পূর্বে প্রকাশের পর…
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর ত্রিহুত অভিযানকালে উত্তর বঙ্গে মেচ, ও থরু বা থারু অধিবাসীদের সাক্ষাৎ পাইয়া ছিলেন। গারোদের গল্পকাহিনি ইত্যাদিতে জানা যায় যে, এককালে গারোরা কোচবিহার ও রংপুর এলাকাতেও বসবাস ও রাজত্ব করিয়াছিল। এই থরু বা থারু গারু বা গারো নামের অপভ্রংশ হইতে পারে। বর্তমানে উপমহাদেশের কোনো দেশেই আদিবাসীদের নামের তালিকায় থরু বা থারু জাতির উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় না। এই থরু বা থারু হয়ত হিন্দু অথবা মুসলিম সমাজে মিশিয়া গিয়াছে এবং যাহারা ঐ দুই সমাজে মিশিয়া যায় নাই তাহারা অন্যত্র মরিয়া গিয়া স্¦জাতিদের সঙ্গে সংযুক্ত হইয়াছে।
আগেই বলিয়াছি এই উপমহাদেশের আদিবাসীদের নাম অন্যদের দেওয়া। তবু যে কোনো জাতির নাম সম্বন্ধে জল্পনা, কল্পনার সীমা নাই। গারো নামের উৎপত্তি সম্বন্ধেও নানা অভিমত দেখা যায়। এই নানা অভিমত গারোদেরই অভিমত। নিম্নে এই অভিমতগুলির বর্ণনা করা হইল।
গারোদের কথকথা হইতে জানা যায় যে, গারোরা এই উপমহাদেশের আসিবার আগে তিব্বতের গারু নামক এলাকায় (কেউ কেউ বলে প্রদেশ) বসবাস করিয়াছিল। এই এলাকা হইতেই তাহারা এই উপমহাদেশে আসিয়াছে। কিন্তু গারোরা নিজেদের পূর্ব আবাসভূমির কথা ভুলিতে পারে নাই। তাই তাহারা নূতন দেশে আসিয়াও পূর্ব আবাসভূমির স্মরণে নিজেদের গারো বলিয়া পরিচয় দিতো।

গারো নারী
সেই সময় হইতেই এই জাতি গারো নামে পরিচিত হইয়া আসিতেছে। যাহা হউক তিব্বতের গারু নামে কোনো প্রদেশ আছে কিনা জানি না। তবে গারটকও গিয়ারুং বলিয়া দুইটি বিখ্যাত স্থান এখনও তিব্বতে আছে। তিব্বতের মানচিত্রে এই দুইটি স্থানের অবস্থান দেখা যায়। গারোরা তিব্বতের ঐ স্থানগুলিতে পূর্বে বসবাস বা রাজত্ব করিয়াছিল কিনা তাহা গবেষণা সাপেক্ষ।
কেহ কেহ বলে ‘গারু’ নামক গারোদের এক নেতা ছিলেন। তাহার নাম অনুসারে এই জাতির নাম হইয়াছে গারো। কিন্তু গারু নামে কোনো গারো নেতার নাম তিব্বত হইতে এই উপমহাদেশে আগমনকালে দলের নেতৃত্বদানের কথা, কথকথাগুলিতে শুনিতে পাওয়া যায় না। কিন্তু গারোদের সৃষ্টি ও মানব কাহিনিতে মিগাম গাইরিফার নাম শুনিতে পাওয়া যায়। গারোদের বিশ^াস অনুসারে তিনিই পৃথিবীর প্রথম মানুষ যিনি সর্ব প্রথম ঐশ^রিক বিধি লঙ্ঘনের ফলে মৃত্যু বরণ করেন। গারোদের এই প্রথম মৃত নেতা মিগাম গাইরিফার নাম হইতে গারো নামের উৎপত্তি হইয়াছে কিনা তাহাও সঠিকভাবে জানা যায় না।

গারো তরুণী
অন্যমতে গারোদের একদল তিব্বত হইতে হিমলয় পর্ব্বত অতিক্রম করিয়া বর্তমান উত্তর প্রদেশের কুমায়ুন বিভাগের গারোয়াল জেলায় বসতি স্থাপন করিয়াছিল।
