Thokbirim | logo

৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

যারা লিখতে আসছে তাদের মধ্যে অনেকেই প্রতিশ্রূতিশীল এবং দায়বদ্ধতা আছে-জেমস জর্নেশ চিরান

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৯, ২০১৯, ১২:২৩

যারা লিখতে আসছে তাদের মধ্যে অনেকেই প্রতিশ্রূতিশীল এবং দায়বদ্ধতা আছে-জেমস জর্নেশ চিরান

গারো সাহিত্যের বিশিষ্ট কবি জেমস জর্নেশ চিরান। লিখছেন দীর্ঘদিন ধরে। প্রকাশ হয়েছে তিনটি গ্রন্থ। দুঃসময়ের বসত ভিটা এবং  দৈর্ঘ নেই, প্রস্থ নেই’ কবিতা গ্রন্থ এবং ‘প্রান্তিক সমাজের কথা : প্রসঙ্গ গারো ও হাজং জনসমাজ’ প্রবন্ধ গ্রন্থ। কবি কবিতা লেখার জন্য ১৯৮৩ সালে পেয়েছেন ‘ আর্চবিশপ গাঙ্গুলী সাহিত্য’ পুরস্কার। পেয়েছেন রকি শিশু সাহিত্য পুরস্কার, ওয়ানগালা সম্মাননা, গারো গবেষক, লেখক ও কবি সাহিত্য সম্মাননা। ১৯৫৯ সালের ২ আগস্ট কবি জেমস জর্নেশ চিরান জন্ম গ্রহণ করেন। বিভিন্ন বেসরকরি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। বর্তমানে TWA-এর কেন্দ্রীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক পদে কর্মরত আছেন। কবি জেমস জর্নেশ চিরান এবং সম্পাদকের সাথে লেখালেখির নানা বিষয় নিয়ে আলোচনার বিশেষ অংশ থকবিরিম পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।

লেখালেখি শুরুর কথা…

জেমস জর্নেশ চিরান : সময়টা হাই স্কুল জীবনের প্রারম্ভিককাল। সত্তর দশকের প্রথমার্ধ। সেই সময়ে কলেজ পড়ুয়া কিছু অগ্রজ উদ্যমী গারো যুবকেরা স্টেনশিল করা কাগজে “বন কাকলী” নামে অনিয়মিত এক সাহিত্য  পত্রিকা প্রকাশ করতেন। এই কাগজকে উপলক্ষ্য করেই প্রয়াত আমার আপন কাকা পেলেন্দ্র দ্রং-এর পড়ার ঘরে স্থানীয় সাহিত্যমোদী ও সংস্কৃতিমনা বেশ অনেক যুবকদের আড্ডা হতো। এই আড্ডায় গারো সমাজ সংস্কৃতির অনেক প্রসঙ্গ আসতো। তাদের আবেগঘন আলাপ-আলোচনা, পর্যালোচনা আমি বেশ আগ্রহ ভরে শুনতাম। তারা গারো ক্ষয়িষ্ণু  সংস্কৃতি নিয়ে আলাপ করতেন। নিজের লেখা অন্যজনকে পড়ে শুনাতেন। বাংলা সাহিত্যের ক্ষণজন্মা বড় বড় কবি সাহিত্যিকদের জীবনী ও তাদের সাহিত্য নিয়েও তারা আলোচনায় বসতেন। মূলত তাদের এই আড্ডা থেকেই আমার লেখার অনুপ্রেরণা ও প্রণোদনা।

