের জন্য ষাট হাজার টাকার মত ইভেস্ট করে শুরু করেছি। দোকান শুরুর জন্য নিজের ডিপিএস এবং কিছু ঋণ নিয়ে দোকানের মালামাল মজুদ করেছি। মালামালের মধ্যে – মহিলাদের কাপড় চোপড়, ব্লক বাতিক, রকমারী আদিবাসী ড্রেস, দকমান্দা, দকশারী, ওড়না, থ্রি-পিস, নাচের ড্রেস ও অলংকার, গজ কাপড়, জামালপুরের নক্সীকাঁথা, চাদর, বাচ্চাদের ড্রেস, বিভিন্ন ধরণের ক্রাপ্টস, মহিলাদের ভ্যারাইটিস ব্যাগ, ছাতা, স্টেশনারিস, অর্নামেন্টস ও কসমেটিকস আইটেম ইত্যাদি।

থকবিরিম : প্রেরণা বা উৎসাহদাতা কে? এই ব্যবসা শুরুর আইডিয়া কীভাবে পেয়েছেন?

লাভলী ম্রং : বিয়ের পর সংসার শুরুর থেকেই শহরে অবস্থান। তখন থেকেই মহিলাদের আইটেম নিয়ে ছোটখাট একটা  শো-রুম বা দোকান দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। তখন সময় সুযোগের জন্য করা হয়নি। যখন আমি চিৎসার জন্য দীর্ঘ দিন ঢাকায় অবস্থান করি তখন বিভিন্ন সময় ঢাকায় নারী উদ্যোক্তাদের শো-রুম ঘুরে ঘুরে দেখেছি। বিশেষ করে রাফাপ্লাজা বিল্ডিং-এ জয়িতায় নারীদের তৈরি বিভিন্ন ধরনের কাপড় চোপড় ড্রেস ও অন্যান্য দ্রব্য সামগ্রী বিপনন দেখেছি। এছাড়া নিউমার্কেট, গাউছিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে নারীদের ব্লকবাটিক, বাহারি ডিজাইনের ড্রেস তৈরি ইত্যাদি দেখে তাদের কাছে উৎসাহ ও প্রেরণা পেয়েছি। তখন ময়মনসিংহের বিভিন্ন স্থানে যেমন শেহরা মহিলা পরিষদসহ অন্যান্য নারীরা উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ/ব্যবসা করছিলেন, তখন তাদেরকে দেখে আমারও তাদের মত নরী উদ্যোগতা হতে ইচ্ছে হল। তারপর ২০১৩-এর শেষের দিকে নিজেই ভাটিকাশর এলাকায় পাদ্রি মিশন স্কুল মোড়ে একটা আসকি এন্টারপ্রাইস নামে একটা শো-রুম খুলি। তখন সেখানে এখনের মত তেমন দোকানপাত ছিলনা। এছাড়া ময়মনসিংহ শহরে গারো মহিলারা এই ধরনের কোন শো-রুম বা দোকান শুরু করেনি। আমার ইচ্ছা ছিল গারোসহ অন্যান্য আদিবাসীদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র এবং দৃষ্টি নন্দন বাহিারি ড্রেসসমূহ বর্তমান প্রজম্ম ও বৃহত্তর সমাজের সাথে পরিচয় ঘটানো এবং গারোদের নিজের ব্যবহার্য  জিনিসপত্রসহ কাপড়চোপড় ব্যবহার করার উৎসাহিত করা।

থকবিরিম : শুরুতে কাজের পরিবেশ কেমন ছিল? কোন সমস্যায় পড়েছেন?

লাভলী ম্রং : প্রথম যখন শো-রুম দিয়ে শুরু করি তখন চারদিকে বাঙালি দোকানদারদের সাথে শুরু করেছিলাম। পাদ্রি মিশন মোড়ে তখন চারটি দোকান এবং দুইটি চায়ের দোক ছিল মাত্র। দোকান ভাড়া নিয়েছিলাম এলাকার প্রভাবশালী পৌরসভার ১৯ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলরের নিকট। চারটি দোকানের মধ্যে আমার ছিল মাঝখানে। সাবেক কাউন্সিলার হওয়ায় একজন গারো মহিলাকে দোকান ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে সামান্য গুঞ্জন উঠলেও সরাসরি কেউ কিছু বলার সাহজ করেনি। তবে আমাদের সমাজের গুটিকতক গারো মহিলারা মহিলা হয়ে পুরুষদের সাথে দোকান দেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক না দেখে কিছু সমালোচনা করেছিল প্রথম প্রথম। এদের মধ্যে এখন অনেকে এই জায়গায় শো-রুম বা দোকানের প্রশরা নিয়ে বসেছে। তবে অনেকে আমাকে সাহজ দিয়ে চালিয়ে যেতে বলেছেন। বর্তমানে ভাটিকাশর মিশন স্কুল মোড়ে খ্রিস্টানসহ গারোদের দোকান ও বানিজ্যিক সমিতি এবং কারিতাসের ওয়ানগালাসহ সংখ্যা ২৬টির মধ্যে ২৫টি সচল।

থকবিরিম : উদ্যোক্তা হিসেবে কেমন সহযোগিতা পেয়েছেন?

