পূর্ব প্রকাশের পর…
কোনো জাতি বা সমাজকে ভালো করিয়া জানিতে হইলে সেই জাতি বা সমাজের অতীতকে জানিতে হয়। কারণ অতীতই বর্তমানের জনক এবং বর্তমান হইল ভবিষ্যতের জনক। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলিয়াছেন-
“হে অতীত তুমি ভুবনে ভুবনে
কাজ করে যাও গোপনে গোপনে।”
আমরা সাধারণত অতীতকে ভুলিয়া যাই। অতীতকে জানিতে চাহি না, স্মরণ করি না, স্মরণে রাখিতে চাহি না মর্যদা বা মূল্য দিতে চাহি না। কিন্তু ইহা আমাদের জন্য কল্যাণকর নহে। কারণ অতীতই বর্তমানকে জন্ম দেয়। বর্তমান অতীতের কাজের ফল। বর্তমানে আমরা যেভাবে আছি বা যে অবস্থায় আছি তাহা অতীতের সৃষ্টি। আর বর্তমানে আমরা যাহা কিছু করিব তাহাই আমাদের সমাজ বা জাতির ভবিষ্যতকে গড়িবে। অতীতের অবস্থা বা কাজ ভাল হইলে বর্তমানের অবস্থা ভাল হইবে। বর্তমানের অবস্থা বা কাজ ভাল না হইলে ভবিষ্যতের অবস্থা ভাল হইবে না। আর ইহাই স্বাভাবিক। তবে ইহার যে ব্যক্রিম হইতে পারে না তাহা নহে। আমরা জানি ভাল গাছে ভাল ফল ধরে আর মন্দ গাছে মন্দ ফল ধরে।
তাই কোন সমাজ বা জাতির অতীত ভাল হইলে বর্তমানের ভাল হইবে। অতীত মন্দ হইলে বর্তমানও মন্দ হইবে। সেই জন্যই বর্তমানকে ভাল করিয়া জানিতে হইলে অতীতকে জানিত হয়। শুধু অতীতের খাতিরেই আমরা অতীতকে জানিব না, বর্তমানকে ভাল করিয়া জানিবার জন্যই অতীতকে জানিব। কারণ অতীতকে জানিলে আমরা বর্তমানকে জানিতে ভবিষ্যতের জন্য দিন-নির্দেশনা পাইব। অবশ্যই দিগ নির্দেশনা- পাইবার শর্ত-যদি আমরা অতীতের ভাল মন্দ হইতে শিক্ষা পাই, চেতনা পাই, প্রেরণা পাই, উদ্ধুদ্ধ হই, সম্মুখের দিকে ভালভাবে অগ্রসর হইবার জন্য দৃঢ়ভাবে সংকল্প বদ্ধ হই। এই জন্যই আমাদের জাতির বা সমাজের অতীত ইতিহাস জানা প্রয়োজন। কারণ আমাদের বর্তমান সমাজ-সংস্কৃতি সবকিছুর মূল অতীতের গর্তে নিহিত। আজকের দিন বর্তমান, এই দিন আগামী কাল হইবে অতীত। আজিকার কাজ ভাল কি মন্দ আগামীকাল তাহা জানা যাইবে। অর্থাৎ আগমীকাল তাহার পর্যালোচনা হইবে। তাই আমাদের জাতি বা সমাজের ইতিহাস জানা আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন।
আর ইতিহাস বলিলে আমরা যেন শুধু রাজনৈতিক ইতিহসাকেই না বুঝি। আমাদের জানিতে হইবে, আমাদের অতীতের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, শিল্প, ভাষা-সাহিত্য, শিক্ষা প্রভৃতি সব কিছুর ইতিহাস-যাহা যুগে যুগে আমাদের জাতীয় জীবন ধারার সহিত জড়িত ছিলো। এই সব জানা উচিত আমাদের বর্তমান জীবন-ধারার অবস্থাকে জানিবার জন্য এবং বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে কর্মপন্থা নির্ধারণ করিবার। সুতরাং আমরা বলিতে পারি ইতিহাস জানার বা পাঠের মুখ্য উদ্দেশ্য-ভবিষ্যতের জন্য জাতি বা সমাজ হিসাবে সঠিকভাবে কমসূচি তৈয়ার করা। এই বিষয়ে স্যার জন সিলির উক্তি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। উক্তিটি ‘I tell you that when you study history, you study not the past of England, but her future.’
