Thokbirim | logo

১৪ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | ২৯শে নভেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় জাতের ধান- হেমারসন চিরান

প্রকাশিত : জুলাই ২০, ২০২০, ২০:৩৫

হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় জাতের ধান- হেমারসন চিরান

এই পলি মাটিতে ধান বীজ বুনলে প্রচুর ধান হয়। হাজার বছর ধরে মাথার যাম পায়ে ফেলে এই দেশে কৃষক ধান চাষ করছে। এই ধান আমাদের প্রধান খাদ্য শস্য, আমাদের সম্পদ। লোকগীতি গানে আছে –

ধান যার মান তার,

ধান মোদের গর্ব,

ধান মোদের মান,

ধান দিয়ে ভরবো গোলা,

দেশ বাঁচার প্রাণ।

এই ধানের ভাত খেয়ে সারা বাংলাদেশের মানুষ জীবন যাপন করে আসছে। ধান বাংলাদেশর মানুষের প্রধান খাদ্য শস্য।  ধানের বীজকে একসময় কৃষকেরা নিজ হাতে বাছাই করতো। তখন ছিলো নানা জাতের সুন্দর সুগন্ধি দেশীয় উন্নত মানের ধান। এর মধ্যে যে ধানগুলো ছিলো যেমন-পুড়াবিন্নি, বিন্নি, হালই, কালিজিরা, মালতি, গুইয়ামুড়ি, চাপাল, কালি বোরো, জাগলি, জিগাশাল, হলদি জাওন, পোড়াগিন্ন, পানিশাল, ডেপা, মেই, পঙ্খিরাজ, চিনির শাইল, রতিশাইল, কাতিশাইল ইত্যাদি। তখনকার সময়ে এ ধানগুলো দিয়েই জমি ভরা ধান চাষ করতো। সে সময়গুলোতে মাটি বেশ উর্বর ছিলো। এর কারণও ছিলো। তখনকার সময় কোনো প্রকার ইউরিয়া সার বা কীটনাশক ঔষধ ব্যবহার করা হতো না। পঁচা গোবরের জৈবসার, কেঁচো সার, কম্পোজ সার ব্যবহার করা হত।তখনকার সময় এক কৃষক আরেক কৃসষককে পরামর্শ ও সহযোগিতা করতো।যেমন- কোনো কৃষকের জমিতে যদি ভালো মানের ধান ফলন হতো তাহলে সব কৃষকেরা উক্ত জমি হতে ভালো মানের ধান বীজ সংগ্রহ করতো। তাছাড়া ধানের চারা সংগ্রহে ঐক্য ছিলো। চারাগুলো এক জায়গা থেকে বিভিন্ন জায়গায় হস্তান্তরিত হতো। সেসময় দেশীয় জাতের ধানগুলোয় ব্রেডিং করে নানা প্রকারের ধান উদ্ভাবন করেছে। এই জাতের ধানগুলো একসময় আমাদের হাতেই সংরক্ষণ থাকতো। আমরাই সংরক্ষণের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়েছিলাম।

কিন্তু বর্তমান সময়ে ধান চাষের জন্য মাটিগুলো খুব একটা উর্বর নয়। জমিতে প্রচুর পরিমাণে ইউরিয়া সার ও কীটনাশক ঔষধ প্রয়োগের ফলে মাটির আর কার্যকারিতা নেই। সার, কীটনাশক ঔষধের উপর নির্ভর করেই ধান চাষ করছে। তাছাড়া বর্তমান সময়ে খুবই দুঃখজনক হলো, দেশীয় জাতের ধানগুলো ইউরিয়া সারের প্রভাবে অধিক  ফলনের আশা করতে পারছে না। তাছাড়া বিভিন্ন জাতের হাইব্রিড উচ্চ ফলনশীল ধান বাজার থেকে আমদানি করে অধিক ফলন উৎপাদন করছে। ফলে আমাদের দেশীয় জাতের ধানগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে।

হারিয়ে যাওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে বিভিন্ন ধরনের হাইব্রিড জাতের ধান ভালো ফলন দিচ্ছে।  ফলে কৃষকরা এই জাতের ধানগুলো চাষ করা শুরু করে দিয়েছে। এতে করে দেশীয় জাতের ধান চাষ করতে অনীহা প্রকাশ করছে। ফলে হারিয়ে যেতে বসছে দেশীয় জাতের ধানগুলো। এটা দেশের সাধারণ মানুষ ও কৃষকদের কাছে খুবই দুঃখের ব্যাপারও বটে।

হেমারসন চিরান

হারানোর আরো কারণ আছে, এর মধ্যে হল- বাজার থেকে উচ্চ ফলনশীল ধান আমদানি করার ফলে দেশীয় ধানের বীজ সংরক্ষণ ও রোপন করতে ভুলে গেছে।বর্তমানে কৃষক মনে করছে  উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড ধানে যদি পাঁচ শতাংশে ৩ থেকে চার মণ ধান উৎপাদন করে  এক্ষেত্রে দেশীয় জাতের ধান উৎপাদন হচ্ছে ১ থেকে ২ মণ সর্বোচ্চ ৩ মণ।সেক্ষেত্রে হাইব্রিড ধানের দিকে ঝুঁকে পড়ছে কৃষকরা। আবার এদিকে হাইব্রিড ধান আমদানি করে পুনরায় নিজ হাতে বীজ সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আবার সংরক্ষিত হাইব্রিড বীজগুলো সঠিক সংরক্ষণের জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবে ভালো ফলন দিচ্ছে না। যার ফলে বাজারের হাইব্রিড ধানের আশায় রয়েছে অসংখ্য কৃষক। কারণ হাতে তাদের দেশীয় জাতের ধান সংরক্ষণে নেই বললেই চলে।’ কথাগুলো বলছিলেন হেমারসন চিরান।

বর্তমান সময়ে কৃষক ভাইদের প্রতি আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, আসুন কৃষক ভাইয়েরা আমরা আর কতদিন পরনির্ভরশীল হয়ে ধান চাষ করবো। হাইব্রিড ধান বাজারে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষাকেইতো পরনির্ভরশীলতা বলে। আজকে নিজের ঘরে যদি দেশীয় জাতের ধান বীজ থাকতো তাহলে বাজারের আমদানিকৃত ধানের জন্য অপেক্ষা করতে হতো না’

কৃষক ভাইদের আহবান জানিয়ে তিনি আরো বলেন- ভালো জাতের দেশীয় বীজ সংরক্ষণ করি।৷ কৃষক ভাইরা, কীভাবে বীজ সংরক্ষণ করে রাখলে ভালো ফসল উৎপাদন করতে পারবো, কীভাবে ঘরে রাখতে হবে। এই জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য স্থানীয় কৃষি অধিদপ্তর ও কোনো অভিজ্ঞ কৃষকের কাছে থেকে জানা জরুরি। বাজারের আমদানিকৃত ধান চাষ করা বন্ধ করি।

করণীয়

দেশীয় জাতের ধান চাষের ক্ষেত্রে জৈবসার, কম্পোস সার, কেঁচো সার মাটিতে মিশিয়ে প্রয়োজনীয় পানির ব্যবস্থা করে দেশীয় ধানের  ফসল উৎপাদন করে পর্যাপ্ত ধান পাওয়া যায়। এতে জমি ও মাটির কোনো ক্ষতি হয় না। বাজারে আমদানিকৃত হাইব্রিড ধান চাষ করলে নানান রকমের ইউরিয়া সার ও কীটনাশক ঔষধ ব্যবহার করতে হয়।  এতে মাটির উর্বরতা কমে ও প্রাকৃতিক পরিবেশ, বাতাস দূষিত হয়। যার ফলে পরিবেশের উপর ক্ষতির প্রভাব ফেলতে পারে। আমাদের কৃষক ভাইদের কাছে ও বাজারে দেশীয় সুগন্ধি জাতের অনেক ধান আছে। তারা ইচ্ছা করলে চাষ করতে পারে। কিন্তু হাইব্রিড জাতের ধান চাষ করে অধিক ফলনের লোভে। তারা বুঝতে পারছে না দেশীয় জাতের ধান বীজগুলো যদি জৈব উপায়ে চাষ করা হয় তাহলে অনেক কৃষকই লাভবান হতে পারে। সেই সাথে দেশের হারিয়ে যাওয়া ধান গলোর অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবো।

দেশীয় জাতের ধান উৎপাদন ও সংরক্ষণ কিছু উপায় সমূহ :

১. জৈব উপায়ে ধান উৎপাদনের কৌশল উদ্ভাবন করি।

২.জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করি। যেগুলো ধানের উপকার করে থাকে।

৩. জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য জৈব সার, কম্পোস সার, কেঁচো সার প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদন করি।

৪.দেশীয় জাতের ধান ব্রিডিং করি।

৫. দেশীয় জাতের ধান বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ করি।

হেমারসন চিরান এর পরিচিতি :

হেমারসন -১,২,৩ ধানের উদ্ভাবক হেমারসন চিরান ধোবাউড়ার কৃতি সন্তান। হেমারসন চিরান ধোবাউড়া উপজেলা কালিদহকান্দা গ্রামের একজন কৃষক। ৫ম শ্রেণি পাশ করা হেমারসন চিরান কীভাবে একজন বিজ্ঞানীর ন্যায় নতুন ধান আবিষ্কার করলেন তা সাধারনভাবে চিন্তা করা যায় না। কারণ এ পর্যন্ত কৃষক পর্যায়ে নতুন ধানের আবিষ্কার বিরল। একমাত্র আন্তরিক চাওয়া এবং নিরলস প্রচেষ্টার কারণেই তিনি আজ একজন দক্ষ কৃষক হিসাবে এলাকাতে নাম কুড়িয়েছেন। তার উদ্ভাবিত নতুন জাতগুলো ধোবাউড়া এলাকা ছেড়ে কৃষক পর্যায়ে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। স্হানীয় বাজারগুলোতে এ ধানগুলো  কোথাও সংকর নামেও পরিচিত পাচ্ছে।

হেমারসন চিরান তার নিজ প্রচেষ্টায় অন্যদের বাড়িতে শ্রম বিক্রি করে সম্পদ ক্রয় করেছিলেন প্রায় ৬.০০ একর জমি। ছোটোবেলা থেকেই তিনি অন্যের বাড়িতে কৃষি কাজ করতেন। কৃষি কাজের প্রতি আগ্রহ এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের ফলে তার মধ্যে জন্ম নেয় কৃষির গুরুত্ব এবং কৃষি কাজের প্রতি ভালোবাসা।

হেমারসন চিরান প্রতিবছর লক্ষ্য করতেন তার ধানের জমিতে কিছু কিছু ধান অন্যান্য ধান থেকে আলাদা এবং অন্যান্যদের থেকেও ফলন ভালো। তিনি চিন্তা করতেন এমন হলো কেনো? তিনি আবার বাছাই করে নির্যাস বীজ রাখার চেষ্টা করতেন কিন্তু পরবর্তী বছরেও একই অবস্থা। তাই তিনি সমাধান পাওয়ার জন্য বিভিন্ন জনের সাথে আলাপ আলোচনা করলেন কিন্তু সমাধান না পেয়ে ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি পার্শ্ববর্তী গ্রাম ধাইরপাড়ায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন এবং দেখতে পেলেন মি.মতিন্দ্র মানখিনের বাড়িতে অনেক কৃষক জমায়েত হয়ে আলোচনা করছেন।

তিনিও সেখানে গেলেন এবং দেখতে পেলেন কারিতাস বাংলাদেশ, ময়মনসিংহ আঞ্চলিক অফিস থেকে আগত মো.সিরাজুল হক ধানের কথা এবং কৃষকের সমস্যার কথা বলছেন। হেমারসন চিরান কৌতুহল বসত তা দেখার জন্য গেলেন এবং মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনলেন। তাছাড়া ধানের ব্রিডিং সম্পর্কে প্রথম তিনি জানতে পারেন ধোবাউড়ার কৃষক মতিন্দ্র মানখিন এর কাছ থেকে। মতিন্দ্র মানখিন ও   কারিতাস আইসিডিপি অধীনে ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে কৃষক ও কৃষি অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরে ফিলিপাইন যান এবং সেখানে কৃষক পরিচালিত সংস্থা Macipag ( Farmers Scientists Association For Development)  কৃষকদের কাছ থেকে ধানের ব্রিডিং এর উপর প্রশিক্ষণ লাভ করেন।

২০০৭ খ্রিস্টাব্দে হেমারসন চিরান মতিন্দ্র মানখিনের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পেয়ে ও পরবর্তীতে   তিনিও ব্রিডিং এর উপর ফিলিপাইনের কৃষকদের নিকট প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ধানের ব্রিডিং এ কঠিন  মনোনিবেশ ও সাধনার পরে তিনি ১০টি জাতের ধান গবেষণা করে হেমারসন-১, হেমারসন-২, হেমারসন-৩ ধানের উদ্ভাবন করেন। তার নতুন ধান উদ্ভাবনের পরেই ধোবাউড়ার  উওরা আঞ্চলে ও সারা দেশের বিভিন্ন আঞ্চলে ধানে বাম্পার ফলন হওয়াতে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। তার উদ্ভাবিত ধান ১৩৭ দিনের মধ্যে বীজ বপন থেকে ফল সংগ্রহ করা যায় তাছাড়া প্রতি একরে ৪২ মন করে উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে।

বিশেষ প্রতিবেদক : তেনজিং ডিব্রা

 

 

 




সম্পাদক : মিঠুন রাকসাম

উপদেষ্টা : মতেন্দ্র মানখিন, থিওফিল নকরেক

যোগাযোগ:  ১৯ মণিপুরিপাড়া, সংসদ এভিনিউ ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। 01787161281, 01575090829

thokbirim281@gmail.com

 

থকবিরিমে প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। Copyright 2020 © Thokbirim.com.

Design by Raytahost