গারো জাতিসত্তার লোকবিশ্বাসকে যেমন বলা যায় আশ্চর্যের তেমনি বলা যায় চমকপ্রদও । দ্বৈতজীবনের বিশ্বাস গারোদের যাপিতজীবনের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে। গারোরা যেমন বিশ্বাস করে ডাকিনী-যোগিনী, ভূত-প্রেত তেমনি বিশ্বাস করে থাকে জাদু-তুনা, মন্ত্র-তন্ত্রে। তেমনিভাবে তারা দ্বৈত্যজীবন লাভকে গভীরভাবে বিশ্বাস করে থাকে। গারোদের মতে কেউ কেউ মাৎচা ফিললে (বাঘ হয়ে) কেউ কেউ চিপফু(সাপ), কেউ কেউ মাৎচক(হরিণ) কেউ আরিংকা(কুমির) কেউ আবার মাৎফু’র(গুইসাপ) জীবন নিয়ে জন্ম গ্রহন করে। তাদের বিশ্বাস মানুষ দুইভাবে দ্বৈতজীবন লাভ করতে পারে। ১ জন্মগতভাবে ২ জন্মের পর (স্বপ্নের মাধ্যমে)। যে শিশু দৈতজীবন নিয়ে জন্মগ্রহন করে শৈশবকালে সে যে জীবন নিয়ে জন্মেছে সেই জীবনের নানা বৈশিষ্ট্য প্রকাশ হতে থাকে। যেমন যে শিশু বাঘের জীবন নিয়ে জন্ম গ্রহন করে সে ছোটকাল থেকেই তার দুই কান নাড়াতে পারে, বড় বড় খাল একলাফে পার হতে পারে, সুপারি-আম-জাম গাছে বা উঁচু কোনো গাছে উঠতে পারে খুব সহজেই, কাউকে ভয় করে না বরং কেউ ধমক দিলে উল্টা তাকে দেখে নেয়ার ভয় দেখায়। কথিত আছে, যে ছেলে বাঘের জীবন নিয়ে জন্মগ্রহন করে তার পাছায় লেজের মতো চিহ্ন থাকে। সবার বিশ্বাস ছেলেটি বড় হলে সেই চিহ্নটিও বড় হয়। আবার গারোদের বিশ্বাস জন্মের পরও একটি শিশু দ্বৈতজীবন লাভ করতে পারে। তাদের বিশ্বাস মতে, যে শিশু যে জীবের জীবন লাভ করবে সে সেই জীবের আচরণ, জীবন প্রণালী স্বপ্নের মাধ্যমে শিখে থাকে বা স্বপ্নে তাকে শিখানো হয়। যেমন কেউ যদি বাঘ হতে চায় তাহলে সে স্বপ্নে বড় বড় খাল লাফ দিয়ে পাড় হবে, ঘরের ধননা-চাল এইসব জায়গায় লাফালাফি-উঠাউঠি করে, এর ফলে সে ঘুম থেকে ক্লান্ত হয়ে ঘেমে জেগে উঠবে। স্বপ্নের ঘোরে কান নাড়বে, বাঘের মতো শব্দ করবে। জন্মগতভাবে যে শিশু দ্বৈতজীবন লাভ করেছে সেই শিশুটির আশপাশ সে যে জীবন নিয়ে জন্মেছে সেই জীবনের প্রাণীকে সেই ছেলের সাথে ঘুরঘুর করতে দেখা যায়। কিংবা সেই প্রাণী সেই ছেলের সাথে খেলবে বা রাতের আঁধারে সেই ছেলের কাছে আসবে। আর ছেলের সাথে থাকা সেই প্রাণীকে আঘাত করলে বা ভয় দেখালে ছেলেটিও আঘাত পাবে বা ভয় পাবে। তখন মা বাবাকে স্বপ্নে সেই প্রাণী বলে যে, সে তারই ছেলে, তাকে আঘাত করে তারা ভুল করছে বা তাকে আঘাত করলে তার ছেলেও মারা যাবে বা আঘাত পাবে। আবার যে শিশু কুমিরের জীবন নিয়ে জন্মে সে ছোটবেলা থেকেই সাঁতার বা পানিতে অনেক্ষণ ডুবে থাকতে পারে। কিংবা পানিতে নামার সাথে সাথে তার কাছে কুমির চলে আসে, খেলা করে। থকবিরিম পাঠকদের জন্য হেমারসন হাদিমা কর্তৃক সংগৃহীত দ্বৈতজীবনের গল্প ধারাবাহিক প্রকাশ করা হলো। আজকে প্রথম-পর্ব।