মি. ডি. এম রংমুথু তাহার “আফাকো গিসিক রা’আনিও” পুস্তকে লিখিয়াছেন : ‘চেং’ও আ’চিক ফা–গিৎচামরাং আসং তিবেতনি জা রেবা’এ জা’নেংথাকোন্ বিও গারোয়ালনি। মাৎবিগিলো মেগিমিনখো, আচিক জাতদে মং’এ ছাজক মান জায়ে আদাল। অর্থাৎ : পূর্বে আচিকদের (গারোদের) পূর্ব পুরুষগণ তিব্বত দেশে ছিল। সেখান হইতে তাহারা গারোয়াল পাহাড়ে আসিয়া কিছুকাল বসবাস করে। ঐ স্থানে বসবাস কালে গারোরা দুর্ভীক্ষের কবলে পড়িয়া অভাবের তাড়নায় মহিষের চর্মে লিখিত সনদপত্র পুস্তক সাহিত্য সব খাইয়া ফেলে। এই গারোয়াল স্থান হইতে গারো নাম উৎপত্তি হইয়াছে। এই উক্তি কতটুকু সত্য তাহা গবেষণা করিয়া দেখিবার বিষয়। তবে ঐ স্থান এখনোও ঐ নামেই পরিচিত হইয়া আছে। সেখানে এখন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করে এবং নিজেদের গোরায়ালী বলে পরিচয় দেয়।

আদি গারোদের সাংসারেক ধর্মানুসারে আমুয়া( প্রার্থনা) করা হচ্ছে।
গারোদের কথা ও কাহিনি হইতে আরও জানা যায় যে, প্রাচীনকালে সঙ্গল নামে এক গারো রাজা বাংলার প্রাচীন রাজধানী গৌড়ে রাজত্ব করিয়াছিলেন। প্রায় অধিকাংশ মুসলিম ঐতিহাসিকগণ ফিরিস্তা, মিনহাজ উদ্দিন সিরাজ, গোলাম হোসান সলীম প্রমুখ এবং ইংরেজ ঐতিহাসিক এডুয়ার্ড গেইট এই সঙ্গল বা সঙ্গলদিকের রাজত্বের কথা স্বীকার করিয়াছেন। এই সঙ্গল রাজার রাজধানী ‘গৌড়’ হইতেই গারো নামের উদ্ভব হইয়াছে। এই বিষয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা করিলে হয়তো আরও তথ্যাদি পাওয়া যাইতে পারে।
গারোদের মধ্যে আবার কেহ কেহ বলিয়া থাকে ‘তুরার’ পূর্ব নাম ছিল ‘দুরা’, ‘দুরা’ হইল শক্তির দেবতা। এই তুরা ছিল দুরা দেবতার বাসভূমি। দুরার অপর নাম গয়রা। এই গয়রা দেবতার নাম হইতেই গারো নামের উৎপত্তি হইয়াছে। ১৯৬৫ সনের মে মাসে প্রকাশিত “যোজনা পত্রিকায় ” মি. বি. সি. নাথ গারোদের কশ্যপমুনির ঔরষে ও বিনতার গর্ভজাত ‘গরুড়’ পক্ষী বংশধর বলিয়াছেন। এই ‘গরুড়’ পক্ষীর নাম হইতেই ‘গারো’ নাম আসিয়াছে। কিন্তু গারোদের মধ্যে কেউই এই মতবাদ বিশ^াস করে না।
আবার কাহারও কাহারও মতে গারোদের মধ্যে গারা– গানচিং বলিয়া একটা উপদল আছে। গারো নাম এই গানচিং হইতে আসিয়াছে। এই উপদলটি নিতাই ও সোমেশ^রী নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় বসবাস করে। অনেকের ধারনা বাঙালি ও বিদেশিরা সর্ব প্রথমে এইদিক দিয়া গারোদের সংস্পর্শে আসে এবং তাহাদের জাত পরিচয় ‘গারা গানচিং’ হইতে শুধু ‘গারা’ শব্দ ব্যবহার করে। কালে এই ‘গারা’ শব্দ ‘গারো’ শব্দে রূপান্তরিত হয়। এই মতবাদ কতটুকু সত্য তাহাও নির্বিবাদে মানিয়া লওয়া যায় না। কারণ, গারোদের সঙ্গে বাঙালি ও বিদেশিদের পরিচয় শুধু মৈমনসিংহের দিক দিয়াই হয় নাই। বহুকাল পূর্বেই আসামের সমভূমির দিক দিয়াও অনেকে গারোদের পরিচয় পাইয়াছিল।

সাংসারেক ধর্মের খামাল/কামাল জনিক নকরেক। বাড়ি মধুপুরের চুনিয়া গ্রাম।
তবে ‘গারো’ নাম বিজাতিদের দেওয়া নাম বলিয়া আমিও মনে করি। গারোদের জন্য এই নাম খুব সম্ভব ব্যাঙ্গ করিয়াই দেওয়া হইয়াছে। কারণ অতীতে গারোরা সমভূমিতে বিজাতীদের সঙ্গে অনেক যুদ্ধবিগ্রহ করিয়াছে। যাহারা নূতন নূতন রাজ্য বিস্তারের আশায়, এই এলাকায় অভিযান চালাইয়াছে। তাহাদের সঙ্গে গারোদের অনেক সংঘর্ষ হইয়াছে। এমনকি কোনো এক বিশেষ রাজার সঙ্গে তাহাদের বার বার যুদ্ধ করিতে হইয়াছে। এই সমস্ত যুদ্ধ বিগ্রহ কোনো কোনো যুদ্ধে বিজাতিরা জিতিয়াছে এবং কোনো কোনো যুদ্ধে গারোরা জিতিয়াছে। এই সমস্ত যুদ্ধ বিগ্রহের কথা গারোদের গল্প কাহিনিগুলি হইতে জানা যায়। গারোবাধা, বাঙাল কাটা, গারোমারী প্রভৃতি স্থানের নাম যুদ্ধ বিগ্রহ হইতেই উদ্ভব হইয়াছে। খুব সম্ভব বার বার অভিযোগ, অভিযান এবং যুদ্ধ করিয়াও গারোদের সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত করিতে কিংবা যুদ্ধ হইতে বিরত রাখিতে না পারায় গারোরা বড় “ঘাড়শক্ত” চলিত ভাষায় ‘ঘাড়ুয়া’, ‘গারুয়া’ ইত্যাদি শব্দ ব্যাঙ্গ করিয়া বলা হইতেই বর্তমান ‘গারো’ নামটি আসিয়াছে। সুতরাং বলা যায় ‘গারো’ নামটি একটি ব্যাঙ্গ নাম।
গারোরা নিজেদের অন্যজাতি হইতে পৃথক ভাবিয়া থাকে। তাই তাহারা নিজেদের বলিয়া থাকে মান্দে, অর্থাৎ মানুষ এবং অন্যদের ক্ষেত্রে উল্লেখ করে জাতির নাম। মান্দাইরাও হয়তো এককালে গারোই ছিল। কারণ মান্দে ও মান্দাই শব্দদ্বয়ের অর্থ একই মানুষ। তাছাড়াও গারোদের মধ্যে মান্দা নামে একটি মাতৃ মাহারি আছে। বর্তমানে যাহারা মান্দাই বলিয়া পরিচিত তাহারা হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত হইয়া রহিয়াছে। অতীতে কোনো না কোনো রাজতৈনিক কারণে হয়তো তাহারা এইভাবে বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছে।
গারোরা অন্যদের নিকট গারো জাতি বলিয়া পরিচিত হইলেও তাহারা নিজেদের আচিক জাতি বলিয়া থাকে। আচিক শব্দের অর্থ টিলা, সাধারণ অর্থে পাহাড়। সুতরাং আচিক জাতির অর্থ পাহাড়ি বা পার্বত্য জাতি গারো নহে। সুতরাং কোনো জাতি বিশেষের জন্য সাধারণ বা সর্বজনীন নাম দেওয়া ঠিক নহে। সেই জন্য গারোদের নিজেদের আচিক বা পাহাড়ি জাতি বলা যুক্তিযুক্ত হয় নাই। ব্যাঙ্গ হইলেও অন্যদের দেওয়া এই গারো নামই গারোদের জন্য যুক্তিযুক্ত হইয়াছে।

থক্কা চিহ্ন
যে জাতি রামায়ন, মহাভারত, কালিকা–পূরাণ ও যোগিনী তন্ত্রে ‘কিরাত’ জাতি বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে, তাহারাই এখন গারো নামে পরিচিত হইতেছে। অবশ্য শুধু গারোরাই কিরাত জাতির অন্তর্ভুক্ত ছিল না, অত্রাঞ্চলের অন্যান্য পাহাড়ি জাতিও কিরাত জাতির অন্তর্ভুক্ত ছিল। সমস্ত জাতিকেই অর্থাৎ কাছারী, লুসাই, নাগা প্রভৃতিকে গারোই বলিত। পরে তাহাদের পৃথক পৃথক নামে বই পুস্তকে লেখা হয়। এখন গারো বলিতে শুধু গারোদেরকেই বুঝান হয়। বর্তমানে নব গঠিত মেঘালয় রাজ্যের গারো হিলস জেলা পত্তনকালে এই জেলার নাম রাখা হয় গারোয়ানা। পরবর্তীকালে নাম পরিবর্তিত করিয়া জেলার নাম দেয় গারো হিলস। এই জেলা গঠনের পূর্বে গারো হিলসের চতুর্দিকে সুনির্দিষ্ট কোনো সীমারেখা ছিল না।
গারো হিলসের লোকেরা সাধারণত: গারো বলিয়া পরিচিত। কিন্তু ইহার বাহিরে পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরারাজ্য, বাংলাদেশেও গারো রহিয়াছে। জাতি হিসাবে তাহারা সকলেই এক এবং সর্বত্রই গারো নামেই পরিচিত। আর এই পরিচিতই এখন তাহাদের আসল পরিচয়।
সমাপ্ত।

মণীন্দ্রনাথ মারাক। লেখক গারো সম্প্রদায়ের একজন জ্ঞানতাপস, পণ্ডিত ব্যক্তি।
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত
-
রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর উৎসব ওয়ানগালা
: রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও...
-
আজ লেখক ও চিন্তক আলবার্ট মানকিন-এর স্মরণসভা ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান
: মধুপুর গড়াঞ্চলের আদিবাসী নেতা, চিন্তাবিদ, লেখক, সমাজকর্মী, এনজিও কর্মী আলবাট...
-
গুলশান বনানী ওয়ানগালা ২১ অক্টোবর শনিবার
: গুলশান বনানী ওয়ানগালা ২১ অক্টোবর শনিবার আদি সাংসারেক গারো জাতিগোষ্ঠীর...
-
১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ...
-
রে রে : হায়রে আমার কাঞ্জিয়া ।। নীলু রুরাম
: সমর সাংমার রেরে নিয়েই শুরু করি তবে একটু আলাদা। আমাদের...
-
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিরাপদ ব্যবহার ।। জাডিল মৃ
: এক. সময় স্রোতের সাথে আবাহমান ছুটে চলা প্রযুক্তির উন্নতি, মানব...
‘রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর উৎসব ওয়ানগালা’
: রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও......বিস্তারিত
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত