ডিসেম্বর মাস মানেই বিজয়ের মাস। এই বিজয়ের মাসে গারো জাতিগোষ্ঠীর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। বাঙালির পাশাপাশি গারো মুক্তিযোদ্ধারাও জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। শহিদ হয়েছেন। আমরা স্মরণ করি সকল মুক্তিযোদ্ধাদের যারা এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন। কবি জেমস জর্নেশ চিরান তার প্রবন্ধ গ্রন্থে লিখেছেন ‘মোট ১৩,০০(তেরশত)জন গারো মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলো বলে জানা যায়।’আমাদের হাতে গারো মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিকনা নামের তালিকা নেই। যা পেয়েছি তাও সঠিক নয় কারণ অনেক গারো মুক্তিযোদ্ধাগণই ইন্ডিয়াতে চলে গেছেন, অনেকের তালিকাতেই নেই ফলে সঠিক কতজন গারো মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা প্রকাশ করা আদৌ সম্ভব হয়নি। আশা করছি আগামীতে আমরা সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ নামের তালিকা প্রকাশ করতে পারবো। থকবিরিম এই বিজয়ের মাসে গারো মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি, সাক্ষাৎকার ভিডিও প্রকাশ করার চেষ্টা করছে। পাঠক আসুন আজকে বীর মুক্তিযোদ্ধা নরেন্দ্র মারাক (চাম্বুগং)-এর মুখের বয়ানে যুদ্ধের কথা শুনি-
বীরমুক্তিযোদ্ধা নরেন্দ্র মারাক (চাম্বুগং)
আমার নাম নরেন্দ্র মারাক (চাম্বুগং)। জন্ম হচ্ছে ডেফলাই গ্রামে। আমার ভাই বোন বলতে: ৩ ভাই, ৬ বোন। বাবার নাম জগেন্দ্র মৃ, মায়ের নাম জয়ানী চাম্বুগং। আমাকে নকশী গ্রামে জামাই নিয়ে আসা হয়। মুক্তিযুদ্ধের আগেই আমি বিয়ে করি। ১৯৬৪ সালেই আমার ৩১ বছর পূর্ণ হয়েছে। সেই সময় আমার ১ মেয়ে, ২ ছেলে হয়। ১৯৬৪ সালের রায়তের সময় অনেক লোকজন ভারতে পালিয়ে যায়। তখন আমাদের বাড়িতে ইপিআর বাহিনীদের যাতায়াত ছিল। তারা আমাকে বলত : এই ম-ল কোথাও পালিয়ে যেও না। আমরা আছি কেউ তোমাদের কিছু করতে পারবে না। আমরা টাকা দিব যারা ভারতে গেছে তাদের চলে আসতে বলো। আমার হাতে ৫০০ টাকা দিয়ে তাদেরকে ফিরিয়ে আনতে বলল। আমি বললাম- না স্যার তারা আর আসবে না। তারা বলল- আরে না নিয়ে আসতে হবে। লাগলে আরো ১০ হাজার দিবো। আমি অর্ধেক রাস্তা থেকে ফেরত চলে আসি। তাদের টাকা আমি ফেরত দিতে চাইলে তারা আর টাকা ফেরত নেয় নাই। সেই সময় মুসলমানরা অনেক লুটপাট করত। তাই অনেক কিছুই লুটপাট হয়ে গেছে। সহায় সম্পত্তি আর নেই।
আমার পড়াশোনা ৬ষ্ঠ-৭ম শ্রেণি পর্যন্ত। ডেফলাই স্কুলে পড়াশোনা করেছি। সেই সময় খাতা, কলম খুব কম পাওয়া যেত। আমরা কলার পাতা দিয়ে লিখেছি। আগের দিনে মুর্খ লোকের সংখ্যাই ছিল বেশি। অর্থাৎ বর্তমানের মত এত সহজ ছিল না পড়াশোনা। বর্তমান সরকার শেখ হাসিনা আমাদের জন্য অনেক সহায়ক। তিনি যেভাবে দেশবাসীদের দেখা শোনা করেন সেভাবে মনে হয় না কেউ করতে পারবে। আমাদের সেই দিনগুলিতে সবাই মিলে মিশে কাজ করতাম। তখনকার দিনে বাবা মা যার সাথে বিয়ে দিত তাকেই বিয়ে করতে হত। এখনকার মত প্রেম ভালবাসা ছিল না।
