Thokbirim | logo

৪ঠা বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৭ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

রাজধানীর বুকে ‘গারো বাজার’-গারো জাতিগোষ্ঠীর আধিপত্যকেই জানান দেয় ।। এম. মারাক

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৬, ২০১৯, ২০:২৭

রাজধানীর বুকে ‘গারো বাজার’-গারো জাতিগোষ্ঠীর আধিপত্যকেই জানান দেয় ।। এম. মারাক

‘বালুর মাঠে একটা দোকান ছিলো কিন্তু সংস্কারের জন্য ভেঙে দিলো। এখন আমরা কী করি কোথায় বসি… তখন জন্তু এখানে দোকান নিয়েছে। এখন জন্তুর দোকান ছাড়া তো আমাদের আড্ডার জায়গা নাই, বসার জায়গা নাই। পরে এখানে বসে চা খেতে খেতে আড্ডা হলো। আগে তো আমরা ঐ বালুর মাঠকেই গারো বাজার বলতাম। কিন্তু এখানে যেহেতু  আমরা-আমরা বসি আড্ডা দেই তাই এটা আমরা গারো বাজার নাম রাখি। পরে কয়েকমাস পর জন্তুর দোকান এখানে আসলো। পরে তার দোকানে বসেই আমরা ঠিক করলাম আমরা যেহেতু ওখানে আর বসি না, এখানেই বসছি তাহলে এর নাম দিই গারো বাজার। নকমারা যেখানেই থাকুক গারো বাজার বললেই যেন  এখানে চলে আসে…এভাবেই বলতে বলতে গারো বাজার হয়ে গেছে!’

ঢাকা ওয়ানগালার (কালাচাঁদপুর বনানী) সাবেক নকমা দিপন দিও শোনালেন গারো বাজার নামকরণের কাহিনি। দিপন দিও সেই ১৯৯৫ সাল থেকে আছেন কালাচাঁদপুর-শাহজাদপুর এলাকায়। প্রায় ২৫ বছর হয়ে গেলো। এর আগে ছিলেন মোহাম্মাদপুর এলাকায়।

রাজধানী ঢাকার গুলশান থানার অধীন কালাচাঁদপুরে একটি গলির ভেতর গড়ে ওঠেছে গারো বাজার। এই গলিতে প্রায় দশ/বারটি নানা ধরনের দোকান রয়েছে গারোদের দ্বারা পরিচালিত।

কী আছে গারো বাজারে? হালুয়াঘাটের কোনো এক গ্রাম থেকে কাজ করতে আসা রাহুল ম্রং(ছদ্ম নাম) বলেন, গারোদের ঐতিহ্যবাহী খাবার কুচিয়া, মেন্দা, শামুক, কুচিয়া গ্রান, মধু বিবাল, মিচেং পাতা, নাখাম জাগুয়া, নাখাম গ্রান, দকমান্দা-দকশাড়ি এমন কি টি-শার্ট, জিন্সসহ যাবতীয় পোশাকও পাওয়া যায়।

তিনি আরো বলেন, রয়েছে টেইলার্স, চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র, সেলুন, চায়ের দোকান, ফার্মেসি, মুদির দোকান, জামা কাপড়ের দোকানসহ সমবায় সমিতির অফিসও!

গারো বাজার ঘুরে দেখা গেলো গারো ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বাঙালি ব্যবসায়ীরাও সমান তালে ব্যবসা করছে গারো বাজার জুড়ে। কালাচাঁদপুরে বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং সিলেটের বিভিন্ন গ্রামের গারোদের বসবাস। ফলে গারো বাজারে সবারই আসা হয় দিনে একবার হলেও। এখানে আসলে পরিচিত কারো না কারো সাথে দেখা হয়ে যায় তখন গ্রামের খবরও পাওয়া যায়। কালাচাঁদপুরকে বর্তমানে গারো এলাকা বলেন অনেকেই। এখানে গারোদের নিজস্ব ফ্ল্যাটবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গির্জা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা সংগঠন রয়েছে। এই এলাকার গারো আদিবাসীগণ প্রতিবছর ঐতিহ্যবাহী ওয়াগালা উৎসব বৃহৎদাকারে পালন করে থাকেন।

 