লাভলী ম্রং : উদ্যোক্তা হিসেবে মোটামোটি সকলের সহযোগিতা পেয়েছি। যেহেতু তখন গারাদের দোকান বা শো-রুম একটাই মাত্র ছিল, কাজেই প্রায় সকলে আমার শো-রুম থেকে কেনাকাটা করত। তবে কিছু বেশ সংখ্যক ব্যক্তিগণ সাথের বাঙালি দোকান থেকে কসমেটিক সামগ্রী কিনলেও আমার এখান থেকে কিনতনা। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে মালামাল সরবরাহ করার সুযোগ পেয়েছি। এখন অনেক জায়গায় দোকান এবং শো-রুম হওয়াতে সেই সুযোগ কম।

থকবিরিম : নিজের পরিবার কেমন সহায়তা করছে?

লাভলী ম্রং : সাধারণতঃ দোকান ও শোরুম আমি নিজেই দেখা শুনা করে থাকি। সেই হিসেবে বিভিন্ন জায়গা হতে মালামাল সগ্রহ প্রধানত আমি নিজেই করি। তবে মাঝের মধ্যে আমার হাসব্যান্ড মালামাল ক্রয় এবং সংগ্রহের জন্য সহযোগিতা করে। এছাড়া পরিবারে সকল সদস্য আমার এই কাজকে পূর্ণসমর্থন করে।

থকবিরিম : বর্তমানে কেমন চলছে?

লাভলী ম্রং : বর্তমানে একই জায়গায় একই স্থানে প্রায় একই ধরনের দ্রব্যসামগ্রীর দোকান বেশ সংখ্যক হওয়াতে খুবই তুলনামূলক বাজার প্রতিযোগিতা চলছে। যদিও আদিবাসীদের পোশাক ও কাপড়চোপড় এই মিশন স্কুল মোড় মার্কেট ছাড়া ময়মনসিংহ শহরে অন্য কোত্থাও মেলে না। তবে পুজির অভাবে ক্রেতা/কাস্টমারদের চাহিদানুসারে দোকানে জিনিস মজুদ করা যায়না/ হয়না আমার।

থকবিরিম : উদ্যোক্তা হতে হলে কী কী গুণের দরকার বলে মনে করেন?  

লাভলী ম্রং : বর্তমান প্রতিযোগিতা মূলক সময়ে উদ্যোগক্তা হিসেবে আসতে চাইলে বা ব্যবসা করতে হলে আমার মনে হয় নিম্নের বিষয়গুলোর দিকে নজর দিলে আগ্রহী ব্যক্তিগণ উদ্যোক্তা হতে পারবে:-

কাজে আগ্রহী, আত্মবিশ্বাসী ও পরিশ্রমি হতে হবে।

অন্যের কান কথায় কান না দিয়ে কাজে লেগে থাকা।

প্রয়োজনীয় পুজি ও বিষয়ে নূন্যতম জ্ঞান থাকা দরকর।

বাজার ও চাহিদা সম্পর্কীত বিষয়ে ধারণা নিয়ে বিনিয়োগ করা।

অন্যান্য উদ্যোগক্তা/ব্যবসায়িদের সাথে সুসম্পর্ক রেখে উইন উইন অবস্থায় অবস্থান করা।

ক্রেতাদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করা।

পারতপক্ষে বাকি কম দেওয়া।

ক্রেতাদের চাহিদা অনুসারে দোকানে বা শো-রুমে মালামাল স্টক করা।

স্লো আইটেম কম মজুদ রাখা।

থকবিরিম : আমাদের এই কাজে আসা কতটা  দরকার ?

লাভলী ম্রং : কথায় বলে ব্যসায় নাকি প্রসার। বর্তমান ডিজিটাল যুগে প্রতিযোগিতামূলক কর্মক্ষেত্রে কর্মসংস্থান করা খুবই কঠিন। কাজেই আমি মনে করি যারা আগ্রহী এবং সুযোগ আছে এমন ব্যক্তিদের উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসায় এসে স্বকর্মসংস্থান করা উচিত। তাছাড়া আদিবাসী বিশেষ করে গারোরা ব্যবসামুখি নয়, চাকুরিমুখি। তবে চাকুরি মুখির পাশাপাশি ব্যবসায় সম্পৃক্ত হওয়া এখন বিশেষ করে গারোদের জন্য একান্তই দরকার বলে আমি মনে করি। কারণ মানুষ বাড়ার সাথে সাথে চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু শুধু সব চাকুরি দিয়ে সেই চাহিদা মিটানো হয়তো অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পরে। তাছাড়া যদি সরকারি চাকুরি না হয়। বেসরকারি চাকুরি অনেক ক্ষেত্রে অস্থায়ী ও নিশ্চয়তা থাকেনা। কাজেই ব্যবসায় যদি মন দিয়ে কাজ করে তবে চাকুরির চেয়ে কম কিসে? এখন শহরের আনাচে কানাচে বাঙালি মহিলারও দোকান নিয়ে কাজ করছে। বিশেষ করে দূরপ্রাচ্যের দেশেতো ব্যবসা বানিজ্য সব মাহিলাদের হতে। আমি মনে করি বাংলাদেশে মহিলারা যেমন বিউটি পার্লারে বিশেষ ভূমিকা রাখছে, তেমনই নারী উদ্যোক্তা হিসেবেও ভূমিকা রাখা শুধু সময়ের ব্যাপার।




সম্পাদক : মিঠুন রাকসাম

উপদেষ্টা : মতেন্দ্র মানখিন, থিওফিল নকরেক

যোগাযোগ:  ১৯ মণিপুরিপাড়া, সংসদ এভিনিউ ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। 01787161281, 01575090829

thokbirim281@gmail.com

 

থকবিরিমে প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। Copyright 2020 © Thokbirim.com.

Design by Raytahost