Thokbirim | logo

২৫শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | ১০ই ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

চিরিং: তর্ক তোলা দুটি গারো প্রথা ।। উন্নয়ন ডি. শিরা

প্রকাশিত : আগস্ট ০৭, ২০২০, ২২:১৬

চিরিং: তর্ক তোলা দুটি গারো প্রথা ।। উন্নয়ন ডি. শিরা

এক নির্নিমেষে তরুণ গল্পকার মিন্টু মার্টিন মান্দার ছোট গল্প ‘চিরিং’পড়লাম। ছোট করে বলতে গেলে, গায়ে শেল বিধঁলো। মগজে কিলবিল করা পুরনো প্রশ্নগুলো ফের মাথা চাড়া দিয়ে গেল। সমাজ সভ্যতা পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজের মান্দাত্য আমলের প্রথাগুলোর পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়ে, নইলে তা-র বলি সমাজের মানুষকে হতে হয়। যেমন- ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মাঝে একসময় সতীদাহ প্রথা বা সহমরণ প্রথার প্রচলন ছিল। এই প্রথার বলি বহু নিরীহ দুর্ভাগা হিন্দু নারীকে হতে হয়েছে, বলি দিতে হয়েছে দগদগে সতেজ প্রাণ। গারো সমাজেও এমন কিছু প্রথার প্রচলন আছে যা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশ্নবিদ্ধ সেইসব প্রথা চিরিং গল্পে গল্পকার মুন্সীয়ানার সাথে তুলে এনেছেন।

চিরিং গল্পের নায়ক সত্তুরোর্ধ্ব বিবাল সাংমা। গল্পে জীবনের সায়াহ্নে পৌঁছে তিনি গড়গড় করে আবেগ ঢেলে দিচ্ছেন, অকপটে বলছেন সত্তুরোর্ধ্ব জীবনের অভিজ্ঞতা। তিনি একসময় গারোদের আদিধর্ম সাংসারেক ধর্ম পালন করতেন। জীবনের ষাটটি বসন্ত পার করে শেষ জীবনে তিনি মিশনারীদের দ্বারা খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হন। ২২ বছর বয়সে নায়ক বড় দাদার বিয়েতে চিরিং নামের অনিন্দ্য সুন্দরী এক ললনার রূপে মোহিত হন, প্রেমে পড়েন। বিয়ের অনুষ্ঠানে গারো লোকগীতি সেরেনজিং’র মাধ্যমে চিরিং’র সাথে বিবালের ভাব বিনিময় হয়। অবশেষে মিষ্টি মধুর প্রেম। মান-অভিমান, চিঠি আদান প্রদানে প্রেম ঠিকঠাক এগোচ্ছিল, হয়তো পরিণয়ের দিকে এগোতে পারতো কিন্তু গারো সমাজে প্রচলিত ‘চাপ্পা বা হনগ্রিকা’ প্রথার ফলে পরিশুদ্ধ সেই প্রেম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। চিরিং বিবালের পবিত্র প্রেমের যবনিকাপাত ঘটে।

চিরিং বিবালের হৃদয় ভূমিতে অঙ্কুরিত হওয়া ভালোবাসা নামের ছোট ছোট বৃক্ষগুলো চাপ্পা প্রথার ফলে এক নিমিষে তছনছ হয়ে যায়। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় বিবালের সদ্য বিবাহিত বড় দাদা মারা যান। মারা যাওয়ার সময় দাদার ঘাড়ে ও গলায় কালচে দাগ ছিলো; এ থেকে অনেকেই ধারণা করেছিল যে, বড় দাদা মিদ্দি অর্থাৎ খারাপ আত্মার আক্রমনে মারা গেছেন। এই বিশ্বাস পশ্চাৎপদ গারো সমাজে এখনো পরিলক্ষিত হয়।

মাটির নিচের জল নলকূপের সাহায্যে যেভাবে তুলে আনা হয় তেমনি গারো সমাজের এই চিত্র গল্পকার দক্ষতার সাথে তুলে আনতে পেরেছেন। শুধু তা-ই নয়, সাতটি বারের মঙ্গলবার ও শনিবার গারো সমাজের মতো পশ্চাৎপদ অনেক সমাজে অমঙ্গলের দিন বলে বিবেচিত হয়। এই দিনগুলোতে গারোরা বিয়ে, পবিত্র কোনো কার্য সম্পাদন কিংবা ভ্রমণ করা থেকে বিরত থাকে। উল্লেখ্য, চিরিং গল্পে বিবালের দাদার বিয়ে মঙ্গলবার সম্পাদিত হয়েছিল। এখানে অমঙ্গলের চিত্রটিও সমানভাবে উঠে এসেছে।

