Thokbirim | logo

২৬শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

গারো অঞ্চলে খ্রিষ্ট ধর্মের আগমন ।। পর্ব-৪।। মণীন্দ্রনাথ মারাক

প্রকাশিত : আগস্ট ০১, ২০২০, ১০:৪৮

গারো অঞ্চলে খ্রিষ্ট ধর্মের আগমন  ।। পর্ব-৪।। মণীন্দ্রনাথ মারাক

রেভা. মণীন্দ্রনাথ মারাক গারোজাতিসত্তার একজন পণ্ডিতজন এবং সমাজ চিন্তক। তিনি পুরো জীবনটাই লেখালেখি আর সমাজ ভাবনায় ব্যয় করে যাচ্ছেন। বর্তমানে উনার বয়স প্রায় ৮৫ বছর। রেভা. মণীন্দ্রনাথ মারাকের  ‘ গারো অঞ্চলে খ্রিষ্ট ধর্মের আগমন ’ লেখাটি থকবিরিম পাঠকদের জন্য  লেখকের প্রকাশিতব্য ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’ গ্রন্থ থেকে ধারাবাহিক প্রকাশ করা হচ্ছে। ‘গারো অঞ্চলে খ্রিষ্ট ধর্মের আগমন’ লেখাটির আজ পর্ব-৪ প্রকাশ করা হলো-সম্পাদক।

মণীন্দ্রনাথ মারাক প্রবন্ধ পাঠ করছেন

আর খ্রিষ্টান হওয়ার কথা ঘোষণা করেন। প্রচারক রাম দয়াল সত্যি সত্যি সেগুলো নিয়ে রান্না করে খান। আর ১৮৮১ সনে আগস্ট Rev. Ruprecht Bion ঢাকা থেকে এসে ১৬ জন গারোকে বাইপ্তাইজ করেন। চন্দ্র মোহন, শকুয়া, গোবিন্দ ও লালনকে (কালিচরণ বনোয়ারী) তুরায় প্রশিক্ষণের জন্য পাঠান। ১৮৮২ সনের বর্ষাকালে Rev. Ruprecht Bion ও Rev. T. H. Barmett কংশ নদ দিয়ে জারিয়ার পশ্চিমের গ্রামে নাটেরকোণ থেকে টাট্টঘোড়া ও পালকিতে করে বৃষ্টিতে ভিজে দুপুরের পর বিরিশিরিতে পৌঁছেন। এ সময়ে লোকেরা মাঠে কাজে ব্যস্ত ছিলো। Rev. Ruprecht Bion অসুস্থ ও ক্লান্ত হয়ে পড়েন। Rev. T. H. Barmett নতুন মিশনারি। তাই তিনি লোকদের দেখে রাতেই বাপ্তিষ্ম দানের সিদ্ধান্ত নেন।

১০টায় বাদ্যযন্ত্র বাঁজি করে নদীতে বাপ্তিষ্মের জন্যে যায়। এই বাদ্যযন্ত্র বাঁজানো ও গান করার উদ্দেশ্য ঐ সময়ে বিরিশিরি এলাকা জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিলো। বাদ্যযন্ত্র ও গানের শব্দে জঙ্গলের হিংস্র জন্তুগুলো সরে যায়। আর আশেপাশের লোকেরা শব্দ শুনে বাপ্তিষ্ম দেওয়াটা দেখতে আসে। লোক নদীর তীরে উপস্থিত হয়। ৯ জনকে বাপ্তিষ্ম দিয়ে কীর্তন করতে করতে তাঁরা মিশনে ফিরে আসেন। ১৮৮৩ সনে মিশনে অবস্থানকারী প্রচারক ও কর্মীগণের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ হয়, পাল্টা পাল্টি অভিযোগ হয়, অনৈতিক জীবন যাপন হয়। সাধারণ বিশ্বাসীরা এতে বিশ্বাস ভাঙে এবং গির্জায় আসে না। Rev. Ruprecht Bion মুন্সিগঞ্জের প্রচারক উপেন্দ্র ঘোষের মাধ্যমে গোপন তথ্য সংগ্রহ করে বিরিশিরিতে তাদের তিনি সবচাইতে বেশি অপরাধী প্রচারক দীন বন্ধুকে প্রচারকের অযোগ্য বলে বরখাস্ত করেন, ব্যভিচার দোষে প্রথম গারো খ্রিষ্টান রাধা নাথ ভৌমিক মণ্ডলী থেকে বহিস্কার করেন। গোবিন্দ দারিং, কালি চরণ বনোয়ারী ও আদ্রা দারিংকে শ্রীরামপুরে প্রশিক্ষণে পাঠান।

১৮৮৩ সনের দিকে তিনি ময়মনসিংহ জেলার দায়িত্বভার বরিশাল ব্যাপ্তিস্ট মিশনারি Rev. John Ellision এর হাতে দিয়ে ঢাকায় চলে যান। অস্ট্রেলিয়ার Victorian Foreign Mission তাঁকে ইংল্যান্ডে ব্যাপ্তিস্ট মিশনারি সোসাইটির কাছে চেয়ে নেন, যেন তিনি তার পক্ষে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কারণ তখন অস্ট্রেলিয়ার কোন মিশনারি বঙ্গদেশে ছিলো না। উল্লেখ্য Rev. Ruprecht Bion বিদায় নিয়ে ময়মনসিংহ জেলায় ৫৭ জন খ্রিষ্টান রেখে যান। এর মধ্যে বাঙালি ২০ জন ও গারো খ্রিষ্টান ৩৭ জন । Rev. John Ellision কার্যভার  গ্রহণ করে প্রচারক রাম দয়াল দাস ও গোবিন্দ দারিং কে নিয়ে গারো অঞ্চলের সব চার্চ ও গ্রামগুলো পরিদর্শন করে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে প্রতিকারের ব্যবস্থা করেন। গারো ক্ষেত্রে গারোদেরই কাজ করতে হবে বিবেচনা করে গারো শিক্ষক ও প্রচারক তৈরির লক্ষে ময়মনসিংহে স্কুল খুলেন।

১৮৮৫ সনে উদয় চাঁদ মৃ, কানাই সাংমা (মামান চিসিম), নন্দ কিশোর মারাক (ম্র্রং) ও মিলসিং মারাক এই ৪ জনকে দিয়ে স্কুল আরম্ভ করেন। প্রকাশ থাকে যে, মিলসিং তাঁর গারো নাম পরিবর্তন করতে চান নাই। তিনি বেশির ভাগ সময় ময়মনসিংহ অস্ট্রেলিয়ান মিশনারিদের জন্য ঘরবাড়ি তৈরি করে রাখার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। বিরিশিরি মিশন পূর্ব উৎরাইল থেকে পশ্চিম উৎরাইলে স্থানান্তর করেন। ১৮৮৯ সনে তিনি স্বাস্থ্যগত কারণে পদত্যাগ করেন। ১৮৮৭ সনে অস্ট্রেলিয়ান মহিলা মিশনারি ২জন Miss Fuller, Miss Wilkins ময়মনসিংহ মিশনে আসেন। তাঁরা ময়মনসিংহে প্রথম অস্ট্রেলিয়ান মিশনারি। তাঁরাই মিশনের কাজ, প্রচারের কাজ ও স্কুলের কাজ চালান। বিশেষ করে Miss Fuller গারো ক্ষেত্রে কাজ করেন।

১৮৮৯ সনে রেভা: জয়নাথ চৌধুরীকে মিশনারি করে ক্ষেত্রের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সারা গারো ক্ষেত্রে প্রচারের কাজ জোরদার করা হয়। গারো ও বাঙালি প্রচারক সবাই একসাথে মধুপুর গড়, ভাওয়াল গড়, মুক্তগাছার থানার গ্রামগুলো, পূর্বধলা ও ফুলপুর থানার অনেক গ্রামে প্রচার হয় ও মণ্ডলী স্থাপন করা হয়। নদের উত্তর অঞ্চলেও আরোও নতুন নতুন জায়গায় প্রচার ও মণ্ডলী স্থাপিত হয়। ময়মনসিংহের সহকারী মিশনারি চন্দ্র কুমার, নবকুমার, অভয় দেবনাথ, ঈশান দাস, কালী প্রসন্ন, আলাউদ্দিন খান প্রমুখ প্রচার কাজে সহায়তা করেন। ময়মনসিংহে এক খ্রিষ্টান ভোজে সেখানকার গারো ছাত্ররা অবহেলিত হয়। এর প্রতিবাদে ১৮৯০ সনে পা: কালিচরণ বনোয়ারীর নেতৃত্বে বনগ্রামে সভা করে বনগ্রাম খ্রিষ্টান থেকে পৃথক হয়ে গারো ব্যাপ্টিস্ট ইউনিয়ন গঠন করেন। ১৮৯৩ সনে রেভা: জয়নাথ চৌধুরী বর্তমান বিরিশিরি মিশনে স্থায়ী ভাবে থাকার জন্য আসেন।

গারো ব্যাপ্তিষ্ট ইউনিয়নের প্রশাসনিক ব্যবস্থার ঘোড়াপত্তন করেন। তিনি বিভাগ গঠন, কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠন পালকদের ত্রৈমাসিক সভার ব্যবস্থা করেন। তাঁর সময়ে গারো ব্যাপ্তিস্ট ইউনিয়নের ৭টি বিভাগ গঠিত হয়। বিভাগগুলো হলো বিরিশিরি, আতাচিপা, রঘুনাথপুর, নয়নকান্দি, নলুয়া, সালজান ও শশা।

১৮৯৮ সনে তাঁর স্ত্রী সুশীলা চৌধুরী তাঁর একমাত্র কন্যা আগুনে পুড়ে যাওয়ার শোকে উম্মাদ হয়ে মারা যান। ১৮৯৯ সনে বৃদ্ধ বয়সে শশার মহিম বিশ্বাসের ১৪ বছরের মেয়ে নিশি দফোকে বিবাহ করেন। ঘটনায় মর্মাহত হন এবং  চার্চগুলোতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তাঁদের পরম শ্রদ্ধেয় পুরোহিতের এহেন কর্ম তাঁরা মেনে নিতে পারেন নাই। তাই ইউনিয়নে এই অস্বস্তিকর পরিবেশে তাঁর থাকা সম্ভব নয় বলে ১৯০০ সনে তিনি চার্চ অব ইংল্যান্ডে চলে যান কিন্তু মনে শান্তি ছিলো না। তিনি আবার ফিরে আসেন। কিন্তু পূর্বের ন্যায় গারোদের ভক্তি শ্রদ্ধা পেলেন না। তাই ১৯০১ সনের জানুয়ারিতে  চিরতরের জন্যে চার্চ অব ইংল্যান্ডে চলে যান। তার সঙ্গে শশা, নয়নকান্দি প্রভৃতি মণ্ডলী চার্চ অব ইংল্যান্ডে চলে যান ১৯০২ সনে। P.C.Nall বিরিশিরিতে চলে আসেন। তিনিই প্রথম অস্ট্রেলিয়ান মিশনারি, যিনি স্থায়ীভাবে এখানে থেকে দীর্ঘদিন কাজ করে ১৯২৯ সনে দেশে চলে যান।

কভার ছবি : সংগৃহীত

চলবে…




সম্পাদক : মিঠুন রাকসাম

উপদেষ্টা : মতেন্দ্র মানখিন, থিওফিল নকরেক

যোগাযোগ:  ১৯ মণিপুরিপাড়া, সংসদ এভিনিউ ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। 01787161281, 01575090829

thokbirim281@gmail.com

 

থকবিরিমে প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। Copyright 2020 © Thokbirim.com.

Design by Raytahost