Thokbirim | logo

১৪ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | ২৯শে নভেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

গারো বীরমুক্তিযোদ্ধা : সন্ধ্যা রানী সাংমা

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১০, ২০১৯, ১৪:০৬

গারো বীরমুক্তিযোদ্ধা : সন্ধ্যা রানী সাংমা

ডিসেম্বর মাস মানেই বিজয়ের মাস। এই বিজয়ের মাসে গারো জাতিগোষ্ঠীর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। বাঙালির পাশাপাশি গারো মুক্তিযোদ্ধারাও জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। শহিদ হয়েছেন। আমরা স্মরণ করি সকল মুক্তিযোদ্ধাদের যারা এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন। কবি জেমস জর্নেশ চিরান তার প্রবন্ধ গ্রন্থে লিখেছেন ‘মোট ১৩,০০(তেরশত)জন গারো মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলো বলে জানা যায়।’ আমরা সঠিক তালিকা এখনও পাইনি যা পেয়েছি তাও সঠিক নয় কারণ অনেক গারো মুক্তিযোদ্ধাগণই ইন্ডিয়াতে চলে গেছেন ফলে তাদের নামের তালিকা আসেনি বা করা হয়নি। থকবিরিম এই বিজয়ের মাসে গারো মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি, সাক্ষাৎকার ভিডিও প্রকাশ করার চেষ্টা করবে। পাঠক আসুন আজকে বীর মুক্তিযোদ্ধা  সন্ধ্যা রানী সাংমার মুখের বয়ানে যুদ্ধের কথা শুনি…

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে আমিও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। তখন আমাদের লুঙ্গি পরিয়ে গেঞ্জি পরিয়ে আমাকে আর দিদি ভেরুনিকাকে যুদ্ধে নিয়ে যায়। ছেলেদের সাথে মিলিতভাবে আমরা যুদ্ধে যাই। সেই সময় ভারতের মিত্র বাহিনী আমাদের সাথে যুদ্ধে অংশ নেয়। সেই সময় আমাদের অনেক মুক্তিযোদ্ধা মারা যায়। পরবর্তীতে ধানুয়া কামালপুরে আমাদের রাখা হয় যুদ্ধে যারা আহত হত তাদের সেবা যত্ন করার জন্য। তখন আমাদেরকে নার্স-এর পোশাক দেওয়া হয়। সেই ক্যাম্পে আমাদের দেশিয় মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেক ভারতীয় সৈন্য মারা যায়।

আন্তনি মিস্ত্রি নামের একজন সিলেটের মুক্তিযোদ্ধার মাথায় গুলি লেগে মস্তক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে কিন্তু তার মৃত্যু হয়নি। আমরা আন্তনি মিস্ত্রির ছড়ানো মস্তক সংগ্রহ করে তার মাথায় আবার লাগিয়ে দেই এবং ফুলকরি গাছের রস দিয়ে সেই স্থানের চামড়া সেলাই করে দেই। সেলাই ভাল হয়েছিল বিধায় সেই রুগি বেঁচে যায়। সেই ঘটনার পর থেকে আমাদেরকে নার্স বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর আগে কিন্তু আমাদের সেভাবে নার্স এর স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি কারণ আমাদের নার্স ট্রেনিং শেষ হয়নি তখনও। শুধু যুদ্ধ করার জন্য আমাদেরকে পাঠানো হয়েছিল। সেই কাজ দেখে ক্যাম্পের লোকজন বিশ্বাস করে যে আমরা আসলেই মেডিকেলের লোক। নয়তো এ ধরনের কাজ করতে পারতো না। তখন আমাদের সরাসরি যুদ্ধে না পাঠিয়ে নার্স হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

সেই বেঁচে যাওয়া লোকটি এখনও বেঁচে আছেন শুনেছি। প্রায় ২২ বছর পর একদিন সেই আন্তনি আমাকে দেখতে আসে। সে আমাকে জীবন দাতা মা হিসেবে আখ্যায়িত করে। আমাকে দেখেই পা ছুঁয়ে অঝরে কাঁন্না করে। আমার বোনের কথা জানতে চায়, আমার আরেকজন মা কোথায়। আমি বললাম সে তো নেত্রকোনায় বউ চলে গেছে। তবে এখন আর যোগাযোগ নেই, ঠিকানা সব হারিয়ে ফেলেছি।

আমরা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সেই ক্যাম্পেই ছিলাম। আমরা শেরপুর জামালপুর হয়ে বাংলাদেশে এসেছি। আহতদের আরো সেবা করার জন্য আমরা বক্সিগঞ্জে আসি। এই ব্যাটালিয়ান ধ্বংস করার জন্য রাজাকার, আলবদর বাহিনী বোমা হামলা করে। কিন্তু ঈশ^রের কৃপায় ভাগ্য ভাল আমাদের ক্যাম্পে পড়েনি, পড়েছিল ৩ মাইল দূরে তাই কেউ আহত বা মারা যায়নি।

সেখান থেকে আমাদের নিয়ে আসল জামালপুর সদর দুই তালা বিশিষ্ট একটি হাসপাতালে। এখানে নার্সদের জন্য কোয়াটারের ব্যবস্থা ছিল। সেখানে আনোয়ারা নামের একজন নার্স ছিল সেও রুগিদের সেবা করতো। সে কিন্তু একজন রাজাকার ছিল। তবু সে একজন নার্স হিসেবে সেবা করতো। সে হাসপাতালের যাবতীয় খবরা খবর পাক বাহিনীদের কাছে পৌছে দিত। আমরা যখন চলে আসলাম তখন সে আর সেই সুযোগটা পায়নি। আমাদের সাথেই মিলে মিশে কাজ করেছে। আমাদেরকে একসাথেই কোয়াটারে রাখা হয়।

ঘটনা সমূহ আমরা জেনেছি বিধায় সেখানকার ডক্টর আমাকে বলে সন্ধ্যা তুমি কাউকে আর কিছু বলো না, নয়তো আনোয়ারার চাকরি আর থাকবে না। যদিও সে একজন রাজাকার। তখন আমি আর কিছু বলিনি। সেখানে দুই সপ্তাহ থাকার পরই আমরা জানতে পারলাম যে, দেশ শত্রু মুক্ত হয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। তখন ১৬ই ডিসেম্বর আমাদেরকে আমরিতলা নামক স্থানে আমাদের সহযোদ্ধা মিননাস, দুলাল দাদা, ক্যাপ্টেন আব্দুল মান্নান এবং ক্যাপ্টেনের স্ত্রী রেখে যায়। সাদা শাড়ি লাল পাড় এই শাড়িটি আমাদের জন্য দিয়ে যায়। এটি হচ্ছে আমাদের জয়ের চিহৃ। আমরিতলা গ্রামটি আসলে দিদি ভেরোনিকার বাবার গ্রাম। তারা আমার কাকা অর্থাৎ ভেরোনিকা দিদির বাবার কাছ থেকে লিখিত পত্র এই মর্মে নিয়ে যায় যে, “আমি আমার দুই মেয়েকে বুঝিয়া পাইলাম’।

দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক বছর পর খালেদা জিয়ার শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাই। প্রথম ধাপে পাই ৩০০ টাকা, পরে ৫০০ টাকা। তৃতীয় ধাপে এসে পাই ৬০০ টাকা। সব তথ্য জানার জন্য একটা ফরম ফিলাপ করা হয়। এ বছর আবার ফরম ফিলাপ করা হয়েছে চূড়ান্তভাবে ৫ পৃষ্ঠার ফরম। এটা অনলাইনে পাঠানো হয়। এখন অনলাইনে ভারত নাম্বার বা গেজেট নাম্বার দিয়ে সার্চ করলেই আমার প্রোপাইল সমূহ দেখা যাবে। এখন আমি মাসে ১০,০০০ টাকা করে ভাতা পাই এবং দুটি ঈদ বোনাস পাই।

আমরা প্রথমে বাংলাদেশেই নার্সিং ট্রেনিং গ্রহণ করি জয়রামকুড়াতে। আগে এখানে বিদেশিদের যাতায়াত ছিল অনেক। অস্ট্রেলিয়ানদের যাতায়াত ছিল বেশি। আমার কোন ভাই বোন ছিল না। আমার মা-বাবা কৃষি কাজ করতো। বাবার নাম জমির (মারাক) চাম্বুগং মায়ের নাম রিনুমনি মৃ। আমার জন্মস্থান হচ্ছে ইদিলপুর গ্রাম। পরে কাজের জন্য অর্থাৎ জুম চাষের জন্য আমরা জাঙ্গলিয়া গ্রামে আসি। পরবর্তীতে এখানেই আমরা স্থায়ীভাবে থাকতে আরম্ভ করি। এখান থেকেই আমি জলছত্র স্কুলে পড়াশোনা করেছি। তখন জলছত্র মিশনে ছিল ফাদার হোমরিক। আমি ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। পরে বুটিয়াতে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। সেখানে আমার মাসি সরনাময়ি মৃ এর বাড়িতে ছিলাম। সেখানে ৮ম শ্রেণিতে পড়েই আমি ২ বছর শিক্ষকতা করেছি। সেখান থেকে আমি জয়রামকুড়াতে যাই নার্সিং ট্রেনিং নিতে। সেই সময়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়েও শিক্ষকতার কাজ করতে পারতো।

স্বামী-সন্তানদের সাথে বীরমুক্তিযোদ্ধা সন্ধ্যারানী সাংমা

সন্ধ্যা রানী সাংমার জীবনী :

সন্ধ্যা রানী সাংমা টাংগাইল জেলার মধুপুর উপজেলার বোকারবাইট গ্রামে ১৯৫০ সালে গারো আদিবাসী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই ভালো কাজ/ মানুষের সেবা করার মানসিকতা নিয়ে বড় হলেও পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে ৮ম শ্রেণির বেশি লেখা পড়া করতে পারেননি। মানুষের সেবার ব্রত নিয়েই ১৯৬৯ সালে হালুয়াঘাটের জয়রামকুড়া খ্রিষ্টীয়ান হাসাপাতালে নার্সিং প্রশিক্ষণে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালে নার্সিং কোর্সে ২য় বর্ষ শেষ হলে দেশে শুরু হয় মহান স্বাধীনতার সংগ্রাম। মানষের সেবা করার জন্য ছুটে যান যুদ্ধাহতদের সেবা করার জন্য। ১১নং সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল আবু তাহের এর তত্তাবধানে ১৯৭১ সালের ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সময়কালে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ঘাটিতে যদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা শুশ্রুষা করেন। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন এর পর নিজ বাড়িতে ফিরে আসলে আত্মীয় পরিজন অবাক হন। কারণ আত্মীয় পরিজনদের ধারণা ছিল তিনি হয়তো আর বেঁচে নেই!

পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে নেত্রকোণা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার নলছাপ্রা গ্রামের বাসিন্দা চার্চিল কুবি এর সাথে বিবাহ বন্ধানে আবদ্ধ হয়ে নলছাপ্রা গ্রামেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বিয়ের পর গ্রামের মানুষদের তিনি বিনামূল্যে সেবা দেন। যেমন : সেলাইন ভরে দেওয়া, ইঞ্জেকশন দেওয়া, ব্যান্ডেজ করা, ড্রেসিং করা ইত্যাদি। ঐ সময়ে গ্রামে কোন ডাক্তার ছিল না, উপজেলা হাসপাতালও দূরে। তাই তার কাছে অনেকেই প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ভিড় জমাতেন। গ্রামের মানুষদের তিনি সেবা করে তিনি আত্মতৃপ্তি পেতেন। তাই মানষের চিকিৎসা সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন। বিয়ের ১২ বছর পরই তাঁর স্বামী মারা যান আর রেখে যান ২ ছেলে ও ১ মেয়ে। ৩ সন্তানকে নিয়ে তিনি অনেক কষ্টে দিন কাটান পাশপাশি চলে মানুষের সেবা করার কাজটাও। অনেক কষ্টে সাধ্যমত ৩ সন্তানকেই শিক্ষিত করেন। বড় ছেলে মাস্টার্স পাশ করে এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। ছোট ছেলে পলিটেক্যাল থেকে ডিপ্লোমা পাশ করেছেন। আর মেয়ে এসএসসি পাশ করে পিটিআই কোর্স সম্পন্ন করেছেন।

এ পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে মোট ১১ বার সম্মাননা পেয়েছেন যেমন- অনন্যা শীর্ষ দশ, ৭১ এর নারী, নারী মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা-২০১৬, গেরিলা ৭১, জালাল উদ্দিন ফাউন্ডেশন, মুক্তির উৎসব স্মৃতি চারণ সম্মাননা, থকবিরিম-২০১৭(আদিবাসী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান), আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে বিশেষ সম্মাননা -২০১১, কারিতাস বাংলাদেশ এর সৌজন্যে মানবাধিকার দিবস ২০১০ সম্মাননা ও সর্বশেষ জয়িতা সম্মাননা-২০১৯। কৃতজ্ঞতা : বারসিক নিউজ .কম

থকবিরিমের ক্যামেরায় বীরমুক্তিযোদ্ধা সন্ধ্যারানী সাংমা

      




সম্পাদক : মিঠুন রাকসাম

উপদেষ্টা : মতেন্দ্র মানখিন, থিওফিল নকরেক

যোগাযোগ:  ১৯ মণিপুরিপাড়া, সংসদ এভিনিউ ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। 01787161281, 01575090829

thokbirim281@gmail.com

 

থকবিরিমে প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। Copyright 2020 © Thokbirim.com.

Design by Raytahost