মহারাষ্ট্র রাজ্যের রাজধানী হল মুম্বাই (বম্বে)। মহারাষ্ট্র রাজ্যটি ৬টি বিভাগ ও ৩৬টি জেলা নিয়ে গঠিত। বাণিজ্য-বিনোদন, চলচ্চিত্র (বলিউড), ক্রিকেট, অর্থনীতি-ব্যবসায়ের জন্য বিখ্যাত মুম্বাই শহর। সমুদ্র বন্দর, ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক, ভারতের জাতীয় স্টক এক্সচেঞ্জ, ও বিভিন্ন কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ও এই শহরেই অবস্থিত। বর্তমান মুম্বাই শহরটি সেই সময়ের আরব সাগরের সাতটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত হয়েছিল। এই সাতটি দ্বীপের নাম ছিল বোম্বাই দ্বীপ, প্যারেল, মাঝগাঁও, মাহিম, কোলাবা, বরলি ও ওল্ড ওম্যান’স দ্বীপ বা লিটল কোলাবা। মুম্বাই ভারতের সর্বাধিক জনবহুল শহর এবং বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল শহরগুলিরও অন্যতম। এই শহরের জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি চল্লিশ লক্ষ। এশিয়ার সবচেয়ে বড় বস্তি মুম্বাইয়ের ধারাভি বস্তি যেখানে প্রায় দশ লক্ষ মানুষ বাস করে। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের তথ্য অনুযায়ী এই শহর আলফা বিশ্ব নগরী হিসেবে ঘোষিত। এই শহর দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে। আমরা ফাদার, সিস্টার, ব্রাদার মোট ২৩ জন পুনে থেকে মুম্বাই গিয়েছিলাম বেড়াতে। যাবার আগের রাতে ও সকালের প্রস্তুতি ছিল মনে রাখার মত। সবাই রান্নার কাজে সাহায্য সহযোগিতা করেছে। কেউ পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ কেটেছে, কেউবা রান্না করেছে, কেউবা চা তৈরি করেছে। ভোর বেলায় উঠে সব কিছু প্রস্তুত করে পাঁচটায় আমরা রওনা দিয়েছি মুম্বাইয়ের উদ্দেশে।
সকাল দশটার মধ্যে মুম্বাই পৌঁছে গেলাম। প্রথমেই গেলাম ‘গেইওয়ে অব ইন্ডিয়া’ স্মৃতি স্তম্ভে। এটি ব্রিটিশ-ভারতের সময় নির্মিত একটি তোরণ স্মৃতিস্তম্ভ। তা দেখতে নয়াদিল্লীর ‘ইন্ডিয়া গেইট’-এর মত। এটি আরব সাগর তীরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার একপাশে সমুদ্রের ওপর ভেসে আছে জাহাজ ও নৌকা আর গাঙ্গচিল উড়ে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। এটি ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করা হয়েছিল মুম্বাইয়ের এপোলো বান্ডার এলাকায় ব্রিটিশ রাজা পঞ্চম জর্জ এবং রানি মেরির আগমনের স্মৃতি রক্ষার্থে। এই স্থাপত্যটি প্রথমে জেলেদের স্থানীয় জেটি হিসেবে ব্যবহৃত হত এবং পরবর্তীতে এটিকে সংস্কার করা হয় যা ব্রিটিশ সরকার ও অন্যান্য প্রখ্যাত ব্যক্তিদের অবতরণ স্থান হিসেবে ব্যবহার করা হত। সেই সময় নৌকা বা জাহাজে করে ভারতে এলে এই জলপথই ব্যবহার করতেন। অনেকেই এটাকে মুম্বাই-এর তাজমহল বলে আখ্যায়িত করে থাকেন।
এটি মুম্বাইয়ের প্রধান দর্শনীয় ও আকর্ষনীয় স্থান। তার পাশেই আরব সাগরের নীল জলে ভেসে আছে পাঁচ তারকা হোটেল তাজমহল যে হোটেলটি ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ নভেম্বর সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রমনের শিকার হয়েছিল এবং কমপক্ষে ১৬৭ জন লোক মারা গিয়েছিল। সেখান থেকে গেলাম ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ বস্তু সংগ্রহশালায়। এই সংগ্রহশালায় প্রায় পঞ্চাশ হাজার জিনিস পত্র সংগ্রহে রয়েছে। আদি সভ্যতা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, বিভিন্ন ধর্মের ইতিহাস-ঐতিহ্য প্রভৃতি রয়েছে। অডিও-ভিজুয়াল সিষ্টেম রয়েছে বর্ণণাগুলো দেখা ও শোনার জন্য। সংগ্রহশালা থেকে রওনা হলাম মেরিন ড্রাইভ দেখার জন্য। তখন মাথার উপর সূর্যের আলো পড়তে শুরু করেছে। মেরিন ড্রাইভ দেখতে ইংরেজি অক্ষর সি (ঈ) এর মত। এর দৈর্ঘ ৩.৬ কিলোমিটার সাগরের তীর ঘেষে। সেখানে গিয়ে যেন হারিয়ে গেলাম অন্য ভুবনে। সেখানে অনেক গাঙচিল উড়ে বেড়ায় যা পর্যটকদের অনেক আকর্ষণ করে ও আনন্দ দান করে। গাঙচিলের উড়ে বেড়ানো দেখে আনন্দে অভিভূত হয়ে গেলাম। একটু খাবার দিতেই ওরা আমাদের কাছে এসে গেল আর কত আপন হয়ে গেল। ওদের কাছে পেয়ে রোদের তাপ যেন ভুলেই গেলাম। মেরিন ড্রাইভের উপর হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ালাম। কিছুক্ষণ পর বান্দ্রা সমুদ্র সৈকতে এসে পৌঁছলাম।
তখন সমুদ্র তীরে ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করল। আর কি চমৎকার পরিবেশ তৈরী হল! এখানে এসে রোদের প্রখর তাপ, ক্লান্তি সবই ভুলে গেল। সবার প্রাণ শীতল বাতাসে জুড়িয়ে গেল। বান্দ্রা সমুদ্র তীরেই আছে খ্রিষ্টানদের অনেক গির্জা ও প্রতিষ্ঠান, নায়ক-নায়িকাদের বাসা। ভাগ্য প্রসন্ন হলে তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতেও পারে। আছে জাদুঘর, সমুদ্র সৈকত, যানজট নিরসনের জন্য তৈরি সি-লিংক রোড। সি-লিংক রোড দিয়ে যাবার সময় মনে হল সাগরের উপর দিয়ে যাচ্ছি। এ এক অনন্য অনুভূতি। মুম্বাই থেকে পুনে ফিরে আসার সময় রাস্তার ধারেই এশিয়ার সবচেয়ে বড় বস্তি ধারাভি বস্তি চোখে পড়ল। মুম্বাই শহরে অনেক যানজট বলে আমরা রাতে রওনা দিয়েছিলাম পুনে শহরের দিকে। তাই রাতের অন্ধকারে আমরাও মহারাষ্ট্র রাজ্য ছেড়ে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম।
গভীর রাত্রে মুম্বাই থেকে পুনে শহরে পৌঁছলাম। পুনে শহরে আমাদের মত এত ট্র্যাফিক জ্যাম নেই, ট্র্যাফিক পুলিশও নেই। কিন্তু ওরা সিগন্যাল মান্য করে চলে। এখানকার মাটি পাথুরে মাটি, অমসৃন, অসমতল ও উঁচু-নিচু ছোট ছোট পাহাড়-টিলা রয়েছে। তাই ফসল ফলানোর জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হয়। এখানকার অফিসিয়াল ভাষা হল মারাঠি। নারীরা শাড়ী পরলেও অনেকেই ধুতীর মত পিছনে গুছিয়ে পরে। পুনে শহরে খ্রিষ্টানদের গির্জা, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গঠন গৃহ ও ফাদার-সিস্টারদের গৃহ চোখে পড়ার মত। আছে উপাসনার বিভিন্ন রীতি : ল্যাটিন, সিরো মালাবার (সাধু টমাস) ও সিরো মালাঙ্কারা। আমিও সিরো মালাঙ্কারা উপাসনা রীতির খ্রিষ্টযাগে যোগ দিয়েছিলাম। ওদের খ্রিষ্টযাগ শেষ হতে কমপক্ষে দুই ঘন্টা লাগবেই। খ্রিষ্টযাগ দীর্ঘ হলেও ওদের মধ্যে কোন বিরক্তি নেই, ওরা খুব আনন্দ করে, আনন্দ নিয়ে গান করে, উত্তরগুলো দেয়। এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ব্রাদার গ্রেনার রিছিল আমাকে ভারতে বসবাসরত নাথায়েল সাংমার ফোন নাম্বার পাঠিয়ে দিলেন। তিনি ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে ভারতের মাটিতে ২৫ বছর ধরে বসবাস করছেন, সেখানেই বাঙালিকে বিয়ে করেছেন।
বিদেশের মাটিতে এসে একজন মান্দিকে পেয়ে সত্যিই খুশি হলাম। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন মুলসি ড্যামের লেকে। খুব সুন্দর জায়গা। দেখে মনে হবে “আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ।” পাহাড় যেন জলে ধৌত হচ্ছে অবিরত। এরকম আরো কয়েকটা হৃদ এখানে আছে। তার মধ্যে লাওয়াসা হ্রদ অন্যতম কারণ এটি একটি পরিকল্পিত হ্রদ। এ হ্রদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে শহর। এখানে গির্জা, স্কুল সবই আছে। বিনোদনের জন্য একটি সুন্দর স্থান। পুনে শহরেই আগাখান প্রাসাদ অবস্থিত। যেখানে মহাত্মা গান্ধী ও অন্যান্য নেতা ভারত ছাড় আন্দোলনের সময় কারারুদ্ধ ছিলেন। এখানে আছে মহাত্মা গান্ধীর স্ত্রী কস্তবাই গান্ধীর সমাধি ও মহাত্মা গান্ধীর দেহাবশেষ ছাঁই। রয়েছে মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিচিহ্ন, ছবি, ইতিহাস প্রভৃতি। দেখতে দেখতে ২৯ ফেব্রুয়ারি আমাদের বিদায়ের ঘন্টা বেজে উঠল।
বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, নাগাল্যান্ড, উত্তর প্রদেশের আগ্রা, মধ্য প্রদেশ, তামিল নাডু, মহারাষ্ট্রের মুম্বাই থেকে আমরা ১৮ জন ছিলাম। ভারতে গিয়েও মনে হয়েছে নিজের দেশেই আছি। তাদের আন্তরিকতা, সাহায্য-সহযোগিতা, পরামর্শেই দর্শনীয় স্থানে ঘুরে বেড়ানো আমার জন্য সহজ ও আনন্দপূর্ণ ছিল।
লেখক: খ্রিষ্টান যাজক
পরিচালক, মরো সেমিনারি, ২৮ জিন্দাবাহার ১ম লেন, ঢাকা-১১০০।
‘সাংসারেক ওয়ান্না, গোড়ামী আর উপসাংসারেক-এর গল্প’
: আমার ধারণা-মিদ্দি রাবুগা, সালজং আমার উপর অধিক খুশি হয়ে বর......বিস্তারিত
-
সাংসারেক ওয়ান্না, গোড়ামী আর উপসাংসারেক-এর গল্প
: আমার ধারণা-মিদ্দি রাবুগা, সালজং আমার উপর অধিক খুশি হয়ে বর...
-
কালাচাঁদপুরে চলছে মাসব্যাপী গারো বইমেলা
: কালাচাঁদপুরের শিশু মালঞ্চস্কুল প্রাঙ্গণে চলছে গারো বইমেলা। বইমেলা শুরু হয়েছে...
-
প্রকাশিত হলো লিয়াং রিছিল-এর Bi·sarangni Goserong
: প্রকাশিত হলো আ·চিক ছড়াকার লিয়াং রিছিল-এর প্রথম অনবদ্য সাহিত্য-কর্ম ‘Bi·sarangni...
-
আমরা আটকে গেছি ।। মৃগেন হাগিদক
: প্রগতিশীল নেতাদের অভিমত, আমরা (আচিক, মান্দি বা গারো) আটকে আছি,...
-
গারো জাতি সত্তার কবি মতেন্দ্র মানখিনকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা
: আজ কবি মতেন্দ্র মানখিনের জন্মদিন। জন্মদিনে থকবিরিম পরিবারের পক্ষ থেকে...
-
Noksil ।। Labison Sku
: Noksil Mosla nonga bringni do.bipani japingko cha.ai Da.au mangmang...
‘সাংসারেক ওয়ান্না, গোড়ামী আর উপসাংসারেক-এর গল্প’
: আমার ধারণা-মিদ্দি রাবুগা, সালজং আমার উপর অধিক খুশি হয়ে বর......বিস্তারিত
‘সাংসারেক ওয়ান্না, গোড়ামী আর উপসাংসারেক-এর গল্প’
: আমার ধারণা-মিদ্দি রাবুগা, সালজং আমার উপর অধিক খুশি হয়ে বর......বিস্তারিত