গারো সামাজিক অনুষ্ঠান, সংস্কৃতির বিষয় গল্পে স্পষ্টতর। আগে গারো বিয়ে বাড়িতে সেরেনজিং গাওয়া হতো, সেরেনজিং’র মাধ্যমে পরিচয়, গানে গানে ভাব, বাক্য বিনিময়, প্রতিযোগিতা চলতো। এখন সেরেনজিং’র চল উঠে গেছে। সেরেনজিং’র বদলে বাঙালি সংস্কৃতি কিংবা পাশ্চাত্য কায়দায় বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। সেখানে বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, আসামিসহ মিশ্র সংস্কৃতির কোমর দোলানো নাচের গান ছাড়া হয়।

সেইসব বিয়ের অনুষ্ঠানে কোন ধরনের গারোয়ানির চিহ্ন খুজেঁ পাওয়া যায় না। ইদানিংকার গারো বিয়েগুলো বাঙালি কিংবা পাশ্চাত্য স্টাইলে সম্পাদন হয়; এটিও গল্পকার সুন্দর করে ফুটিয়ে এনেছেন। বিয়ে গুলোতে অল্প পরিমাণ গারোয়ানা স্বারক থাকে না। বিয়ে দেখে মনে হবে যেন কোনো বিদেশী ম্যাম সাহেব বিয়ের পিড়িঁতে বসেছেন।

সে যাহোক, দাদা মারা যাবার পর গারো প্রথানুযায়ী বৌদি গিসিকের সাথে বিবালের বিয়ে হয়। এই প্রথাকে বলা হয় ‘হনচাপ্পা’। মূলত দুই বাড়ির আত্মীয়তা ধরে রাখতেই এই প্রথার প্রচলন। সম্পর্কের খাতিরে এটি হয়তো ইতিবাচক, আবার অন্যদিকও আছে। অন্যদিকটা চলতি গারো সমাজে রীতিমতো আলোচনার খোরাক, এক শ্রেণির গারো পুরুষ প্রথাগুলোর কঠোর সমালোচনা করে থাকে। গারো দুটি প্রথা ‘হনচাপ্পা বা হনগ্রিকা’, ‘সম্পত্তির উত্তরাধিকারী আইন’ গপ্পের টেবিল গরম করার হট টপিক্স।

এই আইনগুলোকে অনেক সমালোচক সংস্কার করার দাবি উত্থাপনের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি, সংগঠন গড়ে তুলছেন। তবে যে প্রশ্নটা তোলা জরুরি, দাবিটা কার কাছে তোলা হচ্ছে? কার কাছে যাচ্ছে সেইসব দাবি? গারো সমাজের তো কোনো কর্তৃপক্ষই আর নেই। নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ ছাড়া দাবি উত্থাপন নিষ্ফল।

যে পুরুষ কিংবা নারী তথাকথিত হনচাপ্পা প্রথার শিকার তাদের অবস্থা কেমন হয় তা মান্দা সাহেবের চিরিং গল্পের নায়ক বিবালের বয়ানে পাওয়া যাবে। বিবাল যেদিন হনচাপ্পা প্রথার বলি হন সেদিনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন- ‘সেদিন নিজেকে একটা উপহারের বস্তু বা কাদা মাটি মনে হয়েছিলো। পুতুলের কোন অংশ ভেঙ্গে গেলে যেমন কাদায় জোড়া লাগানো যায় ঠিক তেমনি। সব আচার হয়েছিল সম্পন্ন। মেনে নিয়েছিলাম সবকিছু আমার নিয়তি বলে’।

গল্পকার গল্প দ্বারা সমাজে হনচাপ্পা প্রথার পরিণামের চিত্র একেঁছেন। অন্যত্র প্রথাটির বিপরীত চিত্রও আছে। অগ্রজ লেখক কার্তিক ঘাগ্রা তাঁর এক লেখনীতে বাস্তব উদাহরণ টেনে হনচাপ্পা প্রথার পরিণাম বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। তিনি তাঁর লেখায় লেখক সরোজ ম্রং’র উদাহরণ টেনে বলেন- ‘সরোজ ম্রং উদ্বাস্তু ও আশ্রয়হীন।