কুমির জীবন
সূরজ্য নামে এক মহিলা। তার গায়ের রং কালো। মুখাকৃতি লম্বাটে। গায়ের চামড়াগুলো যেন খুব পুরু। হাঁটতে গেলে তার পিঠ একটু বেঁকে যায়। ঠোঁট জোড়া অত্যন্ত মোটা। তার চেহারা দেখে মনে হবে যেন অন্যসব মানুষের দৈহিক গঠনের সাথে তার কোনটারই মিল নেই। এই মহিলা অনেক বয়স হয়ে মারা গিয়েছিল। সে যেসব কাহিনী বলতো, সেগুলো শুনে লোকে তাকে সন্দেহ করতো- সে নিশ্চয়ই কুমিরের আত্মা বিশিষ্ট। অর্থাৎ তার আরেকটা রূপ আছে- যা কুমিরের দেহ বিশিষ্ট।
সূরজ্য বলতো, ‘তোমরা কেউ যখন বড় কোন নদী পারাপারের জন্য নৌকায় উঠ, তখন মাথায় পাগড়ি বাঁধবে না। কারণ তাতে কে আপন আর কে পর- চেনা যায় না।’ এর অর্থ- নদী পারাপারের সময় মাথায় পাগড়ি থাকলে তার নিজের লোককেও চিনতে না পেরে জলে টেনে নেয়া হতেও পারে। অপরপক্ষে মাথায় পাগড়ি না থাকলে লোকটির মুখ পরিস্কার দেখা যায় এবং নিজের লোককে চিনে তাকে বাঁচিয়ে অপরজনকে নৌকা থেকে টেনে নামানো যায়। উল্লেখ্য যে অনেক সময় বিশেষত বর্ষাকালে নৌকা থেকে মানুষ টেনে নামায় জলের কুমির-এমন অনেক ঘটনা ঘটে থাকে।
সূরজ্য বর্ষাকালে যে গ্রামে থাকবে- সেখানে সে যদি বলে যে, স্বপ্নে তার অনেক আত্মীয় স্বজন তাকে দেখতে আসছে- তাহলে অবশ্য অবশ্যই সে এলাকায় জল প্লাবন হবে। এর অর্থ- বন্যায় জলের সাথে অনেক কুমির সেখানে আসে।
এছাড়াও কোনো এলাকায় ব্যাপক নদী ভাঙন শুরু হলে, রাতে তার ঘুম হত না। সারারাত সে উস্খুস করে কাটাতো। আর সকালবেলা বলতো, ‘আজ রাতে খুব পরিশ্রম করেছি।’ কথাগুলো শুনতে অদ্ভুত লাগে। আসলে সে সারারাত তার সাথী কুমিরদের সাথে নদীর পাড় ভেঙেছে। বেশি দিনের কথা নয়। ময়মনসিংহ জেলার উত্তর সীমান্তে সুসং দূর্গাপুরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সোমেশ্বরী নদী আগে প্রবাহিত হত বিরিশিরি আর দূর্গাপুরের মাঝ বরাবর পূর্ব দিকে। এটি ভারতের সীমান্তে বাঘমারা শহর থেকে দূর্গাপুরকে বাঁয়ে রেখে সোজা দক্ষিণে এসে আবার দুর্গাপুর শহরের দক্ষিণে অস্বাভাবিক বাঁক নিয়ে বিরিশিরিকে ডাইনে রেখে পূর্বমুখে প্রবাহিত হত। কিন্তু হঠাৎ এই নদী আগের গতি বদল করে বিরিশিরির পশ্চিমে শিবগঞ্জ বাজারের মাঝখান দিয়ে সোজা দক্ষিণে প্রবাহিত হয় এবং জারিয়া ঝাঞ্জাইল এর নিকট কংশ নদের সাথে মিশে যায়।
ফলে দুর্গাপুর ও বিরিশিরির মাঝখান দিয়ে পূর্বমুখী বয়ে যাওয়া মূল ধারাটি দুর্বল হয়ে পড়ে। তাতে বিরিশিরি আর সুসং দুর্গাপুরের মাঝখানে নদীতে বড় বড় চর জেগে উঠে। তথাকথিত মহিলা সূরজ্য বুড়ি আলাপ করতো- নদীর এই নতুন ধারাটি নাকি ওরাই সৃষ্টি করেছিল। ওরা মানে ওর সাথে আরো অনেক সাথী কুমির।
সোমেশ্বরী নদীর এই নতুন ধারাটি বানাতে গিয়ে সূরজ্য এবং তার আত্মীয় কুমিরদের রাতদিন পরিশ্রম করতে হয়েছে। অনেকের দাঁত ভেঙেছে, লম্বা নাকের ঠোঁট কেটেছে, ভোতা হয়েছে, পিঠ বেঁকে কুঁজো হয়েছে- আরো কতো কী। সূরজ্যও নিজের ঠোঁটও ফুলেছে সে জন্যই এবং তার পিঠ বেঁকে কুঁজো হয়েছে সে একই কারণে। তাহলে সে যে একটা কুমিরের আত্মাবিশিষ্ট- এই বিশ্বাস করা যায় নাকি?
হেমার্সন হাদিমা গারো জাতিসত্তার বিশিষ্ট লেখক।
‘সাংসারেক ওয়ান্না, গোড়ামী আর উপসাংসারেক-এর গল্প’
: আমার ধারণা-মিদ্দি রাবুগা, সালজং আমার উপর অধিক খুশি হয়ে বর......বিস্তারিত
-
সাংসারেক ওয়ান্না, গোড়ামী আর উপসাংসারেক-এর গল্প
: আমার ধারণা-মিদ্দি রাবুগা, সালজং আমার উপর অধিক খুশি হয়ে বর...
-
কালাচাঁদপুরে চলছে মাসব্যাপী গারো বইমেলা
: কালাচাঁদপুরের শিশু মালঞ্চস্কুল প্রাঙ্গণে চলছে গারো বইমেলা। বইমেলা শুরু হয়েছে...
-
প্রকাশিত হলো লিয়াং রিছিল-এর Bi·sarangni Goserong
: প্রকাশিত হলো আ·চিক ছড়াকার লিয়াং রিছিল-এর প্রথম অনবদ্য সাহিত্য-কর্ম ‘Bi·sarangni...
-
আমরা আটকে গেছি ।। মৃগেন হাগিদক
: প্রগতিশীল নেতাদের অভিমত, আমরা (আচিক, মান্দি বা গারো) আটকে আছি,...
-
গারো জাতি সত্তার কবি মতেন্দ্র মানখিনকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা
: আজ কবি মতেন্দ্র মানখিনের জন্মদিন। জন্মদিনে থকবিরিম পরিবারের পক্ষ থেকে...
-
Noksil ।। Labison Sku
: Noksil Mosla nonga bringni do.bipani japingko cha.ai Da.au mangmang...
‘সাংসারেক ওয়ান্না, গোড়ামী আর উপসাংসারেক-এর গল্প’
: আমার ধারণা-মিদ্দি রাবুগা, সালজং আমার উপর অধিক খুশি হয়ে বর......বিস্তারিত
‘সাংসারেক ওয়ান্না, গোড়ামী আর উপসাংসারেক-এর গল্প’
: আমার ধারণা-মিদ্দি রাবুগা, সালজং আমার উপর অধিক খুশি হয়ে বর......বিস্তারিত