প্রথম লেখা…

জেমস জর্নেশ চিরান : কবিতা। কী শিরোনামে কবিতা লেখেছিলাম তা মনে করতে পারছি না। সেই প্রথম লেখা কবিতা ছাপা অক্ষরের আলো পায়নি। তবে তারপর থেকে লিখতেই থাকলাম। আর এই কবিতা লেখার ক্ষেত্রে মূল অনুপ্রেরণায় ছিলেন কাকার পড়ার ঘরের মূল আড্ডাবাজ আমার চরবাঙ্গালিয়া গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম ধলাপানির শ্রদ্ধাভাজন কবি ও নাট্যকার এ্যান্তোনী রেমা। দারুণ সম্ভাবনাময় এই কবি পরবর্তীতে কবিতা আর লেখেননি। তার লেখা দুটি নাটক “মরুর কান্না” ও “চৌরঙ্গী”গারোদের সমাজ সংস্কৃতি ও সংকটকে উপজীব্য করে লেখা সেই সময়ে সফল মঞ্চস্থ হয়েছিল। আমার মনে আছে এক রাত্রেই তিনি চৌরঙ্গী নাটকটি দাঁড় করিয়েছিলেন। দুঃখের বিষয়, তিনি বর্তমানে দেশান্তরী। আর কোনো নাটকের কপিই পাচ্ছি না।

সাহিত্যে প্রবেশ…

জেমস জর্নেশ চিরান : সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে কবিতার মাধ্যমে সুপ্রাচীন ক্যাথলিক সাপ্তাহিকী ‘প্রতিবেশী’-র সাহিত্য আসরে প্রবেশ। সেই সময়ে বাঙালি খ্রিষ্টীয়ান সমাজের এক ঝাঁক সাহিত্যকর্মী, কবিতা কর্মীর যেমন আবির্ভাব হয়েছিল তেমনি প্রতিবেশীকে ঘিরে গারো লিখিয়েদের মধ্যেও একটা জাগরণ তৈরি হয়েছিল। তবে প্রতিবেশীর পাতায় অনেকেই ছিলেন অনিয়মিত। বলতে হয়, আমি আর বন্ধুবর কবি মতেন্দ্র মানখিন নিয়মিত হাজির থাকতাম।

জর্জদাও নীলু রুরাম নামে নিয়মিত থাকতেন। সেই সময়ে গারোদের মধ্যে যারা প্রতিবেশীতে মাঝমধ্যেই উপস্থিত থাকতেন তারা হলেন, বি.এফ.রংদি, ঝর্ণা চিরান, মৃগেন হাগিদক, সেলেষ্টিন শিশির মৃ, বিজন মৃ, ইগনেসিউস দাওয়া, বিধি পিটার দাংগ, ফা: ক্লেমেন্ট রিছিল, প্রমোদ মানকিন, মাইকেল মিতেন নকরেক, সুভাষ সাংমা (জেংচাম) ফাদার পিটার রেমা, প্রশান্ত কুমার জাম্বিল, ডানিয়েল আর রুরাম, জলেন্দ্র রিছিল, ফাদার কামিল্লুস রেমা, সুভাষ চিছামসহ আরও অনেকেই। দু:খিত অনেকের নাম স্মরণ করতে পারছিনা। এক্ষেত্রে আমি কেবল প্রতিবেশীর পাতা থেকেই স্মরণে আনছি।

রাণীখং মিশন চিঠি থেকে ধর্মজ্যোতি তারপর প্রতিবেশী, আর এই প্রতিবেশীতে গারোদের অনেকজনই লিখেছেন। লিখছেন।

সম্ভবত এ কারণেই প্রতিবেশী কিন্তু আমাদের সময় থেকেই আমাদের একান্ত আপন করে নিয়েছে। বিশেষত প্রতিবেশীর স্বর্ণযুগ ফাদার জ্যোতি,  এফ. গমেজের সম্পাদনা থেকেই।

তারপরেও প্রতিবেশীর পাতায় অনেকের লেখা আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে এবং ভাল লেগেছে তারা হলেন, বাবুল,ডি নকরেক, থিউফিল নকরেক, শরৎ ম্র্রং, এ. এম.আন্তোনী চিরান, অরণ্য. ই. চিরান, রবার্ট অরবিন্দু চিরান, ফিডেল, ডি. সাংমা(ফিডেল এই নামেই প্রথমত লেখতো) এছাড়াও প্রতিবেশীতে অনেকে হয়তো লিখেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে প্রতিবেশীর সাথে নানান কারণে যোগাযোগ হয়ে উঠেনি। মাঝেমধ্যে কারো পড়ার টেবিলে বসলে ম্যাগাজিন আকারের প্রতিবেশী দেখলে নাড়াচড়া করে দেখতাম মাত্র। কাজেই নিয়মিত না পড়লে বলাই যাবে না কারা কারা নিয়মিত লেখতেন। পরবর্তীতে খ্রিষ্টীয়ান সমাজের অধুনালুপ্ত একটা পত্রিকা “স্বর্গ মর্ত”নামে আামাদের হাতে আসে। যদিও প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক শ্রদ্ধেয় স্যার যতীন সরকার বলতেন, এ কাগজের ‘মর্ত’ বানানটাই ভুল। হওয়া উচিত ‘মর্ত্ত’। যাই হোক, একাগজেও অনেক গারোরা লেখতেন। সবার নাম স্মরণে নেই, বেশি মনে পড়ে তুখোড় সমালোচক,লেখক মান্যবর সিলভেষ্টার রিছিলের কথা, ওয়ালখি মিচিকের কথা।

দুঃখের কথা হলো,তারা অনেকেই আর লেখার জগতে নেই। কেউ শারিরীক প্রয়াত হয়েছেন আর কেউবা মানসিক।

কবির প্রথম কবিতা গ্রন্থ

কবির প্রথম কবিতা গ্রন্থ

প্রথম কবিতার বই দুঃসময়ের বসতভিটা…

জেমস জর্নেশ চিরান : আমার প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘দু:সময়ের বসত ভিটা’। বলা চলে, একটা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করা সেই সময়ে আমার জন্য একটা দুঃসময় ও দু:সাহসীই ছিল। কিন্তু আমার এ দুঃসময়ে অনেকটা আবেগভরেই এগিয়ে এলো ছোট বাজার, ময়মনসিংহ-এর ইসলাম প্রিন্টার্সের কর্ণধার বন্ধবর আব্বাসউদ্দীন তালুকদার। আর প্রুফ দেখার কাজে এগিয়ে এলো, কলেজ জীবনের সাথী ও কবি বন্ধু মাহমুদ আল মামুন। ভাবতেও অবাক লাগে বন্ধুবর আব্বাসউদ্দীন তালুকদার বইটি নিজের খরচেই করে দিয়ছিল। সে এখন আমেরিকা প্রবাসী। আর মাহমুদ আল মামুন পুরোদস্তর কবি,অনেক কাব্যগ্রন্থের জনক।

ময়মনসিংহ সেনপাড়া রোডে ছিল দেশ প্রকাশনী নামে একট্ প্রেস,যার সত্ত্বাধিকারী ছিলেন ইপ্ফাত আরা নামের শিল্প সাহিত্যের কর্ণধার (ময়মনসিংহের) ভদ্র মহিলা। ‘দ্বিতীয় চিন্তা’ নামে চমৎকার সাহিত্যের কাগজ তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশ হতো। সেখানে আমিও নিয়মিত লেখতাম। সেই সুবাদে ভদ্র মহিলার সাথে পরিচয়। আর এ পরিচয়ের সুবাদেই কাভারটি তার প্রেসেই করিয়ে নিলাম বিনা মূল্যে। লেটার প্রেসের আমলে সৌভাগ্যবান না হলে এমন সহযোগিতা পাওয়া ছিল দুর্লভ।

আমি তখন ওয়ার্ল্ড ভিশন-এ চাকরির সুবাদে ময়নসিংহ শহরে থাকি। ময়মনসিংহ শহরটা আসলে শিক্ষা, শিল্প সংস্কৃতির শহর।এ সময় ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদকে ঘিরে সাহিত্যমোদী অনেক তরুণ লিখিয়েদের আড্ডা জমতো। আমিও নিয়িমিত সেই আড্ডায় সামিল হতাম। কাজেই সাহিত্যমনা বন্ধু-বান্ধব ছিল অনেক। তাদের সকলের সাথে প্রাণের আড্ডায় যেমন মেতে উঠতেছিলাম, তেমনি গার্হস্থ্য জীবনের প্রয়োজনে মায়ের বাড়ির পার্শ্বে নিজস্ব বসতভিটা নির্মাণের কাজও এগিয়ে নিচ্ছিলাম। একদিকে কাব্য প্রকাশনার দুর্বার আকাঙ্খা, অন্যদিকে নিজস্ব বসত ভিটা নির্মাণের প্রয়াস আবার আর্থিক অক্ষমতা সব কিছু মিলিয়েই প্রথম কাব্য গ্রন্থটির নাম রেখেছিলাম, ‘দু:সময়ের বসত ভিটা।’

