Thokbirim | logo

২৫শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | ১০ই ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

বাজেটে সমতলের আদিবাসীদের জন্য মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বরাদ্দ চাই।।  সোহেল হাজং

প্রকাশিত : জুন ১২, ২০২০, ০১:৩৪

বাজেটে সমতলের আদিবাসীদের জন্য মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বরাদ্দ চাই।।  সোহেল হাজং

১১ জুন ২০২০ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল । বাজেট অধিবেশনের পরপরই সন্ধ্যা ৭ টায় “করোনাকালে জাতীয় বাজেট ও আদিবাসী” শীর্ষক অনলাইন আলোচনা আয়োজন করে আই.পি.নিউজ.বিডি.কম। এ আলোচনায় উপস্থাপিত বাজেট সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানায় আলোচকবৃন্দ। আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রংয়ের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি ও আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ফজলে হোসেন বাদশা এমপি, প্রফেসর মেসবাহ কামাল, এএলআরডি-এর নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা, আদিবাসী ফোরামের সদস্য মেনথেইন প্রমিলা, রিপন বানাই ও জয়েনশাহী আদিবাসী কল্যাণ পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক।
আলোচনার শুরুতে বিষয়টির ওপরে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য তোলে ধরেন আদিবাসী ফোরামের সদস্য সোহেল হাজং। তিনি বলেন, সংসদে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট পেশ করা হলো সেখানে বরাবরের মতো দেশের ৩০ লক্ষ আদিবাসীরা উপেক্ষিত হয়েছে। এই করোনাকালেও দেশের অবহেলিত আদিবাসীদের গুরুত্ব দিয়ে বাজেট হয়নি। এবারের বাজেট বক্তৃতায়ও দেশের অবহেলিত আদিবাসী সম্পর্কে কোন প্যারা বা বক্তব্য রাখা হয়নি। তিনি আরো বলেন, তবে সমতলের আদিবাসীদের জন্য প্রতিবছর “বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা” নামে যে থোক বরাদ্দ দেয়া হয় সেখানে বরাদ্দ আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৫০ কোটি টাকা, আগামী অর্থ বছরের জন্য তা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে ৮০ কোটি টাকা। এছাড়া মৎস ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় সমতল ভূমিতে বসবাসরত অনগ্রসর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক ও জীবন মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সমন্বিত প্রাণি সম্পদ উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৬ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা।
এছাড়া এই করোনাকালে বাজেটে আদিবাসীদের জন্য বিশেষ কোন বরাদ্দ নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে স্বাভাবিক হারে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আগামী অর্থ বছরের জন্য এ মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব এসেছে ১২৩৫ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১১৯৪ কোটি টাকা। যদিও এটি শুধুমাত্র পাহাড়ের আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ নয়। এই মন্ত্রণালয়ের সকল পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় এবং পাহাড়ের আদিবাসী ছাড়াও প্রায় সমপরিমাণ সেটেলার বাঙালি মানুষের বাজেটও এখানে অন্তর্ভূক্ত। সোহেল হাজং তার বক্তব্যে আদিবাসী বান্ধব বাজেট করার জন্য ১১টি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা তোলে ধরেন যা এই প্রতিবেদনের শেষে অন্তর্ভূক্ত করা হল।
আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ফজলে হোসেন বাদশা এমপি বলেন, সমতলের ২০ লক্ষ আদিবাসীদের জন্য মাত্র ৮০ কোটি টাকা বার্ষিক বরাদ্দ আসলে কিছুই না। তিনি মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বাজেট করার পক্ষে বলেন। আর সমতলের আদিবাসীদের জন্য যেহেতু এখনও কোন মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় একটি অধিদপ্তর খোলে সমতলের আদিবাসীদের জন্য বাজেট বরাদ্দ বাস্তবায়ন করার প্রয়োজনের কথা বলেন।
শামসুল হুদা বলেন, যাদের জন্য বাজেট, তাদের বাজেট পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সরাসরি যুক্ত করতে না পারলে লাভ নেই। আদিবাসীদের জন্য শুধু বরাদ্দ রাখলে হবে না, বাজেট বাস্তবায়নের সুষ্ঠু পর্যালোচনাও থাকা উচিত। আমলা নির্ভর বাজেট না করে,দেশের সকল শ্রেণির লোকজনকে যুক্ত করে তাদের মতামতের ভিত্তিতে বাজেট নির্ধারনের দাবি জানান তিনি।
প্রফেসর মেসবাহ কামাল বলেন, আদিবাসীদের জন্য বাজেট বাড়ানো প্রয়োজন আবার সেই বরাদ্দ আসলে আদিবাসীদের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছে কিনা সেটাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাই বাজেট বাস্তবায়নেও একটি জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
পল্লব চাকমা বলে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের জন্য আলাদা কোন বরাদ্দ নেই এজন্য এ পরিষদের দ্বারা এ করোনা কালেও কোন উদ্যোগ হাতে নিতে দেখি না। বরাদ্দের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের প্রতি চেয়ে থাকতে হয়। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের জন্য জাতীয় বাজেটে সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখার জন্য দাবি জানান।
প্রমিলা বলেন সমতলের আদিবাসীদের জন্য মাত্র ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ হলে একজন আবিাসী ব্যক্তির ওপর মাথাপিছু অর্থ পড়ে মাত্র ৪০০ টাকা করে। যা একেবারে নগন্য।
সঞ্জীব দ্রং বলেন, সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটি পৃথক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার দাবি আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি। আবারো এ দাবি করছি। সংসদে বাজেট পেশ হলেও চূড়ান্ত বাজেট পাশ না হওয়া পর্যন্ত বা আরো কত সম্পূরক বাজেট সংযুক্তির মাধ্যমে বাজেটে সংশোধন আনা যায়। বাজেট সংশোধনীতে আদিবাসীদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।
সবশেষে তিনি বলেন, “একটি রাষ্ট্র তখনি সুন্দর হবে যখন এদেশের প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু মানুষেরা ভালো থাকবে। আমরা এমনি একটা রাষ্ট্র দেখতে চাই, যেখানে একজন সাঁওতাল, খাসি ও প্রান্তিক মানুষ বলবে আমরা ভালো আছি!”

আলোচনায় উপস্থাপিত প্রবন্ধে তোলে ধরা হয় যে সুপারিশমালা:

১)কোভিড-১৯ মহামারির সময় ও মহামারি পরবর্তীকালে আদিবাসীদের সুরক্ষা ও তাদের সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণে কমপক্ষে ১১ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক বরাদ্দ দেওয়া; ২) সমতলের আদিবাসীদের উন্নয়ন ও অংশগ্রহণমূলক বাজেট নিশ্চিতকরণে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করা; ৩) আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জন্য খাতভিত্তিক ও মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করা; সকল মন্ত্রণালয়ের/বিভাগের বাজেটে আদিবাসীদের জন্য সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখা এবং বরাদ্দের সুষ্ঠু বাস্তবায়নে আদিবাসীদের সরাসরি সম্পৃক্ত করা এবং এ বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা; ৪)জাতীয় বাজেট বক্তৃতায় আদিবাসী বিষয়ে স্পষ্ট বিবরণী রাখা। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঠিক সংখ্যা নিরুপণ এবং বাজেট বরাদ্দ জনসংখ্যার ভিত্তিতে বৃদ্ধি করা; ৫) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭ এর পূর্ণ বাস্তবায়নে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১-এর যথাযথ বাস্তবায়ন ও ভূমি কমিশনের কাজ ত্বরান্বিত করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে বরাদ্দ রাখা; ৬)পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদসমূহের বাজেট বৃদ্ধি করা। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদের সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা শক্তিশালীকরণে পর্যাপ্ত বাজেট রাখা। জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য ‘টাস্কফোর্স’ ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে জাতীয় বাজেটে পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ রাখা; ৭)সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কর্মসূচির সেবাসমূহে আদিবাসীদের অভিগম্যতা নিশ্চিত করণে একটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রাখা। আদিবাসীদের অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রকল্প গ্রহণ ও প্রকল্পের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে তাদের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা; ৮)কোভিড-১৯ মহামারিতে কর্মহীন ও ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসীদের বিশেষ প্রণোদনা রাখার ব্যবস্থা করা। দেশের প্রায় ৬০% দরিদ্র আদিবাসীদের জন্য করোনাকালে পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা রাখা; ৯)আদিবাসী যুবদের কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। তাদের জন্য প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৫% কোটা পুনর্বহাল করা। মহামারির পরবর্তী সময়ে সুদমুক্ত ঋণ দিয়ে আদিবাসীদের নিজস্ব পেশা ও ব্যবসায় যোগদানে সহায়তা করা; ১০) পর্যায়ক্রমে প্রত্যেকটি আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা ও আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া ও শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা; ১১) টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া, ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও আদমশুমারি ২০২১-কার্যক্রমের সাথে আদিবাসীদের সরাসরি সম্পৃক্ত রাখা, সকল আদিবাসী জাতিসত্তার আর্থ-সামাজিক, সংস্কৃতি ও পরিচয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিভাজিত তথ্য সংগ্রহে উদ্যোগ নেওয়া এবং সকল উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সাথে তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ বাজেট রাখা ।
ফেসবুকে সরাসরি অনুষ্ঠিত এই অনলাইন আলোচনায় প্রায় ৬ হাজারের বেশি মানুষ উপভোগ করেন এবং আদিবাসীদের পর্যাপ্ত বরাদ্দ বৃদ্ধি ও সুষ্ঠু বাজেট বাস্তবায়নের জন্য অনেকে মন্তব্য করেন।




সম্পাদক : মিঠুন রাকসাম

উপদেষ্টা : মতেন্দ্র মানখিন, থিওফিল নকরেক

যোগাযোগ:  ১৯ মণিপুরিপাড়া, সংসদ এভিনিউ ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। 01787161281, 01575090829

thokbirim281@gmail.com

 

থকবিরিমে প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। Copyright 2020 © Thokbirim.com.

Design by Raytahost