জলের বান তাঁর বাস্তুভিটা গ্রাস করেনি। আশ্রয়হীন করেনি। এই মান্দি সমাজ, এই সংসার, এই সমাজের প্রথা, সিস্টেম, রুলস, এক্ট তাকে আশ্রয়হীন করেছে, উদ্বাস্তু করেছে। এতে সমাজের কিছু যায় আসে না। সমাজ প্রেমিকদের কিছু যায় আসে না। মান্দি ছেলেদের কিছু যায় আসে না। কারণ সরোজ ম্রং একজন। কারণ সরোজ ম্রং একা। কারণ সরোজ ম্রং সমাজের তুলনায় নগণ্য, কীট-পতঙ্গ।’

কথাটির সত্যতা যাচাই করলে দেখা যায়, ব্যক্তিগত জীবনে সরোজ ম্রং যে গারো নারীকে বিয়ে করেন তিনি সংসাররত অবস্থায় এক দুর্ঘটনায় মারা যান। ফলে স্বাভাবিকভাবে স্ত্রী মারা যাবার পর ম্রং সাহেব শ^শুর বাড়ি থেকে পদ্ধতিগতভাবে প্রত্যাখাত হন। তাঁর শ্বশুর বাড়ি থেকে অন্য কোন বিকল্প নারীকে স্ত্রী হিসেবে না দেয়ায় তিনি ঐ পরিবারের সদস্য কার্ড হারিয়ে ফেলেন। অন্যদিকে নিজের মায়ের দিকেও তিনি সিস্টেমেটিক সদস্যহীন, কেননা গারো রীতি অনুযায়ী পুরুষ সম্পত্তির ভাগ পাবে না। রীতি অনুযায়ী, গারো পুরুষ বিয়ের আগে যেসব সম্পদ অর্জন করবেন সেসব তাঁর মায়ের কাছেই থাকবে, বিয়ের পরে যা কিছু কামাই রোজগার করবেন সেসব স্ত্রীর পরিবারে গচ্ছিত থাকবে।

বস্তুত গারো পুরুষের নিকট কোন সম্পত্তি থাকবে না। স্ত্রী মারা গেলে গারো পুরুষ উভয় সংকটে পড়ে যান। এখানে যে বিষয়টি উল্লেখ করা আবশ্যক খুব কম গারো পুরুষ স্ত্রী মারা গেলে অন্যত্র নতুন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এটি হয়তো গারো পুরুষদের স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার এক অনন্য নিদর্শন। মূল্যবোধের বিষয়ও বটে।

চিরিং গল্পের গল্পকার বিবাল সাংমা নামের এক সত্তুরোর্ধ্ব ব্যক্তির আড়ালে নিজের মত ব্যক্ত করেছেন প্রাঞ্জল ভাষায়- ‘আমি সমাজের রীতিনীতির বিপক্ষে নই। সমাজের নিয়মনীতি আগেও পরিবর্তন হয়েছিলো এখনো হচ্ছে আর ভবিষ্যতেও যে হবেনা এমনটা আশা করা মোটেও ঠিক হবেনা।

সমাজের রীতিনীতি সময় ও কালের যাত্রায় যে বিভিন্ন মাত্রায় পরিবর্তিত হয় তা আমার এই সত্তরোর্ধ্ব জীবনে অনেকবার পরিলক্ষিত করেছি। পূর্বের সমাজ রীতিনীতি আর বর্তমানের রীতিনীতি দুটোর বিরুদ্ধে আমি নই। তবে কিছু রীতিনীতি যা ব্যক্তির মতের বাইরে ব্যক্তির জন্য এক প্রকার বোঝা তৈরী করে দেয় বা চাপিয়ে দেওয়ার মতো আমি তাঁর পক্ষে নই।’ আমিও নই।

কভার প্রচ্ছদ শিল্পী তিতাস চাকমা

লেখক পরিচিতি:

উন্নয়ন ডি. শিরা, তরুণ প্রবন্ধকার এবং জনজাতিরকণ্ঠ নিউজ পোর্টালের সম্পাদক।

লেখক উন্নয়ন ডি. শিরা । ছবি থকবিরিম

 

আরো লেখা

রাষ্ট্রের অ্যান্টাগনিজম ।। নিগূঢ় ম্রং

করোনাকালে কেমন আছেন কবি পরাগ রিছিল

গারো জাতি সম্পর্কে কিছু জানতে হলে এই বই অনেকটা সহায়ক ।। জেনিস আক্তার

ফুলগুলি ফুলকপির।। জেনিস আক্তার




সম্পাদক : মিঠুন রাকসাম

উপদেষ্টা : মতেন্দ্র মানখিন, থিওফিল নকরেক

যোগাযোগ:  ১৯ মণিপুরিপাড়া, সংসদ এভিনিউ ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। 01787161281, 01575090829

thokbirim281@gmail.com

 

থকবিরিমে প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। Copyright 2020 © Thokbirim.com.

Design by Raytahost