৩০০কপির মতো বই বেড় করেই প্রথমেই খেলাম এক ধাক্কা। বইতো বিক্রি হয় না। শ্রদ্ধেয় স্যার যতীন সরকারসহ বন্ধু-বান্ধবদের ৫০ টির মতো সৌজন্য কপি দিলাম। কবি ও নাট্যকার বন্ধুবর ফরিদ আহমদ দুলালকে সৌজন্য কপি দিতে গিয়ে দেখলাম, তার সদ্য প্রকাশিত “লাবণ্য ছুঁয়েছি তোমাকে” কাব্য গ্রন্থটিও তার ময়মনসিংহের ইসলামিক ফাউন্ডেশন অফিস কক্ষে স্তুপাকারে পড়ে আছে  আমার বইয়ের মতো। দেখে সাহস পেলাম। ভাবলাম বিক্রি না হোক, কী হলো তাতে? এক সময়েতো হবে।

তার কিছুদিন পরেই  কে.সি. রায় রোডের ওয়ার্ল্ড ভিশনের ফ্যামিলি ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টে হঠাৎ করেই সেই সময়ের বহুল আলোচিত নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিন আমার কাছে এলেন। তার ব্যক্তিগত  গাড়িতে করেই তিনি আসছিলেন, তবে বোরখা পড়ে। আমি প্রথমে বুঝতে না পেরে হতচকিত হয়ে গেলাম। হঠাৎ করেই ভাবনা এলো, এই যদি হয় নারীবাদী তসলিমা নাসরিন তাহলে তার পড়নে বোরখা কেন? কিছু সময়ের মধ্যেই ভাবনার জবাব পেয়ে গেলাম, যখন তিনি আমার কক্ষে ঢুকা মাত্রই বোরখাটা অন্যত্র রেখে বলা শুরু করলেন, ভাই, আমার বিরুদ্ধে মৌলবাদিদের কড়া নজরদারী বেশিক্ষণ বসবো না। তারা আমার মাথার দাম ঘোষণা করেছে। কেবল আপন দাদা আপনার বন্ধু বলে আর কবি বলে আপনার সাথে সংক্ষিপ্ত  সময় আর ঝুঁকি নিয়ে সাক্ষাৎ করতে এসেছি। জীবনে আর দেখা হবে কি-না জানি না। আমার জীবনে কী ঘটে তাও জানি না। তার চোখে মুখের উদ্বিগ্ন আমি স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু কোন প্রকার সান্তনার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললাম, ঠান্ডা বা কফি? তিনি বললেন, কিছুই লাগবে না। বরং বললেন, আপনার প্রথম কাব্য গ্রন্থের খবর কি? আপনার দুঃসময়ের বসত ভিটা? জানতে চাইলাম, জানলেন কীভাবে? দাদার কাছেই শুনেছি, বইটাও পেয়েছি, পড়েছিও। অসাধারণ আপনি একটা বিশেষ সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন। বললাম, বইটা যে বিক্রি হচ্ছে না।

হবে, একদিন হবে। আমারও এমন হয়েছিল। আমার প্রথম বইটাও খাটের তলাতে স্তুপাকারে বহুদিন যাবৎ জমা হয়েছিল। আর এখন? আমি তার এ কথাতে যেন ঘন মেঘের মধ্যেও সূর্যের হাসি দেখলাম। ধন্যবাদ দিলাম। এর সপ্তাখানেকের মধ্যে শুনলাম তসলিমা নাসরিন দেশান্তরী হয়েছেন।

গানও লিখতেন…

জেমস জর্নেশ চিরান : হ্যাঁ লিখতাম। এখনও মাঝ-মধ্যে লিখি। আবার নিজেই সুরারোপ করার চেষ্টা করি। বলা চলে, আমার রচিত গারো গানগুলো বাণী বা বক্তব্যধর্মী। সমাজ উদ্দীপনামূলক ও জাগরণধর্মী বিষয়াবলিকে প্রাধান্য দিই বেশি। আবার সুরারোপের ক্ষেত্রে আমি গারো লোকগীতির মৌলিকতাকেই প্রছন্নে হলেও টেনে আনবার চেষ্টা করি। বাউল ধাঁচের বাংলা গানও কম লেখা হয়নি। এখানেও সুরারোপের ক্ষেত্রে বাংলা লোকসুরকে গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করেছি।

গান লেখার অভিজ্ঞতা কিংবা কাহিনি…

জেমস জর্নেশ চিরান : গান লেখার কোনো অভিজ্ঞতা বা প্রেক্ষাপট বলতে গেলে বা নাড়া দেয়ার বিষয়টি বলতে গেলে একটু ভূমিকা টেনেই বলতে হতে পারে। যেমন-১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে “মিজাল সাল্লো মিসালবা সাজা নে  আমা, নাং নামচিকদে,

মিজালো মিসালবা সাজা;

ওয়ামাংখো আগানোবা

নকনি মামাথাংবা

আংখোদে বেবেয়ান রা.জা

নে আমা নে

আংখোদে বেবেয়ান রা.জা।।…

গানটি লেখার অভিজ্ঞতা ও প্রেক্ষাপট অনেকটা কষ্টের এমনকি একটা গভীর ভাবনার বিষয়। আমি তখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইনি। কিন্তু সমাজ নিয়ে ভাবতাম, সমাজের বিভিন্ন নেতিবাচক, অপ্রাসঙ্গিক ও অসঙ্গতিগুলো আমাকে যারপরনাই ব্যাথিত করতো। ভাবতাম কী করে এসকল অন্যায্য ও অসঙ্গতি দিকগুলো দূর করা যায়? আমি তখন জলছত্র কর্পোস খ্রিষ্টি হাই স্কুলে দিদি মারিয়া চিরানের নেতৃত্বে সহকারি শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। পাশাপাশি ফাদার হোমারিকের মতো মহান ফাদার ও নি:স্বার্থ সমাজ সেবকের স্বান্নিধ্যেও আছি, বলা চলে সমাজ সেবার ব্রত নিয়ে। তখনকার সময়ের আ.বিমা(হা.বিমা) আজকের হা.বিমার মতো ছিল না। ছিল গারো প্রথাভিত্তিক আইনের গ্যাড়াকলে। এই গ্যাড়াকলে পড়ে যে কতো সংসারপ্রিয় গারো পুরুষদের স্বপ্নসাধ নষ্ট হয়ে গেছে তার কোন ইয়ত্তা ছিল না। তখনকার দিনে হাবিমাবাসীর কাছে গারো সামাজিক প্রথা ছিল স্বর্গীয় আইনের মতো। এর কোনো কোনো হেরফের হওয়া মানে সমাজ- প্রথা নীতির পতন(?)

একদিন মাননীয় ফাদার আমাকে গারো গান লেখার জন ফরমায়েশ দিলেন সাথে এও বলে দিলেন, গানগুলো যাতে সমাজ উদ্দীপনামূলক হয় এবং গারো সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি থাকে। ফাদারের ফরমায়েশ অনুসারে ভাবতে থাকলাম কীভাবে এমন গান লেখা যায়? গানে আবার সুরারোপের বিষয়টি আছে। হাতের কাছে হারমোনিয়ামও ছিল না। দিনের বেলা শিক্ষকতা, রাত্রে হোষ্টেল সুপার হিসেবে বোর্ডিং-এর ছাত্রদের তত্ত্বাবধান করা;এ নিয়ে চলছিল সময় কাল। এক রাত্রে ঘটলো এক বিপত্তি। সম্ভবত রাত্র এগারো কি বারোটার দিকে হবে হোস্টেলের ছাত্ররা আমাকে ঘুম থেকে জাগালো এবং বললো, আমাদের হোস্টেলের গেইটের সামনে একজন মান্দি পুরুষ কেবলই কাঁদছে,তাকে নাকি তার পরিবার থেকে বিতাড়িত করেছে।

আমি গিয়ে জানতে চাইলাম তার সমস্যার কথা। সে তার সমস্যাবলি যেভাবে আমাকে জানিয়েছে, আমার লেখা এগানেই তার বিবৃতি এসেছে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে আমার গান লেখার বেলায়। ঐ রাতে আমি আর  সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। কেবলই মাথা মগজ তোলপাড় করছিল কী করে এঘটনাকে আমি ধরে রাখি?সরাসরি ভাবলাম,গারো পুরুষদের এরকম অসহায়ত্বের বিষয় নিয়ে একটা গানই লিখে ফেলিনা কেন?লেখা শুরু করলাম।কিন্তু লিখতে গিয়েই ঘটলো এক বিপত্তি। কাহিনি আমার জানা,কিন্তু গান লেখার কাজ এগুচ্ছে না। গানের স্থায়ী ও সঞ্চারি লিখেই হঠাৎ করে আমার নিজের চোখের জলে কলমের কালিসহ কাগজ ভিজে যেতে থাকলো। তখনকার দিনে বলপেন ছিল না। চোখের জলে  কাগজ ভিজে গানের প্রথম চরণটাই বুঝতে পারছিলামনা। চিন্তা করে প্রথম চরণটাই স্মরণে এনে আবার লেখলাম। আবারও চোখের জল। আবারও নষ্ট।নিজেকে শক্ত করতে চেষ্টা করলাম। কিন্ত সে রাত্রে গানটি আমার শেষই হলোনা। আমারও ঘুম হলো না।

পরদিন গানটি লেখলাম। তবে এটাও ঠিক গানটি শেষ করতে পারি নি। গানটি শেষ করতে দু’বছর লেগেছিল। একারণে পরবর্তী কথাগুলোও একটু পরিবর্তন হয়েছে।

একটা গানে অবশ্যই এক ইতিহাস থাকে। থাকতে হয়। নতুবা গানটা অল্প সময়ের আবেগী বাণী হয়।ভালবাসার গানে তা বোধহয় সহজেই সম্ভব। কিন্তু একটা জাতি সত্ত্বার প্রথাভিত্তিক আইন সৃষ্ট সামাজিক সমস্যার কথা গানের বাণীতে আনতে গিয়ে সময় নিতেই হয়েছে। বুঝতে হয়েছে।

জেনে বুঝে লেখার কারণেই এগানটি অনেকের হৃদয় মন স্পর্শ করেছে বলে আমার বিশ্বাস। এক্ষেত্রে একটি বিশেষ ঘটনার কথা না বলে পারছিনা। ঘটনা হলো,একদিন পার্শ্ববর্তী গ্রামের কোন এক অনুষ্ঠানে লাউড স্পিকারে আলোচিত গানটি গাইছিলাম আমি নিজেই। গাইতে গাইতে গানটির অন্তরায় যখন পৌঁছলাম, হঠাৎ করে দেখি নব্বই উর্ধ বয়েসের এক মা ষ্টেজে হাজির। সে আমাকে দেখেই চিনে ফেললো এবং গানের শেষে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,বাবা তুমি এগানটি কেন তুমি গাইলে?সে আরো বললো,গানের একথাগুলোতো আমার বড় ছেলেরই জীবনী। এগান শুনে আমি বিছানায় শুয়ে থাকতে পারিনি।আজকাল হাটতেও পারিনা তেমন। হামাগুড়ি দিয়েই এসেছি,গানটি কে গাইছে চাক্ষুস দেখার জন্য।এসেই জানলাম তুমি গাইছো। তোমাকে আশীর্বাদ বাবা! তোমার এগানেই মৃত বড় ছেলে সন্তানকে আজ আমার মনে পড়ে গেলো। তারপর রীতিমতো সে কান্না জুড়ে দিলো। আনন্দের অনুষ্ঠান পরিপূর্ণ হয়ে গেলো বিষাদে।আমি রীতিমতো অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।

আরেকটি গানের ঘটনা আরেক রকম। গানটি হলো, “আনচিং আ.চিক বেওয়ালো, জিক সি.এ আ.খিম ওয়াতগাল্লো

ব্রাংনাসা নাআাইগেন জজং…।।

সন্ধ্যেবেলায় একটা সামান্য ‘চু’এর আসরে বসা আমার নিয়মিত অনুষ্ঠান। আবার সেই ‘চু’-এর আসরে আমি মুরুব্বিদের ডাকতাম। মুরুব্বিদের সাথে গারো প্রথাভিত্তিক আইনের ভালো ও মন্দ দিক নিয়ে আলোচনা করতাম। আবার মাঝে মধ্যে অনুষ্ঠানকে তাৎপর্যময় করার জন্য রেরে গাইতাম। রেরে গাওয়ার শেষে একদিন গাইলাম এই গানটি- “আনচিং আ.চিক বেওয়ালো…”

গানটি গাওয়ার সময় ঘটলো আরেক বিপত্তি। আসরের এক গারো পুরুষ হু হু করে কান্না জুড়ে দিলো। গান থামিয়ে তাকে বুঝাতে শুরু করলাম। জানলাম,তার জীবন নাকি এ গানেরই মতো।

তারপরে আরেকটি গান। ব্যাঙ্গাত্বক বলবো আমি। গানটার জন্য বাঙালি ভাইদের কাছে দুটি লাইনের জন্য অনেক প্রশ্নের সন্মুখিন হয়েছি। বলা চলে হেনস্থাও হয়েছি। গানটি দুহাজার পরবর্তী সময়ে লিখেছিলাম মনে হয়।গানটির প্রথম চরণ এরকম-

“চেংও আচ্ছু-আম্বিদে আ্প্ফা মি.মাং সাগিদে

বিলদি-বিলদাং দাক্কাখোদে সিনজা,

————-    ———–

(এ বাণীতেই তাদের আপত্তি)

আম্বি গিব্বি আগান্না

রুরিদে রুরিন্না,

অকনিংওদে খাইসুম খাড়ি চুপজা।

(আরেকটি চরণ আছে যেমন-)

রুরিরাংদে মিচিকখোদে খিমজা’

বিতচি রিং-এ গালমানো

আ.বা সংবা মা.মান্নো

জিকখো গাল্লে

জিকগিপ্পিনচা জম্মা।।

দারুণ আপত্তি করেছিল কথাগুলোই। আমি বলেছি যা সত্য তাই বলেছি। আমার গানের কথা পরিবর্তের আগে বাঙালি চরিত্রের পরিবর্তন আনো।

কবিতা লেখার অভিজ্ঞতা…

 জেমস জর্নেশ চিরান : কবিতা লিখতে গিয়ে তেমন কোন সুখের বা দুঃখের কাহিনি মনে পড়ে না। তবে মজার একটা ঘটনাই বটে। মহান একুশের গ্রন্থমেলাকে উপলক্ষ্য করে আমি আর বন্ধুবর কবি মতেন্দ্র মানখিন ঢাকায় গিয়েছিলাম কবিতা আবৃত্তি করার জন্য। আবৃত্তির পূর্বে কবিতা জমা দিতে হয় নির্ধারিত কবির কাছে। জমা দিলাম, যথারীতি মনোনয়ন পেলাম দুজনই। এদিকে বাঙালি কবিরাও কবিতা জমা দিচ্ছে। কিন্তু একজন কবিতা কর্মীর কবিতা বোধ হয় সংগ্রহকারীর পছন্দ হয়নি। তাই তিনি বলছিলেন, এটা কবিতা হয়নি। পড়া যাবে না। এদিকে সেও কবিতাকর্মীও নাছোড়বান্দা। বলা চলে নাছোড়বান্দা কবি! বার বার অনুরোধ করছিলেন,কবিতাটি জমা নেয়ার জন্য। এবার বেজার হলেন, কবি বেচারা। বিরক্ত হয়ে বললেন, আপনি কী জোর করেই কবি হতে চান? কথাটা শুনে আমি আর বন্ধুবর কবি মতেন্দ্র মানখিন না হেসে আর থাকতে পারলাম না।

আরেকটি ঘটনার কথা খুব মনে পড়ে, সময়টা আশির দশকেই। হঠাৎ করে আমার ঠিকানায় এক চিঠি এলো সাপ্তাহিক প্রতিবেশীর অফিস থেকে। চিঠিতে দিনক্ষণ তারিখ লেখে আমন্ত্রণ দেয়া আমি কবিতার ক্ষেত্রে আর্চ বিশপ গাঙ্গুলী সাহিত্যপুরস্কার পাচ্ছি। যারপর নাই খুশি হলাম। বাপ-মাকেও বললাম বিষয়টি। বাপ মা খুশি হলেন। যথা সময়ে ঢাকায় গেলাম প্রতিবেশী অফিসে। গিয়ে দেখলাম,পাঁচ পাঁচটি ধর্মপ্রদেশের মাননীয় বিশপগণ বসা সাথে মাননীয় প্রয়াত আর্চবিশ মাইকেল রোজারিও। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন শ্রদ্ধাভাজন প্রিয় কবি আসাদ চৌধুরী। নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হলো। উচ্ছসিত হলাম। কিন্তু মনের উচ্ছাস ক্ষণিকের জন্য হলেও দমিত হলো,যখন ‘কেউতো এলো না কোনদিন’ একটা কবিতা বিশেষের জন্য আমার নামটি ঘোষিত হলো পুরস্কারের জন্য তখন উপস্থিত বাঙালি কিছু খ্রিষ্টানদের মুখ থেকেই শুনতে পেলাম, গারোরা আবার কবে থেকে কবি হলো? বলা বাহুল্য তাদের এই জাতি তাচ্ছিল্যতা আমাকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছে।

গারো কবিতার ইতিহাসও…

জেমস জর্নেশ চিরান : গারো সাহিত্য বলতে গারো ভাষায় সাহিত্য চর্চার কথা যদি বলি এবং সেটা যদি হয় লিখিত  গারো সাহিত্য তাহলে জানা মতে এ ভূ-খন্ডবাসী গারোদের মধ্যে কোনোকালেই তা ছিলো না। যা ছিলো তাহলো লোক সাহিত্য। শৈশবকালে আম্বি-আচ্ছুদের ও বাপ-মাদের বেলায় দেখেছি, তারা লোকগান ভিত্তিক সাহিত্য চর্চা করতেন। তাদের এই মৌখিক সাহিত্য চর্চাটি ছিল কোনো অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক।

তাদের এ চর্চাটি কোনো  প্রাতিষ্ঠানিক  রূপ পায়নি। আবার দেখলাম তারা রাম লক্ষণের পালা গানও করছে। আবার গারো রেরে লোক গীতিতে এমন শব্দমালাও সন্নিবেশিতে করছে তাতে আমার মনে হয়েছে, হিন্দু ধর্মের অনেক চরিত্রগুলোই ছিলো তাদের আদর্শিক।

অনুজকবিদের কবিতা সম্পর্কে…

জেমস জর্নেশ চিরান : আমার বা আমাদের পরে গারোদের মধ্যে যারা লিখতে আসছে, অন্তত নিয়মিত যারা তাদের মধ্যে অনেকেই প্রতিশ্রূতিশীল এবং নিজস্ব ধারায় অন্যন্য। প্রত্যেকেরই একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে।Commitment আছে। তাদের লেখায় সমাজের প্রতি একটা দায়বদ্ধতাও আছে। শব্দ চয়নেও মুন্সিয়ানা আছে। সমসাময়িক সময়ের যন্ত্রণা আছে, প্রতিচ্ছবি আছে। আমি নিয়মিত সকল লিখিয়েদের অভিনন্দন জানাই।আব্দার জানাই,যেন মাঝপথে থেমে না যায়।

আরো লেখা

https://www.youtube.com/watch?v=WBJDSHniwqU

করোনাকালে কেমন আছেন কবি জেমস জর্নেশ চিরান

ফাদার হোমারিক মহান ও নিঃস্বার্থ সমাজ সেবক ।। জেমস জর্নেশ চিরান




সম্পাদক : মিঠুন রাকসাম

উপদেষ্টা : মতেন্দ্র মানখিন, থিওফিল নকরেক

যোগাযোগ:  ১৯ মণিপুরিপাড়া, সংসদ এভিনিউ ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। 01787161281, 01575090829

thokbirim281@gmail.com

 

থকবিরিমে প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। Copyright 2020 © Thokbirim.com.

Design by Raytahost