রেভা. মণীন্দ্রনাথ মারাক গারোজাতিসত্তার একজন পণ্ডিতজন এবং সমাজ চিন্তক। তিনি পুরো জীবনটাই লেখালেখি আর সমাজ ভাবনায় ব্যয় করে যাচ্ছেন। বর্তমানে উনার বয়স প্রায় ৮৫ বছর। রেভা. মণীন্দ্রনাথ মারাকের ‘ গারো অঞ্চলে খ্রিষ্ট ধর্মের আগমন ’ লেখাটি থকবিরিম পাঠকদের জন্য লেখকের প্রকাশিতব্য ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’ গ্রন্থ থেকে ধারাবাহিক প্রকাশ করা হচ্ছে। ‘গারো অঞ্চলে খ্রিষ্ট ধর্মের আগমন’ লেখাটির আজ প্রথম পর্ব প্রকাশ করা হলো-সম্পাদক।

লেখক মণীন্দ্রনাথ মারাক
গারো অঞ্চল বর্তমান উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অংশ। প্রাচীনকালে এই অঞ্চলে ছিলো প্রাগ জ্যোতিষপুর। মহাভারতের যুগে এই অঞ্চলে বসবাসকারীদের অধীকাংশই কিরাত জাতি। কিরাতরা ছিলো মঙ্গোলীয় জাতি গোষ্ঠির বোডো লোক। গারোরা এই বোডো শাখার লোক। এই বোডোদের ভাষাকে ব্রিটিশ আমলে ডক্টর গিয়ারসনের ভাষা জরিপে Tebeto Burman (টিবেটু বর্মন) ভাষা গোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ‘চর্যাপদের’ লেখক মি. অতীন্দ্র মজুমদার লিখেছেন-মনু কিরাতরা ‘ক্ষত্রিয়’ বর্ণে উঠিয়ে ছিলেন। কিন্তু কিরাতরা ঠিক মতো হিন্দুরীতি মানতো না, পূজা-পার্বনে ব্রাহ্মণ পুরোহিত নিতো না।
নিজেরা পূজা-পার্বন পরিচালনা করতো। সেজন্য মনু তাদের শুদ্র পর্যায়ে নামিয়ে দেন। পরবর্তী কালে যারা হিন্দু হয়, তাদের আবার পর্যায়ভুক্ত করা হয়, তাদের বলা হয় বর্মণ। A History of Assam পুস্তকে Sir Edward Gait লিখেছেন Barman (Van amour of defense) was common Kshatriya title as such was frequently appropriated by aborigine converts to Hinduism of high rank (page-25) আগেকার দিনে ক্ষত্রিয়রা বুকে বর্ম পরে যুদ্ধ করতেন বলে, আদি হিন্দুদের এই নামটি দেয়া হয়েছে।
এই প্রাগজ্যোতিষপুর রাজ্যের নাম হয় পরবর্তীতে ‘কামরূপ‘। যোগিনীতন্ত্র অনুসারে এই রাজ্যের পশ্চিম সীমা হলো করতোয়া দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র ও শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গমস্থল। এই সীমা অনুসারে বৃহত্তর মযমনসিংহ জেলা ও বৃহত্তর ঢাকা জেলার উত্তর-পূর্ব এই কমরূপ রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিলো। খ্রিষ্টীয় ১৪শ শতাব্দীতে বঙ্গ দেশের মুসলিম শাসনকর্তাগণ এই অঞ্চল দখন করতে থাকে। দখল স্থায়ী করতে আরো সময় লাগে। এই অঞ্চল ছিলো যুদ্ধ বিগ্রহের অঞ্চল। এখানে যুদ্ধ হয়েছে কামরূপীয় রাজাদের সঙ্গে বঙ্গালী মুসলিম শাসনকর্তাদের, কোচ পাঠানদের, কোচ ও অসমিসদের, কোচ ও মোগলদের, মোগল ও অসমিসদের।
শেষে গোহাটির কিছু পশ্চিম পর্যন্ত মোগল ও আসমদের রাজ্য সীমা স্থির হয়। ফলে গোয়ালপাড়া জেলা অঞ্চল বাংলা সুবার (প্রদেশ রংপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীতে ইংরেজদের বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজদৌল্লার যুদ্ধ হয়। পরাজিত হয়ে পরে নিহত হন। ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই আগস্ট ইংরেজ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী দিল্লীর মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আলমের নিকট থেকে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা প্রদানের প্রতিশ্রুতিতে বঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী নিয়ে আসে। এই ইংরেজরা আইনগতভাবে এইসব অঞ্চলের মালিক হয়। ইংরেজরা এই অঞ্চলের মালিক হয়ে দেখতে পান-এই অঞ্চলের কড়ইব মেচপাড়া, কলুমালুপাড়া, হাব্রাঘাট (বিজনীর জমিদারের পরগানা) শেরপুর ও সুসঙ্গ পরগনার জমিদারদের সঙ্গে গারোদের সংঘর্ষ-ঝগড়া-বিবাদ, গন্ডগোল, বনিকদের প্রতারণা ও অন্যায় আচরন। তাই এই অঞ্চলে সব সময়ই অশান্তি বিরাজ করতো।