বর্তমানে আমার ছেলে মেয়ে বলতে: ভারতে আছে ছেলে ১ জন, মেয়ে ২ জন। বাংলাদেশে আছে ৩ মেয়ে, ১ ছেলে। আমার সাথে এখন শুধু এক মেয়ে- মেয়ে জামাই ও নাতি থাকে। নাতি এবার এস এস সি পরীক্ষা দিবে। আমি সরকার থেকে ৩ মাস পরপর ৩০ হাজার টাকা করে পাই। এই টাকা দিয়েই আমার সংসার কোন রকম চলে। আমার স্ত্রী দার্জিলিং চলে গেছে প্রায় ৪ বছর আগে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল প্রায় ৩৮ বছর। আমি শেখ মুজিবরের ভাষণ শুনে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার উৎসাহ পাই। তার ভাষণে দেশকে বাঁচানোর, শত্রু মুক্ত করার যে আহ্বান সেই থেকে আমার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া। আমিও ভাবলাম আমি তো বাংলাদেশে বাস করি তাহলে তো দেশকে বাঁচানোর ও মুক্ত করার একটা দায়িত্ব রয়েছে। আমাদের ট্রেনিং দেওয়ার জন্য রংনাবাগ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ৩ মাস ট্রেনিং নেওয়ার পর আমাদের পাঠানো হয় পুরকোসা। এখান থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। সেখানে আমি ছাড়াও আরো অনেক গারো সহযোদ্ধাও ছিল।
আমাদের প্রথম আক্রমণ ছিল টেংরামারি ক্যাম্প। তখন এই এলাকাটা পাহাড়ি উচু নিচু ছিল বিধায় আমরা ক্যাম্পটি ঘায়েল করতে পারি নাই। আমরা ফিরে আসি।
আমরা মোট প্রায় ২৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। আমরা ৩-৪ দিন সময় নিয়ে আবার বারমারি ক্যাম্পে আক্রমণ করি। আমাদের দলের লব সাংমা ছিল গ্রাম তার সন্ধ্যাকুড়া। তার হাতে গুলি লেগেছিল। পরে আমরা ঢালু চলে আসি।
পরে আমি আবার নকশী ক্যাম্পে চলে আসি। আমি ক্যাম্পে সবে ভাত খেতে বসেছি। তখনই শুনতে পেলাম ধুমধাম গুলির আওয়াজ। আমি ভাত খাওয়া রেখেই আমার মেশিনগান হাতে নিয়েই দৌড় দেই। শুধু গানের আওয়াজ পেয়ে রাজাকারের দল সেখান থেকে পালিয়ে যায়। অন্যান্যরা আমার সাহসের প্রশংসা করত। একদিন ভাইডাঙ্গাতে আমরা শুধু তিন জন যুদ্ধ করেছি পাক বাহিনী ও রাজাকারদের সাথে। তবে সেখানে কোন হতাহত হয়নি। সেখানে অবস্থান কালে আমরা তিনজন ৩ দিন কোন খাবার পায়নি। ক্ষিধের যে কী জ্বালা আমরা বুঝেছি। শুধু আখ খেয়েই জীবন বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। পরে হেলিকপ্টার দিয়ে আমাদের জন্য শুকনো বিস্কুট ফেলে দিয়ে যায়। সেই বিস্কুট খেতে তো খুবই মজার। তাই আমি তো পেট ভরে খেয়েছিলাম। পানি খাওয়ার পরে তো আমার পেট খারাপ হয়ে গেল। একে বারে আমাশয়। তবে সেদিন বিস্কুট না রেখে গেলে আমরা মনে হয় মরেই যেতাম। কারণ দুজনের ক্ষিধের যন্ত্রণায় হাত অবশ হয়ে গিয়েছিল। আমরা সেখানে ঝর্ণার পাশে আশ্রয় নিয়েছিলাম। পাকবাহিনীরা একটু নড়াচড়া দেখলেই ধুম করে গুলি করে দিত।
আমরা ভাইডাঙ্গা থেকে চলে এলাম গোবিন্দ টিলাতে। সেখানে আমরা ৩ দিন বিশ্রাম নিলাম। সেখানকার শিখ জাত (ভারতীয় সেনা) আমাকে জিজ্ঞেস করল: এই তোমার নাম কি? আমি বললাম: আমার নাম। আবার বলল: তুম বাঙালি নাহি হাই তো? আমি বললাম আমি গারো খ্রিস্টান। পরে সে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল। বলল: তুমি কি যুদ্ধের সময় সেখানে ছিলে? আমিও বললাম হে আমি সেখানে ছিলাম আর অনেক যুদ্ধের সম্মুখিনও হয়েছি। আমাকে খাওয়ালো। বিশ্রামের জন্য জায়গাও দিল। একটু ঘুম দিলাম তখনই হঠাৎ করে খবর এল: দেশ স্বাধীন হোগিয়া। ও মোড়ক, বলে আমাকে ডাকল। দেশ স্বাধীন হোগাইতো। ভাগ যাতায় তো। ভারতীয় সেনাগণ বলল: বাহ! এত তাড়াতাড়ি স্বাধীন হয়ে গেল।
পাকিস্থানীরা ভাগগেয়া। আমরা সকাল সকাল ব্যাগ গুছিয়া আসার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। খাওয়া দাওয়া ভুলে প্রস্তুতি নিলাম। সেখান থেকে পুরাকোসা চলে আসলাম। পুরাকোসাতে ২ দিন থেকে পরে আমরা বাংলাদেশে চলে আসলাম।
স্বাধীন দেশে ঘুরাফেরা করার জন্য আমরা রওনা হলাম শেরপুর-জামালপুর-ধনবাড়ি-ময়মনসিংহ-ঢাকা হয়ে আবার ময়মনসিংহ আসি। স্বাধীন দেশটা ঘুরে দেখলাম। আমরা বিভিন্ন জায়গায় দেখলাম যে, রাজাকার ও বিহারীদের দেশের জনগণ মারধর করছে। কি মার রে বাবা!! এমনকি মেয়েরাও তাদের উপর প্রতিশোধ নেয় আর বলে যে, এরাই আমাদের ইজ্জত লুট করেছে। দে মার! বিহারীরা তাদের পোশাক খুলে পালিয়েছিল তারপরও তাদের রং তো আর পাল্টাইনি। তাদেরকে ধরে ধরে গণধোলাই!
ময়মনসিংহের খাগদহর ইপিআর ক্যাম্পের এক হাকিম আমাকে বলেছিল: সেখানে ইপিআর এ চাকরি নিতে। আমি বললাম এত কষ্ট করে যুদ্ধ করে স্বাধীন করলাম আর এখানে চাকরি করব। তার চেয়ে আমি গ্রামে চলে যাই। তখন শেখ সাহেব আমাদেরকে ডেকে বলল: বাবা তোমরা মুক্তিযোদ্ধা, দেশ স্বাধীন করছো, অনেক ভাল কাজ করছো, দেশে এখন আর কোন শত্রু নাই। তোমরা তাহলে এখন বাড়ি যাও যে যার মত কাজে লেগে যাও। যারা কৃষক তারা কৃষি কাজ করো, যারা শিক্ষকতার কাজ কর তারা শিক্ষকের কাজই করো আবার ডাকলে এসো। এই বলে আমাদেরকে ৫ টাকা দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিল।
বাড়িতে এসে দেখি খাবার কোনো কিছুই নাই। কারও কাছে ধারও পাওয়া যায় না। আর কী করব! রাস্তায় ভিক্ষা করে কোনরকম আমাদের দিন চলত। এভাবেই অনেক কষ্টে আমাদের দিন গেছে। তারপর হচ্ছে সরকার এরশাদের আমলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের দিল ৫০০ টাকা করে আর খালেদা জিয়ার আমলেও এভাবেই পেয়েছি তারপর এখন শেখ হাসিনা দিচ্ছে ১০,০০০ হাজার টাকা।
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত
-
রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর উৎসব ওয়ানগালা
: রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও...
-
আজ লেখক ও চিন্তক আলবার্ট মানকিন-এর স্মরণসভা ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান
: মধুপুর গড়াঞ্চলের আদিবাসী নেতা, চিন্তাবিদ, লেখক, সমাজকর্মী, এনজিও কর্মী আলবাট...
-
গুলশান বনানী ওয়ানগালা ২১ অক্টোবর শনিবার
: গুলশান বনানী ওয়ানগালা ২১ অক্টোবর শনিবার আদি সাংসারেক গারো জাতিগোষ্ঠীর...
-
১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ...
-
রে রে : হায়রে আমার কাঞ্জিয়া ।। নীলু রুরাম
: সমর সাংমার রেরে নিয়েই শুরু করি তবে একটু আলাদা। আমাদের...
-
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিরাপদ ব্যবহার ।। জাডিল মৃ
: এক. সময় স্রোতের সাথে আবাহমান ছুটে চলা প্রযুক্তির উন্নতি, মানব...
‘রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর উৎসব ওয়ানগালা’
: রাত পোহালেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে গারো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও......বিস্তারিত
‘১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থকবিরিম-এর যুগপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠান’
: এক এক করে বার বছরে পদার্পণ করলো গারো সাহিত্যের পত্রিকা ......বিস্তারিত