সাবেক নকমা দিপন দিও

গুলশান এলাকায় (থানার অধীন) গারোদের বসবাস কতজন হতে পারে? প্রশ্নের উত্তরে সাবেক নকমা দিপন দিও বলেন ‘আমার তো মনে হয় গুলশান থানার ভেতর প্রায় ২৫ হাজার হবেই। অনেক আগেই যখন গণনা করার চেষ্টা করা হয় তখনই তো দশ-বার হাজার ছিলো। তখন এতো ঘনবসতি গারো ছিলো না, দেখাও যায়নি সেতুলনায় এখন গুলশান থানার ভেতর বিশ/পঁচিশ হাজার গারো তো হবেই’

গারো বাজারকে অনেকেই গিরিঙ্গি বাজারও বলেন। এখানে মাঝে মাঝেই চু খেয়ে কিংবা নেশা করে ঝগড়া হয়, মারামারি হয়। এই বিষয়ে জানতে চাইলে নকমা জানান- ‘মাঝখানে হতো।কিন্তু আপাতত বর্তমানে নাই আরকি। বিশেষ করে বর্তমান কমিশনার যিনি তিনি গারোদের খুবই ভালবাসেন এবং শাসনও করেন তারজন্য কোনো কিছু হলেই আমাদের ডাকেন আমরা যাই… তবে আগের মতো ঝগড়া-বিবাদ নাই আর কি!

সাবেক নকমা হেস্টিং রেমা বলেন, আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। এমনও দিন গেছে আমার দোকানের সামনে চু খেয়ে বস্তার মতো পড়ে আছে। রাগ করার পর চলে গেছে।

এখানে লোকজন আসে কেনাকাটা করতে? জানতে চাইলে মিচিক টেইলার্সের কর্ণধার হেলেনা ম্রং বলেন, লোকজন তো আসেই। সেই মিরপুর থেকে ফার্মগেট থেকে উত্তরা থেকে আসে। আমার দোকানে বসে আড্ডা দেয়।কুচিয়া, জাগুয়া নাখাম গারোদের খাবার নিয়ে যায়। এখন তো সবাই গারো বাজার বললেই বুঝে রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে সবাই’

মিচিক টেইলার্সের কর্ণধার হেলেনা ম্রং

কোনো ঝামেলা হয় না? দিদি বলেন, ‘না কোনো সমস্যা নাই। কোনো মাস্তান চাদাবাজি নাই। চার বছরে আমাকে কেউ বলে নাই যে, চাদা দাও। আর বাবু ভাইয়ের বলা আছে কেউ চাদার কথা বললে সঙ্গে সঙ্গে উনাকে জানাতে। সে জন্য কেউ কোনো ঝামেলা করে না।’

গারো বাজারের দোকান ভাড়াও তুলনামূলক কম। মিচিক টেইলার্সের কর্ণধার হেলেনা ম্রং বলেন, এখানকার সব দোকানের ভাড়া মাসে ৫ হাজার টাকা।

গারো বাজারের গলি সরু কিন্তু দুপাশেই দোকান। চায়ের দোকান তারপরই কাপড়ের দোকান। তারপরই ওষুধের দোকান। খুবই ব্যস্ত গলি। রিকশার বেল সাইকেলের বেল আর ছোটবাচ্চাদের চেঁচানি ছাপিয়ে গারো পুরুষ মহিলার মজাক করা গলার আওয়াজই বলে দেয় চায়ের দোকানে বেশ জমছে আড্ডা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গারো মহিলা বলেন, আমরা তো সারাদিন কাজের পরই এখানে আসি। চা খাই হাওয়া খাই। এখানে কাপড় সেলাই করতে দেই। এখন তো অনেক গারো আমরা যখন ঢাকাতে আসি তখন গারোর দেখা পেতে হলে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হতো। ফার্মগেট নকমান্দিতে গেলে গারোর দেখা পেতাম। এখন তো হাজার হাজার গারো ওয়ানগালাতে পা রাখার জায়গা নাই এমন গারো’

দিনে কেমন বিক্রি হয়? জানতে চাইলে নাম লিখতে নিষেধ করে চা দোকানদার বলেন, ‘হয় টুকটাক। বেশি না। খলি আড্ডামারে। কী কী খেলে, গেম খেলে।এখন অনেক চায়ের দোকান তাই আগের মতো হয় না। তবে চলে…’

গারো ব্যবসায়ীর পাশাপাশি বাঙালি ব্যবসায়ীরাও ব্যবসা করছে সমান তালে। চাচা বলে বসে গেলাম দোকানে। জানতে চাইলাম কেমন চলছে দোকান। তিনি একবুক অভিমান নিয়ে জানালেন, দোকান আর চলে না, সব গারো তো আগে আমার দোকানেই আসতো। এখন গারোর অনেক দোকান… আমার কাছে আসে কম বিক্রিও হয় কম।

একই কথা শোনা গেল আরেকটি দোকানেও। চাচা দীর্ঘদিন ধরে কালাচাঁদপুরে আছেন।তিনি জানালেন, গারো বাজার তো হলো কদিন আগে। আগে এই পাশে ছিলো পানির ডুবা। ঐপাশে বাসা। একটা রিকশা গ্যারেজ।এখন তো গারো আর গারো। গারোর ঠ্যালায় হাঁটা যায় না।

গারো বাজারের মাথায় শুরুতেই কুচিয়ার দোকান ছিলো কদিন হলো বন্ধ রেখেছে। লোকটিকে খোঁজলাম কিন্তু কোথাও পেলাম না। একজনকে পেলাম যিনি সাময়িক কুচিয়ার গ্রান নিয়ে বসেছেন। বারশ টাকা কেজি। সাথে আছে শামুক। ৫০টাকা কেজি। শুকনো কুচিয়ার এতো দাম কেন? বলার সাথে সাথে লোকটি বলল, এক কেজি কুচিয়া গ্রানে ৬/৭টা কুচিয়া ধরে তারপর শুকিয়ে শক্ত কটকটা করে বিক্রি করতে হয় একটু নরম থাকলে নিতে চায় না কেউ। খাটনি আছে অনেক! আর আপনি এই কুচিয়া গ্রান অনেকদিন রেখে খেতে পারবেন। খারিও খেতে পারবেন আবার তেল মসলা দিয়েও খেতে পারবেন। তবে খারিই ভাল বাজারে পেঁয়াজের যা দাম!

লোকটির কথা শুনে মনে হলো তাই তো বাজারে পেঁয়াজের যা দাম গারোদের ঐতিহ্যবাহী রান্নার জন্য তো পেঁয়াজ লাগেই না।

যখন কুচিয়ার আলাপ শেষ করে নাখামের দোকানে ঢুকলাম তখন রাত প্রায় দশটা। জাগুয়া(চ্যাপা) নাখামের দাম শুনে আকাশ থেকে পড়ার মতো মনে হলো। কেজি প্রতি ৫শ টাকা। অথচ একমাস আগেও ছিলো তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ টাকা কেজি। দেশে পেঁয়াজের সাথে সাথে বেড়ে গেছে জাগুয়া(চ্যাপা) নাখামের দাম। গারোদের প্রিয় রান্না সোদা নাখাম দিয়ে ক্ষারি রান্না যে রান্নার জন্য পেঁয়াজ দিতে হয় না। ফলে নাখাম দোকানেও লেগেছে পেঁয়াজের ঝাঁজ।

যখন নাখাম দোকান থেকে বের হয়ে বাড়ি ফিরছি রাত প্রায় বারটা। গারো বাজারের সব দোকান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ঠিক গারো গ্রামের মতোই নিরব হয়ে যাচ্ছে…

ফের সকাল হলে জমে উঠবে আড্ডা, শুরু হবে কোলাহল শুরু হবে কোনো না কোনো অনুষ্ঠানের মিটিং কিংবা কোনো মানবসেবা সংগঠন দাঁড়িয়ে যাবে চিকিৎসা সহায়তার বক্স নিয়ে। ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চলে আসবে নাখাম কুচিয়া থাবুলচু মেন্দা নিতে।




সম্পাদক : মিঠুন রাকসাম

উপদেষ্টা : মতেন্দ্র মানখিন, থিওফিল নকরেক

যোগাযোগ:  ১৯ মণিপুরিপাড়া, সংসদ এভিনিউ ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। 01787161281, 01575090829

thokbirim281@gmail.com

 

থকবিরিমে প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। Copyright 2020 © Thokbirim.com.

Design by Raytahost