এই অশান্ত লর্ড কর্নওয়ালিসসের কানে গেলে তিনি ঢাকার কমিশনার Mr. John Eliotকে গারো অঞ্চল পরিদর্শন, তদন্ত ও শান্তি স্থাপনের নির্দেশ দেন। তিনি ১৭৮৮-১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে শীতকালে গারো অঞ্চল পরিদর্শন করে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করেন। তিনি প্রথম ইংরেজ প্রশাসক, যিনি এই অঞ্চলের গারোদের ও অন্যান্য আদিবাসীদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ করেন। তিনি গারো জমিদারদের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করে গেলেও জমিদারদের লোভ ও অত্যাচারের জন্য স্থায়ী হয় নাই। আবার গন্ডগোল ও অশান্তি দেখা দেয়। ফলে এই গারো অঞ্চলের দেখাশোনার ভার ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে রংপুরের কমিশনার Captain David Scott কে দেয়া হয়। এই Captain David Scott ই গারোদের জন্য খ্রিষ্টান মিশনারি ও শিক্ষার জন্য স্কুলের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং চেষ্টা করেন। ইহাই গারোদের খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণের পটভূমি।
Mr. Iscot Marbaniang (মারবানিয়াং) তাঁর Assam In A Nutshell পুস্তকে লিখেছেন, উত্তর-পূর্ব ভারতে অর্থাৎ আসাম অঞ্চলে বৈদিক যুগেই হিন্দু ধর্ম প্রবেশ করতে শুরু করে। ক্রমে ক্রমে এই ধর্ম ও আর্য সংস্কৃতি সমতল ভূমির অধিবাসীদের মধ্যে সম্প্রসারিত হয়। এমন কি আসামের প্রবল পরাক্রমশালী অসম জাতি, যারা ৭শত বছর পরাক্রমের সঙ্গে রাজত্ব করেছে তারাও তাদের নিজেদের শান ধর্ম ত্যাগ করে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে। এভাবে সমতল আদিবাসীরাও ক্রমে ক্রমে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে। তিনি লিখেছেন পাহাড়-পর্বতে বসবাসকারী আদিবাসীরাই তাদের নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষা করতে পেয়েছে।
কারণ পাহাড়-পর্বতে পুরোহিত ব্রাহ্মণদের প্রবেশ সহজ সাধ্য ছিলো না। তারা ব্রাহ্মণদের সংস্রব থেকে দূরে পৃথক থাকতে পেরেছে বলে নিজস্ব ধর্ম সংস্কৃতি রক্ষা করতে পেরেছে। তাই পাগাকড়ী গারোরাও তাদের সনাতন ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষা করতে পেরেছে। সমতল ভূমির গারোদের মধ্যে কেউ কেউ হিন্দু হয়েছে, কেউ কেউ অর্ধ হিন্দু হয়েছে, বাকী যারা ছিলো, তারাও হিন্দু সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।
১৬শ খ্রিষ্টীয় শতাব্দীতে কোচ রাজা নরনারায়নের সময়ে বৈষ্ণব ধর্মের সংস্কৃারক ও প্রচার শংকর দেব কোচবিহার ও আসামে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন। তিনি অহিন্দুদের মধ্যে পাঁচ জনকে তার শিষ্য করে নেন। তারা হলেন-১) জয়হরি আতই (মুসলিম), ২) চন্দসি আতই, ৩) গোবিন্দ আতই (গারো), ৪) বলাই আতই (মিকির) ও ৫) রাম আতই (কাছারী)- Studies in the History of Assam লেখক সূর্যকুমার ভূঞা, পৃ:৮,৩৭,৫৫। এতে দেখা যায়, শংকর দেবের এক গারো শিষ্য গোবিন্দ আতই। শিষ্য যখন ছিলো, তাতে ধরে নেওয়া যায় তার প্রভাবে অনেক গারো বৈষ্ণব হিন্দু হয়ে গিয়েছিলো। বঙ্গ দেশের সমতল ভূমির অনেক গারো হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে বৈষ্ণব হয়েছে। তেলুজিয়া, হাতিবান্দা, হোগলা, ঢাকুয়া, জলছত্র এলকার গারোরা হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছে। তারা গুরুচরণ সিমসাং এর নেতৃত্বে সনাতন ধর্ম গ্রহণ করেছে এবং গারো পরিচয় না দিয়ে বর্মন বলে পরিচয় দিচ্ছে।