গারোদেরকে তাহাদের ইতিহাস অবশ্যই জানিতে হইবে। কিন্তু শুধু মাত্র নিজেরদের জানিলেই চলিবে না। মহাদেশের ইতিহাস এবং জানিতে হইবে। বিভিন্ন যুগের, বিভিন্ন আমাদের ইতিহাস জানিতে হইবে। বিশ্বের ইতিহারেও জানিতে হইবে। কারণ সারা বিশ্বে আমাদের মত অনেক আদিবাসী জাতি ছিলো এবং এখনও অল্প-বিস্তর আছে। অতীতে সারা বিশ্বে আদিবাসী-জাতিদের প্রতি বড় বড় ও উন্নত জাতি এবং বড় বড় দেশ কিরূপ নীতি অবলম্বন করিয়াছে, তাহার ফলাফল কি হইয়াছে, তাহা জানা উচিত ও পর্যালোচনা করা উচিত। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার ইন্ডিয়ানদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের অনুসৃত নীতি, আফ্রিকার নিগ্রোদের আমদানী ও তাহাদের প্রতি অনুসৃত নীতি, এইভাবে বিভিন্ন দেশের অনুসৃত নীতিগুলি জানা উচিত। বিশ্বের ইতিহাস পাঠে সেই সব অনুসৃত নীতি জানিয়া জ্ঞান লাভ করা যায়।
এই জন্য ঐতিহাসিক ফ্রড W (Proude) বলিয়াছেন-“ইতিহাসই ন্যায়-অন্যায়ের কালজয়ী বাণী বাহক”। ইতিহাসেই আমরা দেখিতে পাই-বিভিন্ন জাতির জীবন সংগ্রাম, ঘাত-প্রতিঘাত, জয়-পরাজয়, উত্থান-পতন। কোথায় গেল অসুরীয় বাবিলনীয়, পারসিক, গ্রিক, রোমান প্রভৃতি সাম্রাজ্য। বিশ্বের নিয়ন্তা সৃষ্টিকর্তাই ইতিহাসের প্রকৃত রচয়িতা। এই জন্যই অলিভার ক্রমওয়েল যথার্থভাবেই বলিয়াছেন, “মানব সমাজের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত এবং ঘটনাবলির মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা নিজের মহিমা প্রকাশ করিয়া থাকেন।” তাই আমরা ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার মহিমা উপলব্ধি করিতে পারি গারোদের ‘ইতিহাস’ সম্বন্ধে আলোচনার আগে ‘ইতিহাস’ কী তাহা জানা দরকার। ইতিহাস কথাটি বাংলা শব্দ ‘ইতিহ’ হইতে উদ্ভব হইয়াছে (ইতিহ+অন=ইতিহাস)। ‘ইতিহ’ শব্দের অর্থ পুরাবৃত্ত বা প্রাচীন কাহিনি। আমরা সাধারণ: অতীতের ইতিবৃত্তকেই ইতিহাস বলিয়া থাকি। আর অতীতের ইতিবৃত্ত বলিতে বুঝায় মানুষের অতীত কার্যাবলীর বিবরণ। এই ইতিহাস শব্দের প্রতিশব্দ History| History শব্দটি গ্রিক শব্দ Historia হইতে আসিয়াছে। Historia শব্দের অর্থ অনুসন্ধান। History শব্দ হইতে Historograply শব্দ আসিয়াছে। ইহার অর্থ ইতিহাস লিখনের কলা কৌশল।
সুতরাং আমরা দেখিতে পাই যে, ইতিহাসের দুইটি দিক আছে। একটি সত্যের অনুসন্ধান ও অন্যটি তাহার ইতিবৃত্ত প্রদান। কাজেই লিখিত বিবরণ সত্য ও তথ্যভিত্তিক না হইলে ইতিহাস হয় না। লিখিত বিবরণ রাজ-রাজাদের খুশি করিবার বা তাঁহাদের অনুগ্রহ লাভের জন্য তাঁহাদের গুণগান বা মহিমা কীর্ত্তন হইলে তাহা ইতিহাস হয় না, হয় কাব্য-সাহিত্য। আর হীন উদ্দেশ্য সত্য তথ্যকে বিকৃত করিয়া বিবরণ প্রদান করিলেও ইতিহাস হয় না। ইতিহাস বলিয়া চালাইলেও তাহা হয় বিকৃত ইতিহাস। তাই অনেক মণীষী ইতিহাস বিষয়ে বিরাগ মনোভাব পোষণ করিয়া গিয়াছেন।
তাঁহাদের মধ্যে নেপোলিয়ান, ওয়ারপোল, জুলিয়াস সিজার, স্পেন্সার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। কারণ যুক্তি ও প্রমাণিক তথ্যভিত্তিক লিখিত ইতিহাস বিজ্ঞান-সম্মত ইতিহাস। আর ইতিহাসের সংজ্ঞাও তাহাই বলে। মেইটল্যান্ড বলিয়াছেন-‘মানুষ অতীতে যাহা কিছু করিয়াছে বলিয়াছে এবং সর্বোপরি যাহা কিছু চিন্তা করিয়াছে- তাহার বিবরণই হইল ‘ইতিহাস’। আর ভি, ভি, ঘটে বলিয়াছেন-‘অতীতে সংঘটিত ঘটনাবলির বিজ্ঞান-সম্মত আলোচনাই হইল ইতিহাস।’ এই বিজ্ঞান সম্মত ইতিহস লিখিবার জন্য প্রয়োজন হয় সঠিক উপাদানের। এই উপাদান- অবশেষে অর্থাৎ মানুষের ভাষা, সাহিত্য, শিল্পকলা, শিল্পদ্রব্য, আইন-কানুন, রীতিনীতি, মুদ্রা, সৌধ, স্মৃতিস্তম্ভ প্রভৃতি মধ্যদিয়া যে সমস্ত চিহ্ন এখনও মানুষের স্বেচ্ছকৃত চেষ্টা ব্যতিরেকেও রহিয়া গিয়াছে। মৌখিক কাহিনি যেমন, পৌরাণিক কাহিনি, গাঁথা, সঙ্গীত। লিখিত বা রেকর্ডপত্র- সরকারি অফিস সমূহে সংরক্ষিত রেকর্ডপত্র ও বেসরকারি দলিলপত্র, যেমন ব্যক্তিগত চিঠিপত্র, কবিতা, গল্প চিত্র, ভ্রমন কাহিনি, মানচিত্র ইত্যাদি।
চলবে…
লেখক পরিচিতি
গারো সম্প্রদায়ের জ্ঞানতাপস, পণ্ডিতজন রেভা. মণীন্দ্রনাথ মারাক জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। বর্তমনে তিনি দুর্গাপুর থানা ধীন নিজ বাড়ি বিরিশিরির পশ্চিম উৎরাইল গ্রামে বসবাস করছেন। দুই ছেলে এক মেয়ে। স্ত্রী প্রতিভা দারিংও একজন শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে অবসরে আছেন। রেভা. মণীন্দ্রনাথ মারাকের অনেক লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। উনার গারো সংস্কৃতি এবং বিরিশিরি মিশিন এবং ব্যাপ্টিস্ট মণ্ডলীর ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বই।

জ্ঞানতাপস মণীন্দ্রনাথ মারাক
আরো লেখা
সংস্কৃতি সংরক্ষণে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জানার প্রয়োজনীয়তা ।। পর্ব-২ ।। মণীন্দ্রনাথ মারাক
গারো অঞ্চলে খ্রিষ্ট ধর্মের আগমন ।। পর্ব-৫ ।। মণীন্দ্রনাথ মারাক
গারো অঞ্চলে খ্রিষ্ট ধর্মের আগমন ।। পর্ব-৫ ।। মণীন্দ্রনাথ মারাক
গারো অঞ্চলে খ্রিষ্ট ধর্মের আগমন ।। শেষ পর্ব ।। মণীন্দ্রনাথ মারাক
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত
-
রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর উৎসব ওয়ানগালা
: রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও...
-
আজ লেখক ও চিন্তক আলবার্ট মানকিন-এর স্মরণসভা ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান
: মধুপুর গড়াঞ্চলের আদিবাসী নেতা, চিন্তাবিদ, লেখক, সমাজকর্মী, এনজিও কর্মী আলবাট...
-
গুলশান বনানী ওয়ানগালা ২১ অক্টোবর শনিবার
: গুলশান বনানী ওয়ানগালা ২১ অক্টোবর শনিবার আদি সাংসারেক গারো জাতিগোষ্ঠীর...
-
১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ...
-
রে রে : হায়রে আমার কাঞ্জিয়া ।। নীলু রুরাম
: সমর সাংমার রেরে নিয়েই শুরু করি তবে একটু আলাদা। আমাদের...
-
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিরাপদ ব্যবহার ।। জাডিল মৃ
: এক. সময় স্রোতের সাথে আবাহমান ছুটে চলা প্রযুক্তির উন্নতি, মানব...
‘রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর উৎসব ওয়ানগালা’
: রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও......বিস্তারিত
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত