Thokbirim | logo

২৫শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | ১০ই ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

নারী নকমা প্রসঙ্গ : প্রথাবাদীই কি এদের মূল যুক্তি! ।। দিশন অন্তু রিছিল

প্রকাশিত : আগস্ট ০৫, ২০২০, ২০:১০

নারী নকমা প্রসঙ্গ : প্রথাবাদীই কি এদের মূল যুক্তি!  ।। দিশন অন্তু রিছিল

কিছু লেখার বা বলার আগে সবার কাছে এটা স্পষ্ট করতে চাই যে, আমি কোন পণ্ডিত নই, নই কোন গারো ঐতিহ্যের ধারক বাহক। আমি নিজেকে কখন ভাবি না আমি একজন জ্ঞানবান, এমনকি নই কোন চিন্তাবিদ। আমি নিজেকে নিতান্ত একজন গারো জাতির একজন ব্যক্তি মনে করি। সাথে যোগ করা যেতে পারে একজন বোকা মানুষ হিসাবে। যা আমি আমার ফেইসবুকের প্রোফাইল এ দিয়ে রেখেছি। যেন প্রোফাইলে গিয়ে সহজেই আমার ব্যপারে একনজরে বুঝে নিতে পারে। আর ভাবা যেতে পারে একজন ভিন্ন টাইপের চিন্তার মানুষ। কেননা, সাধারণ মানুষ বা গারোরা যেভাবে ভাবে না আমি সেভাবে ভাবতে পছন্দ করি বা ভাল লাগে। যেমন, আমি গরিব গারো ভাইবোনদের মুখে মদ ঢেলে দিতে পছন্দ করি না । আবার গারো ভদ্রলোক, ধনীলোক, পয়সাওয়ালারা মদ গিলবে এতে আমি সায় দিই। মন্দ মনে করি না। আমি আবার নিজেকে উপজাতি বা পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠী বলতেও নারাজ। এমনিভাবে আরোও কিছু বিষয় রয়েছে যা বেশিরভাগ গারো ভাইবোনদের সাথে যায় না। আজকে এমন এক বিষয় নিয়ে অল্প আলোচনা করতে চাই।
আমাদের ইদানিংকালের বার্নিং ইসু হচ্ছে ওয়ানগালা। ওয়ানগালা গারো সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। যা শহর, গ্রাম সব জায়গায় ছোট বড় পরিসরে হচ্ছে। এতে শহরের বসবাসকারী আমাদের বিশাল একটা অংশ নিজেদের মাঝে ভাববিনিময় করতে পারছে। সংস্কৃতির মাধ্যমে জানান দিতে পারছে একজন অন্যজনকে। আনন্দের মাধ্যমে নিজেদের খাঁচার মত জীবনের একটা সময় মুক্ত আকাশে কাটাতে পারছে।। বহু মানুষের আগমনে একপ্রকার মিলনমেলার আয়োজন হচ্ছে। ওয়ানগালা গারোদের প্রধান উৎসব এটা মৌলবাদী খ্রিষ্টানরা মানতে চায় না। এদেশের অনেক গারো আছে যারা ক্রিস্টমাসকে গারোদের প্রধান উৎসব মনে করে। যদিও গারোদের মাঝে হিন্দু, বৌদ্ধ, ক্রিস্টিয়ান দেখা যায়। দেখা যায় সাংসারেক, এনিমিস্ট আর নাস্তিক। এই ব্যাপারে অন্য একদিন আলোচনা করা যাবে।

এখন আসুন যারা ওয়ানগালাকে মানে কিন্তু নকমা মহিলারা হবে এমনটি মানে না এই বিষয় নিয়ে কথা বলি। আমাদের জানা প্রয়োজন নকমা শব্দের অর্থ কী? নকমা বলতে সাধারন অর্থে যা বুঝায় তাহলো, ধনী ব্যক্তি। নকমা শব্দের আর একটি বহুল প্রচলিত আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে কোন এক নির্দিষ্ট মাহারীর প্রধান বা আখিং নকমা। যার দায়িত্ব ঐ মাহারীর সকল প্রকার বিচার, সালিশ, সম্পত্তি বণ্টনসহ আরোও কিছু কার্য সম্পাদন যা তার দায়িত্বে থাকে। এটা মূলত একটি মাহারীর সর্ব ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তি। নকমা শব্দের আরোও একটি অর্থ হলো সং নকমা বা গ্রাম প্রধান। যার হাতে ন্যস্ত থাকে গ্রামের সব দায়িত্ব। এটা মুলত স্থানীয় প্রশাসকের কাজ করে। ওয়ানগালায় যে নকমার কথা বলা হচ্ছে তাহলো সং নকমা ও আখিং নকমা।

প্রাচীন ইতিহাসে গারোরা ঐতিহ্যগতভাবে মেনে এসেছে পুরুষরাই নকমা হবে বা হয়েছে।। নারীরা নকমা হয়নি বা দেয়নি হতে। পুরুষরা তাদের পেশিশক্তি দিয়ে সর্বদা নারীদের দমিয়ে রেখেছে, পিষে দিয়েছে। আর একসময় তা প্রথা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। আমরাও তা আমাদের মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌছে দিয়েছি। মস্তিষ্ক থেকে নামানোর কেউ চেষ্টা করেনি হয়তো।

আসুন আগে এই প্রথার ব্যাপারে আলোচনা করি। কিছু মানুষ জন্ম নেয় প্রথাবাদী মগজ নিয়ে, আর কিছু মানুষ জন্ম নেয় প্রথাবিরোধী মগজ নিয়ে। কিছু মানুষের মগজে প্রথাবশ্যতার উপাদান থাকে বেশি, আর কিছু মানুষের মগজে বেশি থাকে প্রথাবিরোধীতার উপাদান। প্রথাবাদী মানুষেরা বিকাশে বিশ্বাস করে না। এই প্রথা কিন্তু আকাশ থেকে পড়ে না, মানুষই সৃষ্টি করে। প্রথাবাদী সমাজে নতুনের উদ্ভব সাধারণত ঘটে না। ঘটলেও তা অচিরেই হয়ে উঠে প্রথা। প্রথা জীবনকে বদলে দেয় না। প্রথাবাদী সমাজ ব্যক্তির মূল্য স্বীকার করে না, তবে প্রথাবাদী সমাজ নিয়ন্ত্রিত হয় কিছু শক্তিমান সুবিধাবাদী ব্যক্তির দ্বারা, যারা পায় অশেষ মূল্য। প্রথাবাদ সুবিধাজনক শুধু সুবিধাভোগীদেদের জন্য, তা অসুবিধা আর সকলের জন্য। যেমন দেখি যে, এদেশের রিসি সম্প্রদায়কে শিক্ষার আলো থেকে দূরে রাখতে চায় এই সুবিধাভোগী মানুষেরা। এতে এই সুবিধাভোগী মানুষেরা এদের দিয়ে সুবিধা ভোগ করে।

এমনিভাবে আমরা দেখতে পাই যে, গারোদের নকমা শুধু পুরুষ হবে, পুরুষ ভিন্ন কেহ হবে না বলে একদল ক্ষমতাবান, প্রথাবাদী বা সুবিধাবাদী মানুষ যুক্তি দেয় প্রথার কথা বলে, ঐতিহ্যের কথা বলে। এদের যুক্তিই মূল উৎস প্রথা বা ঐতিহ্য। আমরা লক্ষ্য করতে পারি যে, আমাদের সমাজের কিছুলোক এই প্রথার কথা বলে সমাজের নারী সমাজকে ফেলে রাখতে চায় আবর্জনার স্তুপে। নারীদের যোগ্যতার মূল্যায়ন করতে চায় না। এই প্রথার কথা বলে আমাদের সমাজের অর্ধেক অংশকে বিশেষ জায়গায় আটকিয়ে দিতে চায়।

আমাদের সমাজকে এগিয়ে নেয়ার জন্য, আমাদের সমাজের মানুষের প্রতিভাকে খুলে দেয়ার জন্য প্রয়োজন প্রথাবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন। আমাদের সবার জানা উচিত, বুঝা উচিত আমরা আর আমাদের সেই অবস্থানে নেই। আমরা আমাদের নকমা প্রথায় বিশ্বাস করি না, নকমা ব্যবস্থা আমাদের সমাজে বিদ্যমান নয়। কিন্তু আমাদের বৃহৎ অংশ যেখানে বসবাস করে সেই মেঘালয়ে এই নকমা প্রথা বিদ্যমান রয়েছে।

শেষ করতে চাই এই বলে, সংস্কৃতি হচ্ছে স্বাধীন মানুষের সৃষ্টিশীলতার বিচিত্র উৎসারণ। সংস্কৃতি নানারূপে বিকশিত হতে পারে। কবিতা, গান, অভিনয়, আঁকাসহ আরোও বিভিন্ন মাধ্যমের দ্বারা। সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের অন্তর সৃষ্টিশীলতার রুপময় প্রকাশ। নিয়ন্ত্রণে সৃষ্টিশীলতা রুগ্ন, বিকৃত হয়। নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে সাংস্কৃতিক অবলুপ্তি। সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে দেয়া উচিত জাতির সহজাত প্রতিভা অনুসারে। লৈঙ্গিক ভিন্নতার কারণে, জৈবিকভাবে, নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। নারী-পুরুষের মধ্যে যে প্রকৃতিগত পার্থক্যের কথা বলা হয় তাও পুরুষতন্ত্রের সৃষ্টি এবং প্রথাভিত্তিক।

কভার ছবি বিরিশিরি সিমসাং আসং ওয়ানগালার নকমা লুদিয়া রুমা সাংমা

ছবি থকবিরিম

 

লেখক পরিচিতি :

দিশন অন্তু রিছিল তরুণ লেখক।  লিখছেন কবিতা-প্রবন্ধ। কাজ করছেন YMCA প্রতিষ্ঠানে।  বিরিশিরি পূর্ব উৎরাইল বাড়ি।  সিমসাং আসং ওয়ানগালার সাথে জড়িত আছেন। ‘ গারো ভাষা, সাংস্কৃতি ও রাজনৈতিক সংকট’ নামে একটি প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হয়েছে।

লেখক দিশন অন্তু রিছিল

 




সম্পাদক : মিঠুন রাকসাম

উপদেষ্টা : মতেন্দ্র মানখিন, থিওফিল নকরেক

যোগাযোগ:  ১৯ মণিপুরিপাড়া, সংসদ এভিনিউ ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। 01787161281, 01575090829

thokbirim281@gmail.com

 

থকবিরিমে প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। Copyright 2020 © Thokbirim.com.

Design by Raytahost