অনেক গারো হিন্দু না হলেও হিন্দু প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে দূর থেকে আসলে “রাম রাম” বলে বসতো “হরি বল, হরি বল” বলে উঠতো। ঝড়-তুফান আসলে, ভূমিকম্প হলে হরি বল, হরি বল বলে চিৎকার করতো। কোনো কোনো গ্রামের গারোরা দল বেধে রাম মঙ্গলের গান-“কি আনন্দ হলো, গতি নাই রাম নাম বিনে। তোরা জয় দে, জয় দে শ্রীরামের নামে, গতি নাই আর রাম নাম বিনে” গেয়ে বেড়াতো।
কোনো কোনো গ্রামের গারোরা দ্বিপান্বিতার সময়ে রামায়ন ও চন্ডী মঙ্গলের গান গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরতো। এইতো ছিলো সমতল ভূমির গারোদের অবস্থা। আমার নিজের নাম-মনীন্দ্র, এই নাম গারো নাম নয়, এই নাম হিন্দু সংস্কৃতির। আর কত গারো নরনারী হিন্দু-সংস্কৃতির নাম ধারণ করে চলেছে তা বলাই বাহুল্য।
গারোদের উপর হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব দেখেই Captain David Scott গারোদের স্বকীয় বৈশিষ্ট ও জাতীয় রক্ষার জন্য খ্রিষ্টান মিশনারি গারোদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করতে চান এবং তিনি হিন্দুদের প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য তৎকালীন State Secretary কে পত্র লিখেন। তিনি তার কাছে অনুমতি চান, যেন তিনি এ ব্যাপারে মিশনারিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আর Mr. W.B. Bayley সদয় হয়ে কলকাতার চার্চ অব ইংল্যান্ডের মিশন রেজিনাল্ড হেবাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেন। Captain David Scott আবেদন পত্রে উল্লেখ করেন-গারোদের খ্রিষ্টান বানাতে না পারলে তারা হারিয়ে যাবে, হিন্দু হয়ে যাবে, অথবা অর্ধ হিন্দু হয়ে যাবে।
চলবে…
আরো লেখা
গারো অঞ্চলে খ্রিষ্ট ধর্মের আগমন ।। শেষ পর্ব ।। মণীন্দ্রনাথ মারাক
সংস্কৃতি সংরক্ষণে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জানার প্রয়োজনীয়তা ।। পর্ব-১ ।। মণীন্দ্রনাথ মারাক
সংস্কৃতি সংরক্ষণে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জানার প্রয়োজনীয়তা ।। পর্ব-২ ।। মণীন্দ্রনাথ মারাক
সংস্কৃতি সংরক্ষণে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জানার প্রয়োজনীয়তা ।। পর্ব-৩ ।। মণীন্দ্রনাথ মারাক
গারো জাতিসত্তার উজ্জ্বল নক্ষত্র রেভা. মণীন্দ্রনাথ মারাক ।। নীলু রুরাম
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত
-
রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর উৎসব ওয়ানগালা
: রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও...
-
আজ লেখক ও চিন্তক আলবার্ট মানকিন-এর স্মরণসভা ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান
: মধুপুর গড়াঞ্চলের আদিবাসী নেতা, চিন্তাবিদ, লেখক, সমাজকর্মী, এনজিও কর্মী আলবাট...
-
গুলশান বনানী ওয়ানগালা ২১ অক্টোবর শনিবার
: গুলশান বনানী ওয়ানগালা ২১ অক্টোবর শনিবার আদি সাংসারেক গারো জাতিগোষ্ঠীর...
-
১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ...
-
রে রে : হায়রে আমার কাঞ্জিয়া ।। নীলু রুরাম
: সমর সাংমার রেরে নিয়েই শুরু করি তবে একটু আলাদা। আমাদের...
-
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিরাপদ ব্যবহার ।। জাডিল মৃ
: এক. সময় স্রোতের সাথে আবাহমান ছুটে চলা প্রযুক্তির উন্নতি, মানব...
‘রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর উৎসব ওয়ানগালা’
: রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও......বিস্তারিত
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত